
Truth Of Bengal: কাজল ব্যানার্জি: ছোট্ট বেলা থেকে শুনে আসছি সততার কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু এপর্যন্ত যা দেখলাম তাতে সৎ পথে থাকা মানুষগুলিই কিন্তু হারিয়ে যায়। দৈনন্দিন কিছু ঘটনাকে স্মরণ করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। যেমন, যে ভিক্ষুক মিথ্যাচার না করে সত্যি কথা বলে ভিক্ষার আবেদন করেন, তাঁদের আমরা ১ টাকা, ২ টাকা বা বড়জোর ৫ টাকা ভিক্ষা দিয়ে থাকি। কিন্তু যাঁরা কন্যাদায়, পিতৃদায়, চিকিৎসার নামে মিথ্যা কথা বলে আমাদের কাছে সাহায্য চান, তাঁদের আমরা ন্যূনতম ১০ টাকা দিয়ে থাকি। এছাড়া অনেক সময় তারও বেশি দিই। তাই যে সকল ভিক্ষুক ভাল মিথ্যা বলতে পারেন, অসততার আশ্রয় নিতে পারেন নির্দ্ধিধায় তাঁরাই কিন্তু লাভবান হন।
একই ভাবে, ট্রেনের হকারদের মধ্যে যিনি বাকপটু এবং মিথ্যার আশ্রয় নিতে সিদ্ধহস্ত তাঁর ভাষণ শুনে জিনিস বিক্রি হয় অনেক বেশি। অপরপক্ষে যিনি সততার সঙ্গে হকারি করেন, অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেন না, জিনিসের দ্রব্যমান সম্পর্কে অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন দিতে পারেন না, তাঁর বেচাকেনা কিন্তু অনেক কম। আদালতে বা ন্যায়ালয়ে যে উকিল অন্যায়ভাবে তাঁর মক্কেলের হয়ে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন তিনিই বিচারে জয়ী হন। অফিসে, স্কুলে যাঁরা তলে তলে ‘বস’-এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, তৈলমর্দন করেন, নানা সুযোগ সুবিধা তাঁরাই পেয়ে থাকেন। দ্রব্যের গুণমান ভাল হলেও মার্কেটিং-এ দক্ষতা না থাকলে ভাল দ্রব্যও বিক্রি হয় না। দুধ খাওয়া স্বাস্থ্যকর এবং মদ খাওয়া শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক হলেও দুধ অপেক্ষা অনেক বেশি মানুষ মদ্যপায়ী।
যাঁরা ‘নিজের ঢাক নিজে পেটাতে’ পারেন না অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা অন্তরালে চলে যান। যাঁরা ‘লাজলজ্জা ও নৈতিকতার মাথা খেয়ে’ নিজের স্বীকৃতির জন্য নিজে সরকারের কাছে আবেদন করতে পারেন তাঁদের মধ্যে থেকেই কাউকে রাজ্যস্তরের বা রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হয়। অন্যদিকে সততা, নৈতিকতা আঁকড়ে থাকা অনেক মহতী মানুষই কালের ইতিহাস থেকে হারিয়ে যান। তাঁদের মূল্যায়নই হয় না। তাঁদের কাজ মানুষের চোখের সামনেই উদ্ভাসিতই হয় না। রাজনীতিতেও অনেক সৎ ব্যক্তি পেছনের সারিতে চলে যান, কিন্তু আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজ অনেক ব্যক্তিই ওই সৎ রাজনীতিকদের মাথার ওপর বসে যান অক্লেশে। যিনি বয়স ভাঁড়ান, জাত ভাঁড়ান তিনি আরও বেশিদিন সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। যাঁরা অন্য দেশের নাগরিক, তাঁরা কাঁটাতার গলে এদেশে এলে প্রকৃত নাগরিকদের থেকে অনেক আগেই সমস্ত কাগজপত্র পেয়ে যান ঘুসের বিনিময়ে।
