ইতিহাসের মাহেশধাম আজ সারা দেশে বিখ্যাত
Historical Maheshdham is famous throughout the country today

Truth Of Bengal: তরুণ মুখোপাধ্যায়: পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে নতুন করে স্থান পেয়েছে হুগলির মাহেশের জগন্নাথ মন্দির। ২০১৮ সালে রথযাত্রা উপলক্ষে মাহেশে এসেছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই দিন তিনি ৬৩০ বছরের প্রাচীন এবং ভারতবর্ষের দ্বিতীয় বৃহত্তম জগন্নাথ দেবের মন্দিরের ভগ্নদশা দেখে অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন এবং সেদিন রথযাত্রার দিনই ঘোষণা করেছিলেন বাংলার এত বড় প্রাচীন বৈষ্ণবদের তীর্থক্ষেত্র জগন্নাথ দেবের মন্দিরকে নতুন করে সংস্কার করে পর্যটন মানচিত্রে তুলে আনা হবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি পর্যটনমন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন অবিলম্বে যাতে এই প্রাচীন মাহেশের মন্দির এবং তীর্থক্ষেত্রটিকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলা হয়। সঙ্গে সঙ্গে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে কাজ শুরুর সবুজ সংকেত দেয় রাজ্য সরকার। প্রথম পর্যায়ে প্রায় ১২ কোটি টাকার মতো মঞ্জুর করা হয়। তিন বছর ধরে সুন্দরভাবে মূল মন্দির থেকে শুরু করে নাট মন্দির ভোগের ঘর, স্নানপীড়ি ময়দান, জগন্নাথ ঘাট সংস্কার করে অনিন্দ্য সুন্দর রূপ দেওয়া হয়। ২০২১ ভক্তদের জন্য খুলে দেওয়া হয় জগন্নাথ দেবের মন্দিরের সিংহ দুয়ার।
মহেশের জগন্নাথ দেবের মন্দির এবং রথের ইতিহাস সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বর্তমান এই মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ডের সম্পাদক পিয়াল অধিকারী জানালেন, আজ থেকে ৬৩০ বছর আগে বাংলার এক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী বাসনা হয় তিনি নীলাচলে যাবেন এবং সেখানে গিয়ে নিজে হস্তে প্রভু জগন্নাথ দেবকে ভোগ নিবেদন করবেন। সেইমতো বহু ক্লেশ, বহু কষ্ট সহ্য করে বাংলা থেকে ওড়িশা- এই দীর্ঘ পথ তিনি অতিক্রম করে উপস্থিত হন নীলাচলে।
সেখানে গিয়ে তিনি মহাপ্রভুর দর্শন পেয়ে অত্যন্ত পুলকিত হন এবং তাঁর মনের বাসনা সেখানকার তৎকালীন যারা পুরোহিত ছিলেন তাঁদের কাছে ব্যক্ত করেন। কিন্তু এতে ক্ষুব্ধ হন সেখানকার সেবাইতরা। তাঁরা যারপরনাই ধ্রুবানন্দ স্বামীকে অপমান করেন। দুঃখে বেদনায় ধ্রুবানন্দ স্থির করেন, আমি প্রভুর কাছে এলাম আমার মনের বাসনা নিবেদন করার জন্য। কিন্তু তার জন্য এত অপমান আমাকে সহ্য করতে হল। তাই এই জীবন আমি আর রাখব না। কিন্তু সেই রাতেই মহাপ্রভু ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীকে স্বপ্ন দিলেন, বৎস্য তুমি দুঃখ করো না। তুমি এখান থেকে সোজা চলে যাও পশ্চিমবাংলার মাহেশ ধামে। সেখানে গিয়ে তুমি দেখবে গঙ্গার ধারে একটি নিম কাঠ ভেসে আসবে। সেই নিম কাঠ দিয়ে তুমি আমার বিগ্রহ তৈরি করে সাধন ভজন শুরু করো।
প্রভুর আদেশে আনন্দিত ধ্রুবানন্দ তার পরের দিনই তিনি মাহেশের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। দিনের পর দিন মাসের পর মাস দীর্ঘ বিপদসংকুল পথ অতিক্রম করে অবশেষে ফিরে এলেন মহেশের গঙ্গার ধারে। সেখানে একটি পর্ণ কুটির স্থাপন করে মহাপ্রভুর নাম গান করতে করতে লাগলেন। দীর্ঘ দিন যায়, আশায় বসে থাকেন ধ্রুবানন্দ কখন প্রভুর স্বপ্নাদেশ মতো নিম কাঠ আসবে ভেসে আসবে। এইভাবে কেটে যায় দীর্ঘ বছর। অবশেষে এক দুর্যোগপূর্ণ রাতে তিনি দেখেন অশান্ত উথাল পাতাল গঙ্গা। চারিদিকে বিদ্যুতের চমক। সেই বিদ্যুতের আলোয় ধ্রুবানন্দ দেখতে পেলেন, একটি বিশাল নিম কাঠ ভেসে এসেছে নদীর তীরে। এই দেখে আনন্দে উল্লাসিত দিকবিদিক শূন্য হয়ে ধ্রুবানন্দ স্বামী ঝাঁপিয়ে পড়লেন গঙ্গায়। টেনে তুললেন সেই কাঠকে এবং সেই কাঠ থেকে তৈরি হল জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার মূর্তি। গঙ্গা তীরে যে পর্ণ কুটিতে ধ্রুবানন্দ থাকতেন সেখানেই তিন বিগ্রহকে স্থাপন করে সাধন ভজন শুরু করলেন।
