সম্পাদকীয়

কেমন আছে দেশের শিশু জনগোষ্ঠী?

আজকের ডিজিটাল যুগে, প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষাগত সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে উঠেছে।

সত্যগোপাল দেঃ কয়েক বছর আগেই ভারতের স্বাধীনতার প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী অতিক্রান্ত হয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে ঘোষিত হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতা অর্থাৎ ‘ফ্রিডম অ্যাট মিড নাইট’। ভারতবর্ষ হয়েছিল দ্বিখণ্ডিত। সৃষ্টি হয়েছিল চির বিবাদমান দুটি দেশ, ভারত ও পাকিস্তান। মাঝে মাঝে শান্তির কথা, আবার শান্তি ভুলে অশান্তির কারগিল, পহেলগাম, পুলওয়ামার জঙ্গি আক্রমণ, ভারতের কাউন্টার এয়ার স্ত্রাইক। এছাড়া ১৯৬৫ এবং ১৯৭১-এর ঘোষিত যুদ্ধ। যার ফলে ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাংলাদেশের জন্ম। আবার সেই বাংলাদেশ অতীত ভুলে তাদের মা-বোনেদের ধর্ষণকারী পাকিস্তানের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায় এবং অন্তহীন অঘোষিত যুদ্ধ। তবে এইসব রাজনৈতিক কচকচানির মধ্যে না গিয়ে কবির কথা মনে পড়ছে-

“বল, বল, বল সবে,

শতবীণা-বেণু-রবে,

ভারত আবার জগৎ-সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।’’

ভারত জগৎসভায় অনেক বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে। শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে মহাকাশ গবেষণায়, বিজ্ঞানে, শিক্ষায়, পরমাণু গবেষণায়, যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইত্যাদি ইত্যাদি। তালিকা দীর্ঘায়ত। সেই সঙ্গে ব্যর্থতার সংখ্যাও দীর্ঘায়ত। আমি যেহেতু সব বিষয়ে বিষয় বোদ্ধা নই তাই একজন শিশু অধিকার, শিশু সুরক্ষা ব্যবহারজীবী হিসেবে স্বাধীন ভারতে শিশুরা কেমন আছে বিশেষ ভাবে প্রন্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুরা— সেটা নিয়ে কিছু বলি। মনে রাখতে হবে, মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ হল শিশু অর্থাৎ যারা ১৮ বছরের নীচে, ভারত সরকারের মান্যতাপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক আইন ইউনাইটেড নেশন চাইল্ড রাইটস কনভেনশন ১৯৮৯ অনু্যায়ী এটিই শিশুদের বয়সের সূচক। এই আইনটিকে ভারত সরকার মান্যতা দিয়েছে ১৯৯২ সালে।

একটি দেশের হিউমান ডেভলপমেন্ট ইনডেক্স অনুযায়ী শিশু মৃত্যুর হার একটি সূচক। নেটভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী ভারতে শিশুমৃত্যুর হার আগের তুলনায় অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। এই হার ১৯৯৪ সালে প্রতি হাজারে ৭৪ থেকে কমে ২০১৫ সালে ৩৭-এ দাঁড়িয়েছে। তবে, ২০১৫ সালের হিসাবে এই হারে গ্রাম (৪১) এবং শহরের (২৫) পরিস্থিতিতে পার্থক্য এখনও যে অনেকটাই বেশি তা বলা বাহুল্য। ২০১৬ সালে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ৩৪.৬ বলে অনুমান করা হয়। সাম্প্রতিক কালে যে অবস্থার আকাশচুম্বী উন্নতি হয়েছে এমন কথা কি বলা যাবে?

কিছু পুরনো তথ্য হাতে এল, ভারতবর্ষে ১৯৯৪ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ১১৩ জন যেখানে ২০১৮ সালে সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি হাজারে ৪১.১ জন।

শিশুর মায়ের মৃত্যুর হার ২০০৭-২০০৯ সালে ছিল প্রতি লাখে ২১২ জন। সেই হার ২০১১-২০১৩ সালে কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি লাখে ১৬৭ জন। ২০১১-২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী কেরল ও অসম রাজ্যের এই হারের মধ্যে বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করা যায়। কেরল রাজ্যের শিশুর মায়ের মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৬১ জন হলেও অসম রাজ্যে এই একই হার প্রতি লাখে ৩০০ জন। ২০১৩ সালের শিশুর মায়ের মৃত্যুর আনুমানিক হার ছিল প্রতি লাখে ১৯০ জন।