এদেশের ভূমিপূত্ররা চাকরি না পেয়ে ট্রেনে হকারি করতে বাধ্য হন। আর ভিনদেশ থেকে টাকার থলি নিয়ে আসা ব্যক্তিরা এদেশেরই সরকারি বিভাগের উচ্চপদে আসীন হন। অথবা অর্থের প্রাচুর্যে ব্যবসা-বাণিজ্যেও ভূমিপূত্রদের পরাজিত করে এবং সামাজিক অনুদানে সকলকে খুশি করে সমাজের বুকে রাজত্ব করেন। পুলিশের চাকরিতে যদি কেউ ঘুস খেতে না চান, তা হলে তাকেও ফাঁসিয়ে দিয়ে দলে আনাটাই নিয়ম। বেতার যন্ত্রের আবিষ্কারক হিসাবে জগদীশচন্দ্র বসুর পরিবর্তে বিজ্ঞানী মার্কনিই সিলমোহর পেয়ে যান চাতুর্যের দক্ষতায়। সার ও কীটনাশক দেওয়া ফসলই দেখতে সুন্দর হয় এবং বাজারেও বেশি কদর পায়। এমনকী শুধুমাত্র নিষ্ঠা, সততা বা নৈতিকতার কারণে আমরা কেউই কোনও ‘পাত্র’কে কন্যাদান করি না। অসৎ পথে হলেও যাঁর অর্থ বেশি সেই আমাদের প্রথম পছন্দের ‘পাত্র’ হয়ে দাঁড়ায়।
বছরের পর বছর চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে সৎ পথে পরীক্ষা দিয়ে ৯০ শতাংশ নম্বর পেয়েও চাকরি জোটে না। অপরপক্ষে চুক্তিমাফিক ‘সাদাখাতা’ জমা দেওয়া প্রার্থী চাকরি পেয়ে যান। সৎ লোক নিজের সৎ উপার্জনের টাকা ব্যাঙ্কে রেখে সামান্য সুদ পান। কিন্তু অসৎ লোকেরা বেআইনিভাবে বাজারে টাকা খাটিয়ে ক্রমাগত ধনী হতে থাকেন। অনলাইন পরীক্ষাতেও যে ছাত্রের বাবা বা মা উত্তর বলে দেন সেই বেশি নম্বর পায়। সৎ পথে নিজে পরীক্ষা দেওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা নম্বরে পিছিয়ে পড়ে। এ বছরের মাধ্যমিকেও যে সব স্কুল নিজেরা অন্যায়ভাবে, অসৎ পথে নম্বর বাড়িয়ে পাঠাবে তাঁদের ছাত্রছাত্রীরাই নৈতিকতা সম্পন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের থেকে অনেক বেশি নম্বর পাবে। খেলার মাঠেও ভাল খেলোয়াড়কে অন্যায় ভাবে, অসৎ ভাবে ল্যাং মেরে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে ম্যাচ জেতার উদাহরণ কম নেই।
ফলে স্পষ্টতই, জীবনযুদ্ধের সকল আঙিনায় অসৎ মানুষদের এই প্রশ্নাতীত সাফল্য স্বাভাবিক ভাবেই পরবর্তী প্রজন্মের মনের বিশুদ্ধতা, চরিত্রের শুভ্রতা বা নৈতিকতা বজায় রাখার পক্ষে নেতিবাচক দৃষ্ট্রান্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেই সূত্র ধরেই কিন্তু সমাজ ক্রমশ নিম্নগামী। কিন্তু এই অবনমনকে তো চলতে দেওয়া যায় না। আগামী প্রজন্মকে তো এইভাবে অসৎ পথে ঠেলে দেওয়া যায় না। তাই পরিশেষে বলি, গতানুগতিকতায় গা ভাসানো কোনও কাজের কথাই নয়। সাফল্য অধরা থাকুক বা বিলম্বিত হোক, জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে পড়া বা পরাজয় যাই ঘটুক, তবু আগামী প্রজন্মের সকলেই যেন জীবনে যতটা সম্ভব সৎ থাকার, সৎ পথে চলার এবং নিজের নৈতিক চরিত্র ঠিক রাখার চেষ্টা করেন। কারণ ‘স্বীকৃতি’ বা ‘সাফল্য’ না জুটলেও সৎপথে চলার একটা ভাল দিক কিন্তু চিরন্তন।
কবি মোহিত লাল মজুমদারের কবিতার লাইনকে এক্ষেত্রে অন্য আঙ্গিকে ব্যবহার করে বলতে পারি, “এত যে ভীষণ, তবু তারে হেরি ধরায় ধরে না হর্ষ / ওরি মাঝে আছে কাল-পুরুষের সুগভীর পরামর্শ।” নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সৎ পথে থাকলে কিন্তু জীবনে কখনও গ্লানি আসে না। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা আসে না। মনের জোরটা অসম্ভব বেড়ে যায়। নিজের সঙ্গে কখনও ‘চোর-পুলিশ’ খেলতে হয় না। জীবনের মধ্যে কোথাও যেন একটা স্বর্গীয় অনুভুতি বিরাজ করে আজীবন। শেষ জীবনে অপরাধবোধ তাড়া করে বেড়ায় না। ঘন ঘন পুজো-আচ্ছা, হজ ইত্যাদি করে পাপ খণ্ডাতেও হয় না। আমাদের জীবনের স্বল্প পরিসরে অসততার হাত ধরে প্রাচুর্য অর্জনের থেকে পরিচ্ছন্ন পথে জীবন যেন সরল ও সুন্দর অনুভুতিতে সুখময় ও মধুময় হয়– এটাই প্রার্থনা হোক।