শিল্প উদারীকরণ তো হল, শ্রমিকের হাল কি?
Industrialization is what is the condition of the workers

Truth of Bengal, রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী: ১৯৯১ সালে ভারতেশিল্প উদারীকরণ চালু হয়। স্থানীয় শিল্পগুলিকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলে বিশ্ব বাজার দখল করাই ছিল এই নীতি পরিবর্তনের মূল লক্ষ্য। বাজার বড় হলে উত্পাদন বাড়বে আর তাতেই সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। ধনী দেশগুলিতে শিল্প-উত্পাদন বাড়াতে গেলেশ্রমিক পাওয়া যায় না.তাতে উত্পাদন খরচ বাড়ে।
কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে অসংখ্যউদ্বৃত্ত শ্রমিক থাকায়, ভারতে শিল্প উত্পাদনেগ্রামথেকে প্রয়োজনীয় শ্রমিক তুলে আনতে কোনওসমস্যানেই। মজুরি বা খরচ বাড়ার সম্ভাবনা কম। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ আর্থর লুইস এই রকম এক ধারণা দিয়েছিলেন অনেক আগেই। কিন্তু, শিল্পের বাজার সীমিত থাকায় তা ফলপ্রসু হয়নি। অনেক উচ্চাশা নিয়েই নীতি পরিবর্তন হল আর তারপর তিন দশক কেটে গেল। শিক্ষা শেষে চাকরির স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়িত, তারবিশ্লেষণেই এই আলোচনা।
অন্যান্য এশীয় অর্থনীতিতেএই নীতি পরিবর্তনে নিম্ন-উত্পাদনশীলতার কর্মসংস্থান থেকে উচ্চ-উত্পাদনশীল কর্মসংস্থানে ব্যাপক রূপান্তর ঘটেছে। শিল্প উত্পাদন বা ম্যানুফ্যাকচারিংখাত সেই রূপান্তরে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। ভারতে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর বা উত্পাদন শিল্প এখনও খুবই সীমিত।সার্ভিস সেক্টর বা সেবা খাত যেমন সফটওয়্যার, পর্যটন, স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা, বাণিজ্য, ব্যাঙ্কিং, বিম ইত্যাদিতে কর্মসংস্থান ঘটেছে।
কর্ম সংস্থান ঘটেছে নির্মাণ শিল্পেও। কিন্তু সারা বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক পরিবর্তন যার মাধ্যমে এল, সেই কলকারখানা শিল্প নতুন কর্ম সৃষ্টিতে অক্ষম।আশির দশকে দেশের সমগ্র শ্রমিকের দশ শতাংশ কলকারখানায় নিযুক্ত ছিলএবং আজও সেই অনুপাত বজায় আছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের কথা, যে পাট,বস্ত্র,চামড়া যারা এক সময়ে প্রচুর কর্মসংস্থান দিয়েছে, আজ তারা নতুন চাকরি দিতে অক্ষম।
দেশে চাকরি ও বেকারির সম্বন্ধে এক সম্যক ধারণা দিতে প্রতি বছর পর্যায়ক্রমিক শ্রমশক্তি জরিপ (পিএলএফএস) করা হয়ে থাকে। পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট ২০২২-২৩ অবধি প্রকাশিত।সর্বশেষ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, দেশের শ্রমিকদের ৫৭.৩ শতাংশ নিজস্ব ব্যবসা বা স্বনিযুক্ত প্রকল্পের সহায়ক হিসাবে কাজ করছেন। প্রতি বছরই এই ধরনের কাজে নিযুক্ত মানুষের অনুপাত বাড়ছে। দেশে শ্রমিকদের ২১.৮ শতাংশ অস্থায়ী, বাকি ২০.৯ শতাংশ নিয়মিত মজুরিশ্রমিক।
এই রিপোর্ট বলছে, দেশে গ্রাম-শহর মিশিয়ে সমগ্র শ্রমিকদের ৪৫.৮শতাংশ কৃষিতে,খনি ও খনন কার্যে ০.৩ শতাংশ, ম্যানুফ্যাকচারিংউৎপাদনে ১১.৪শতাংশ, বিদ্যুৎ, জল ইত্যাদিতে ০.৫শতাংশ, নির্মাণ কাজে ১৩.০শতাংশ,বাণিজ্য, হোটেল ও রেস্টুরেন্টের কাজে ১২.১শতাংশ। পরিবহণ, স্টোরেজ ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় ৫.৪শতাংশ,অন্যান্য সেবায় ১১.৪শতাংশ। শ্রম বাজারের দুর্বলতা আরও পরিষ্কার হয় অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রের চিত্র দেখলে।
পিএলএফএস ২০২২-২৩ রিপোর্টে দেখা যায়,দেশের ৭৪.৩শতাংশ শ্রমিক ইনফর্মাল বা অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে নিয়োজিত। ২০২১-২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭১.৪শতাংশ।আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রঅর্থাৎযেখানে শ্রমিক স্বার্থ কিছুটা সুরক্ষিত, তা ক্রমশ ছোট হয়ে পড়ছে।