ভারতীয় সংবিধানের ২৪ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা রয়েছে, ‘১৪ বছরের নীচে কোনও শিশুকে কোনও কারখানা, খনি বা কোনও বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত করা যাবে না। শিশু শ্রমিক নিয়োগ রোধে ভারতে শিশু শ্রমিক আইন কঠোর করা হয়েছে৷ ১৪ বছরের নীচে কোন বাচ্চাকে কাজে নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়৷ আইন অমান্য করলে সর্বোচ্চ তিন বছর জেল এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হতে পারে৷

পৃথিবীতে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ভারতে সবথেকে বেশি৷ ২০০১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী ৫ থেকে ১৪ বছরের নীচে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা এক কোটি ২৭ লাখ৷ প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও সামাজিক সুরক্ষার অভাব৷ উন্নত শিক্ষা পরিকাঠামোর অভাবে স্কুলছুট বাচ্চাদের সংখ্যা বৃদ্ধি৷ এছাড়া আছে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান৷ বিশ্বায়নের নব্য অর্থনীতির ফলে বাড়ছে বেকারত্ব, মিটছে না মৌলিক চাহিদা৷

শিশু শ্রমিক রোধে সরকার শিশু শ্রমিক আইন সংশোধন করে তা আরও কঠোর করেছে৷ বিপজ্জনক বা অ-বিপজ্জনক কোনও কাজে ১৪ বছরের নীচের কোন বাচ্চা নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ খনি, খাদান, পাথর ভাঙা, বাজি বা বিস্ফোরক পদার্থ তৈরির কারখানায় বয়সসীমা ১৮ বছরের ওপরে৷ শিশু শ্রমিক নিয়োগকে আইনি অপরাধ বলে গণ্য করা হবে৷ কিন্তু আইন তো আছে বাস্তব চিত্র কী? আজও রাজপথে ভিক্ষারত শিশু ট্রাফিক সিগন্যালে হাত বাড়ায়।

বছর, মাস গড়িয়ে যাচ্ছে, আর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়া শিশুদের সংখ্যা। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-এর তথ্যে উঠে এসেছে এইসব ছবি।

শিশুরা তা হলে কোথায়? গত দশকে দেশে সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং বেসরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আজকের ডিজিটাল যুগে, প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষাগত সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে উঠেছে। তবে, সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা প্রায়শই ডিভাইসের সীমিত সুযোগ, ইন্টারনেট সংযোগের অভাব এবং অপ্রতুল ডিজিটাল সাক্ষরতার মতো উল্লেখযোগ্য বাধার মুখোমুখি হয়। কোভিড-১৯-এর সময় এই বৈষম্য চরমে পৌঁছেছিল; দুই বা ততোধিক সন্তানের পরিবার তাদের সন্তানদের ডিভাইস সরবরাহ করতে সক্ষম ছিল না।  ডিজিটাল বিভাজন অত্যন্ত স্পষ্ট। ডিজিটালবলতে বোঝায় যারা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে এবং কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না তাদের মধ্যে ব্যবধান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি ক্রমবর্ধমানভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল বিভাজন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা প্রযুক্তি-চালিত বিশ্বে সকল শিক্ষার্থীর সাফল্য ও ক্ষমতায়নের জন্য এই বৈষম্যগুলি মোকাবিলা করা অপরিহার্য।

ডিজিটাল সাক্ষরতা উদ্বেগজনক। এনএসএস ৭৮তম রাউন্ডের ২০২০-২১ সার্ভে অনুসারে, ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের মধ্যে কম্পিউটার সাক্ষরতার হার ২৪.৭ শতাংশ। ডিজিটাল সাক্ষরতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি পূরণের জন্য, একবিংশ শতাব্দীর লক্ষ্য এবং চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিকে মাথায় রেখে এনইপি ২০২০ চালু করা হয়েছিল কিন্ত বাস্তব রূপায়নে অগণিত প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

বিকশিত ভারতের মাটিতে একটাও শিশু শ্রামিক থাকা উচিত? শিশু শ্রমিক কথাটাই অনেকটা সোনার পাথর বাটির মতো? শ্রমিক হবে বড়রা, ছোটরা নয়।

