
পরিবারের বড়দের সাথে খেলা, গল্প শোনা, প্রকৃতির সাথে সময় কাটানোই ছিল শৈশবের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখন সেই জায়গা নিয়েছে মোবাইলের রঙিন পর্দা। কার্টুন চালিয়ে বা গান শোনিয়ে বাচ্চাদের শান্ত রাখা যেন রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এর ফলাফলও স্পষ্ট—আস্তে আস্তে শিশুরা স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
স্মার্টফোন আসক্তির বর্তমান প্রেক্ষাপটে গবেষণা বলছে, শিশুরা অনায়াসেই আধুনিক স্মার্টফোন পরিচালনা করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে শহরাঞ্চলের শিশুদের মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অভিভাবকরা ব্যস্ততার কারণে শিশুদের শান্ত রাখতে সহজেই মোবাইল ফোনের শরণাপন্ন হন। এটি একটি সহজ সমাধান মনে হলেও, দীর্ঘমেয়াদে এর ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে।
শিশুরা মূলত মোবাইলে কার্টুন দেখা, গেম খেলা, ইউটিউব ব্রাউজিং, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াতে ভিডিও দেখা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। অভিভাবকরাও নিজেদের ব্যস্ত জীবনে সাময়িক স্বস্তি পেতে শিশুদের হাতে ফোন তুলে দেন। ফলে প্রযুক্তি আসক্তি দিন দিন জটিল আকার নিচ্ছে।
স্মার্টফোন আসক্তির কারণ গুলির মধ্যে উল্লেখইত বাবা-মায়ের পর্যাপ্ত সময় না দেওয়া, অভিভাবকদের ব্যস্ত জীবনযাপন শিশুদের একাকীত্বের দিকে ঠেলে দেয়।খেলার মাঠ ও সঙ্গী সাথির অভাব, শহুরে জীবনে খেলার মাঠ ক্রমশ কমে আসছে, শিশুদের জন্য উন্মুক্ত স্থান সঙ্কুচিত হচ্ছে।আকর্ষণীয় কনটেন্টের প্রভাব, কার্টুন, গেম, ইউটিউব ভিডিও শিশুদের মনকে সহজেই আকর্ষণ করে। সহজলভ্য ইন্টারনেট সংযোগ এবং স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা শিশুদের জন্য প্রযুক্তিকে আরও সহজ করে তোলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মোবাইল আসক্তি এক ধরনের মানসিক নির্ভরশীলতা, যা মাদকের আসক্তির মতোই বিপজ্জনক। কারণ ভার্চুয়াল বিনোদনের সময় ডোপামিন নিঃসরণ মস্তিষ্কে স্বল্পমেয়াদী সুখের অনুভূতি জাগায়, যা আসক্তির ভিত্তি গড়ে দেয়।শারীরিক প্রভাব অর্থাৎ শিশুদের মস্তিষ্ক বড়দের তুলনায় দ্বিগুণ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন শোষণ করে, যা টিউমারের আশঙ্কা বাড়ায়।
দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে ক্ষীণদৃষ্টি, চোখের যন্ত্রণা, মাথাব্যথার সমস্যা দেখা দেয়।রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস যেমন মোবাইলের মাধ্যমে সহজেই জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়।মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাজনিত কারন যেমন মেজাজের ওঠানামা, অমনোযোগিতা, ভাষার দক্ষতা বিকাশে বাধা এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা প্রায়শই দেখা যায়।
সামাজিক প্রভাব যেমন পরিবার ও সমাজের সঙ্গে সংযোগ কমে যায়। সৃজনশীলতা হ্রাস পায়, শিশুরা বাস্তব জীবনের পরিবর্তে ভার্চুয়াল জগতে ডুবে থাকে। সর্বোপরি সাইবার বুলিং, অনলাইনে প্রতারণা বা অশোভন কনটেন্টের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা এগুলিতো আছেই। তাহলে কি প্রতিরোধের উপায় নেই? অবশ্যই আছে। স্মার্টফোন আসক্তি প্রতিরোধে পরিবার, বিদ্যালয় এবং সমাজকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
বয়স অনুযায়ী নিয়ম মানতে হবে যেমন ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন না দেওয়াই সর্বোত্তম। প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট কাজের জন্য ব্যবহার করতে দিন। পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম যেমন সন্তানকে সময় দিন, তাদের সঙ্গে কথা বলুন, গল্প বলুন, বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। পারিবারিক আড্ডা, খেলাধুলা, এবং সৃজনশীল কাজে শিশুদের যুক্ত করুন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকাতো আছেই , বিদ্যালয়ে প্রযুক্তি ব্যবহারের নিয়মাবলী প্রণয়ন করা উচিত। শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ব্যবহারের সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন।
এবং নিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট ব্যবহার, শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সফটওয়্যার ব্যবহার করা যেতে পারে। সৃষ্টিশীল বিকল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছবি আঁকা, পাজল খেলা, সঙ্গীত, নাচ, খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুদের মনোযোগ অন্যদিকে সরানো যেতে পারে। নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন যেমন শিশুদের জন্য নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন যেমন খেলাধুলা, সাঁতার, সাইক্লিং ইত্যাদি অত্যন্ত উপকারী।
অভিভাবকদের মনে রাখুন , টেক-ফ্রি টাইম, প্রতিদিন অন্তত কয়েক ঘণ্টা ‘টেক-ফ্রি’ সময় রাখুন, যেখানে পরিবার একসাথে সময় কাটাবে কোনো ধরনের স্ক্রিন ছাড়া।রোল মডেল হওয়া, শিশুরা প্রায়শই অভিভাবকদের আচরণ অনুকরণ করে। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারে সংযম দেখান। অভিভাবক গন সন্তানদের সঙ্গে বয়সোপযোগী আলোচনা করুন শিশুদের সঙ্গে প্রযুক্তি, এর ভালো এবং খারাপ দিক নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করুন। এতে তারা প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন হবে।
প্রযুক্তি ব্যবহারের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্তে আনুন একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য হলো—প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে না, বরং আমাদেরই প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারই পারে শিশুদের জন্য একটি সুস্থ, সুন্দর শৈশব নিশ্চিত করতে। প্রযুক্তি আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শিশুর পাশাপাশি অভিভাবকদেরও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে।
শিশুদের শেখাতে হবে—প্রযুক্তি শুধু বিনোদনের জন্য নয়, জ্ঞান অর্জন, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি, এবং দক্ষতা বিকাশের মাধ্যমও। পরিবার, বিদ্যালয় এবং সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা একটি সুস্থ, সুরক্ষিত, এবং প্রযুক্তি-সচেতন প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারি। স্মার্টফোনের ফাঁদ থেকে শিশুদের মুক্ত রাখতে হলে আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শিখিয়ে আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য একটি সুন্দর, নিরাপদ, এবং আনন্দময় শৈশব নিশ্চিত করতে পারি। স্মার্টফোনের ফাঁদে বন্দি না হয়ে, তারা যেন প্রকৃতির সাথে, সমাজের সাথে, এবং নিজের সৃজনশীলতার সাথে সংযুক্ত থাকতে পারে, সেটাই হোক আমাদের লক্ষ্য। সবশেষে বলব রাজ চক্রবর্তী নির্দেশিত হাবজি গাবজি সিনেমাটা দেখুন বিপদ ঘটার আগে কি ভাবে সাবধান হতে হবে তার এক দলিল হাবজি গাবজি।