আরও কিছু দুশ্চিন্তার ছবি রয়েছে পিএলএফএস ২০২২-২৩ রিপোর্টে।দেশের ৫৮.৬শতাংশ শ্রমিকের চাকরির কোনও লিখিত চুক্তি বা পত্র নেই, ৪৬.৮শতাংশ শ্রমিক কোনও সবেতন ছুটি পান না, ৫৩.৯শতাংশ শ্রমিক কোনও সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় নেই। রিপোর্টে আরও প্রকাশ, দেশে যারা নিয়মিত মজুরি শ্রমিকের মর্যাদায় আছেনতাদের ২০২২-২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মাসিক গড় মজুরি ছিল ১৯,৫২৩ টাকা। আর ওই বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত গড় মাসিক মজুরি ছিল ২০,০৩৯ টাকা।
সরকারি প্রকল্প ছাড়া অন্য কাজে নিয়োজিত নৈমিত্তিক শ্রমের দৈনিক গড় আয় ২০২২-২৩ জানুয়ারি-মার্চ ছিল ৩৯৮ টাকা।যা এপ্রিল-জুন মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ৪০৩ টাকা। স্ব-কর্মসংস্থান কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের ৩০ দিনের গড় মোট উপার্জন ২০২২-২৩ সালের জানুয়ারি-মার্চ মাসে ছিল ১২,৯৭২ টাকা, এপ্রিল-জুন মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩,৩৪৭ টাকা। প্রায় প্রতিটি পিএলএফএস রিপোর্টে আগের বছরের তুলনায় মজুরিকমেছে।
একই সঙ্গেইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট ২০২৪ দেশে বেকারির এক নির্মম চিত্র তুলে ধরেছে। ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) দ্বারা যৌথভাবে তৈরি অনুসারে, ভারতের কর্মক্ষম জনসংখ্যা ২০২১ সালে ৬৪ শতাংশে দাঁড়ালেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মাত্র ৩৭ শতাংশ তরুণ জড়িয়ে থাকার সুযোগ পেয়েছে। লেখাপড়া শিখেও তেমন চাকরি মিলছে না।
কমপক্ষে মাধ্যমিক শিক্ষার অধিকারী শিক্ষিত তরুণদের অনুপাত সামগ্রিক বেকারিতে যা ২০০০ সালে ৩৫.২ শতাংশ ছিলতা ২০২২ সালে ৬৫.৭ শতাংশঅর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।ভারতের যুবকরা ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের হারেরসঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।প্রায় ৮৩ শতাংশ বেকার জনসংখ্যা এই জনসংখ্যার অন্তর্গত টেকসই কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং জাতির ভবিষ্যতের সমৃদ্ধি সুরক্ষিত করার জন্য অব্যাহত সতর্কতা এবং কার্যকর নীতিগত ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাধীন সমীক্ষা সংস্থা বা থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির (সিএমআইই) সর্বশেষ রিপোর্টে জানাচ্ছে, ২০২৪ সালের জুনে ভারতে বেকারত্বের হার ছিল ৯.২ শতাংশ, যা কিনা মে মাসেই ছিল ৭ শতাংশ। সিএমআইই-র কনজিউমার পিরামিডস হাউজহোল্ড সার্ভে বলছে, ২০২৪ সালের জুনে মহিলা বেকারত্বের হার জাতীয় গড়কে ছাড়িয়ে ১৮.৫ শতাংশে পৌঁছেছে। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৫.১ শতাংশ। একই সময়েপুরুষ বেকারত্বের হার ছিল ৭.৮ শতাংশ। মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়ছে।স্বাভাবিক ভাবে তারা চাকরি করতে চায়। মেয়েদের মধ্যে কর্মহীন হওয়ার যন্ত্রণা ব্যাপক সামাজিক দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে।
লেবার পার্টিসিপেশন রেট (এলপিআর) মে মাসে ৪০.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৪ সালের জুনে ৪১.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালের জুনে এটা ছিল ৩৯.৯ শতাংশ। এলপিআর এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত যারা কাজ করে বা কাজ করতে ইচ্ছুক এবং সক্রিয়ভাবে কর্মক্ষম(১৫ বছর এবং তার বেশি বয়সী। গ্রামীণ বেকারত্বের হার এই বছরের মে মাসে ছিল ৬.৩ শতাংশ, তা বেড়ে জুনে ৯.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শহুরে বেকারত্বের হার ৮.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
ভারত আজ আর্থিক দিকে সমৃদ্ধশালী হচ্ছে।এশিয়ান পাওয়ার ইন্ডেক্স পরিমাপেপৃথিবীর তৃতীয় বৃহৎ শক্তিশালী দেশ ভারত। পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হওয়ার পথে ভারত। সেখানে সরকারি রিপোর্টেই প্রকাশিত সাধারণ শ্রমিকদের আর্থিক পরিস্থিতি যথেষ্ট হতাশব্যঞ্জক। শ্রীলঙ্কা ও বাংলদেশে সরকারের বিরুদ্ধে যে গণঅভ্যুথান দেখা গেল, তার অনেকটাই উপযুক্ত কর্মসংস্থান না পাওয়ারফল। এই দিকে নজরদেওয়ারসময়এসেছে।