রাষ্ট্রপুঞ্জের বছর পাঁচেক আগের এক রিপোর্ট নেট ঘাটতে গিয়ে চোখে এল। বিশ্বের ১৮৮টি দেশের মধ্যে শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও জীবনের মান বিবেচনায় ভারতের অবস্থান ১৩৩ নম্বরে ছিল। অর্থাৎ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে শিশুদের জীবনযাত্রা ৫ বছর আগে  উদ্বেগজনকভাবে নীচে ছিল। আশাকরি এখন পরিস্থিতি কিছুটা ইতিবাচক হবে। এই সমীক্ষাটি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং দ্য ল্যান্সেট মেডিক্যাল জার্নাল। তারা দুইটি প্রধান সূচক নির্ধারণ করেছে— সমৃদ্ধির সূচক এবং স্থায়ী উন্নয়ন সূচক।

‘সমৃদ্ধি নির্দেশক’-এর মাধ্যমে দেখা হয়েছে, একটি দেশে শিশু কতটা নিরাপদ, তারা কতটা হিংসা, বৈষম্য ও দারিদ্র্যের বাইরে বাস করছে, তাদের শিক্ষার অধিকার কতটা সুরক্ষিত, খাদ্যের প্রাপ্যতা কেমন, আত্মহত্যার প্রবণতা বা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার কতটা ইত্যাদি।

এই সমস্ত সূচক বিচার করেই দেখা গেছে— ভারতের শিশুদের সামাজিক সুরক্ষার মান চিন্তার কারণ। আমাদের দেশ আজও এমন এক বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে যেখানে প্রতিটি উৎসবের ঝলকানির আড়ালে অনেক শিশুর জীবনে ছায়া ঘনিয়ে আসে— শিশুশ্রম, অপুষ্টি, অবহেলা আর দারিদ্র্যের অন্ধকারে।

পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন বিবেচনায় তৈরি স্থায়ী উন্নয়ন সূচক-এও ভারতের স্থান ৭৭ নম্বরে। অর্থাৎ, পরিবেশগত ভারসাম্য, দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রেও আমাদের দেশের পথ এখনও অনেক বাকি।

এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার খেলা নয়— এ যেন এক নিঃশব্দ প্রশ্ন, আমরা আমাদের শিশুদের জন্য কেমন ভবিষ্যৎ রেখে যাচ্ছি? উৎসবের আলো, উন্নয়নের অগ্রযাত্রা— সবই অর্থহীন, যদি তার মূলে থাকে শিশুর অরক্ষিত, অবহেলিত জীবন, আশাকরি পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়েছে।

দেশের চল্লিশ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য যে বাজেট বরাদ্দ হয় তা কি যথেষ্ট? উওত্তরটা নীতি নির্ধারকগণ জানেন কিন্ত বাস্তব ক্ষেত্রে সেই থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।

তা হলে গণ্ডগোল কোথায়? আসলে মাইন্ডসেট, জীবনযাত্রার মানে বিভাজন, একদিকে উজ্জ্বল প্রদীপ আর অন্যদিকে বৈপরীত্যপূর্ণ প্রদীপের তলায় অন্ধকার– এই অন্ধকার কি আমরা ইচ্ছে করে জিইয়ে রাখছি? না দূরদর্শিতার অভাব? না নীতি নির্ধারকগণ গতানুগতিকতায় আবদ্ধ? কবি সুকান্তের মতো নীতিনির্ধারক কবে বলবেন–

“এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে

চলে যেতে হবে আমাদের।

চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

অবশেষে সব কাজ সেরে

আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে

করে যাব আশীর্বাদ,

তারপর হব ইতিহাস।’’

বিকশিত ভারতের যথাযথ ইতিহাস সেদিন লেখা হবে যেদিন রাজপথে কোনও শিশু শ্রমিক থাকবে না, থাকবে না স্কুলছুট শিশু, পাচার হবে না কোন শিশু, কোন শিশু হিংসার শিকার হবে না। যেদিন রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকায় প্রতিটি শিশুর শৈশব লালিত হবে চর্চিত হবে। সেই বিকশিত ভারত কি দেখে যেতে পারব?