এরপর বছরের পর বছর যায়। গঙ্গার তীরে সেই পর্ণ কুঠিরে ধ্রুবানন্দ স্বামী প্রভুর আরাধনা জারি রাখেন তারও বহুবছর পর চৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর ১২ জন পার্শ্বচরকে নিয়ে নীলাচলে যাওয়ার পথে মহেশ ধামে আসেন। সেখানে এসে তিনি গঙ্গার তীরে সেই পর্ণকুঠিতে অবস্থিত হয়ে মহাপ্রভুকে দর্শন করেন। সেই সময় ধ্রুবানন্দ বয়সের ভারে শীর্ণ। তিনি প্রভু চৈতন্যদেব কাছে আবেদন করেন যে আমার যাওয়ার পালা হয়েছে। তাই এই মন্দিরের এমন একজনকে দিয়ে যান যিনি আমাদের এই প্রভুর সেবার ভার নেবেন। ধ্রুবানন্দের কথামতো চৈতন্যদেব তাঁর অন্যতম পার্শ্বচর কমলাকার পিপলাইকে মহেশের জগন্নাথ দেবের পুজো-অর্চনার ভার দেন। তারপর থেকে কমলা করের বংশধররাই মহেশের জগন্নাথ দেবের সেবাইতের কাজ করে আসছেন।
এরপর গঙ্গা তীরে যেখানে প্রভু জগন্নাথ, বলরামের যে মন্দিরটি ছিল তার থেকে প্রায় আধ কিলো মিটার দূরে ১১৪০ সালে মনোহর রায় নতুন একটি মন্দির নির্মাণ করে দেন এবং তিনি জগন্নাথ দেবের সেবার জন্য তার জমিদারির তালুক গ্রাম দান করেন সেটি জগন্নাথপুর গ্রাম নামে পরিচিত। তবে এখানকার ইটের আয়ু বেশিদিন স্থায়ী না হওয়ায় মনোহর রায়ের নির্মিত মন্দিরটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পরে ১২৬৫ সালে নিমাই চরণ মল্লিক পুরীর মন্দিরের আদলে বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করে দেন। ৭০ ফুট উঁচু এই মন্দিরের গর্ভগৃহে আজও বিরাজ করছেন ৬৩০ বছর ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী প্রতিষ্ঠিত প্রভু জগন্নাথ বলরাম এবং মা সুভদ্রার মূর্তি।
এখানকার জগন্নাথ দেবের মন্দিরের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার রথ অত্যন্ত সুপ্রসিদ্ধ। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা হিসাবে গণ্য হয় মহেশের রথ যাত্রা। এখন এটা একটা উৎসব। এই উপলক্ষে এক মাস ব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয় মন্দির সংলগ্ন স্নানপিড়ি ময়দানে। প্রথমে দুটি কাঠের রথ ছিল এখানে। সেই রথও কালের কবলে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এরপরই দেওয়ান কৃষ্ণরাম বসু বহু অর্থ ব্যয় করে একটি বড় লোহার রথ তৈরি করে দেন এবং সেই রথটি আজ পর্যন্ত রথযাত্রা উপলক্ষে প্রভু জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রাকে নিয়ে মাসির বাড়িতে যান।
মহেশের রথের সুখ্যাতি জগৎ বিখ্যাত। প্রতিবছর এই রথ উপলক্ষে কয়েক লক্ষ মানুষে এসে উপস্থিত হন মহেশ ধামে। মহেশধামে এই উপলক্ষে বসে এই রথের মেলা। যার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার কোনায় কোনায়। এই রথযাত্রা উপলক্ষে বহু মনীষীর পদধূলিতে ধন্য হয়েছে মাহেশের মাটি। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে আরও বহু মনীষী এসেছেন রথ উপলক্ষে কোনও না কোনও সময়।
বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারানি উপন্যাসে এই মাহেশের উল্লেখ আছে তাই পুরীর পর দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা উপলক্ষে হিসেবে খ্যাত মহেশের রথ। এবং বর্তমানে গত কয়েক বছর ধরে মন্দিরের সংস্কার হওয়ার পর বহু ভক্তের মানুষের আনাগোনা অনেক বেড়েছে মন্দিরে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বেশ কয়েকশো মানুষ এসে উপস্থিত হন মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি দেখতে। শুধু তাই নয় প্রতিবছর বৈশাখ, কার্তিক এবং মাঘ মাসে প্রভুর মঙ্গল আরতি হয় প্রত্যুষে। সেই মঙ্গল আরতি দেখতে আশপাশের বহু মানুষ মন্দিরে এসে প্রভুর দর্শন পান এবং আশীর্বাদ নেন।