Shankaracharya: আধ্যাত্মা জগতের দীপ্তিমান সূর্য আদিগুরু শঙ্করাচার্য
দার্শনিক এই মতবাদকে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রথম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।
রাজু পারাল: জীবনের সর্বস্তরে যখন ধর্মের গ্লানি প্রকট হয়ে ওঠে, ধর্মের নামে যখন চলে আড়ম্ভরপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি, অন্যায়, অত্যাচার, ব্যাভিচার– সেই যুগসন্ধিক্ষণে আবির্ভাব ঘটে থাকে মহাপুরুষদের। আচার্য রূপে আপন কর্ম ও সাধনার দ্বারা অধর্মের গ্লানি দূর করে তাঁরা চিরন্তন সত্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ভারতবর্ষের এক যুগসঙ্কটকালে এরকমই একজন মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছিল। ভারতবর্ষের নিপীড়িত সমাজ বরণ করে নিয়েছিল তাঁকে। সেই যুগপুরুষের মূল কথা ছিল, ‘ব্রহ্মই সত্য, ব্রহ্ম ছাড়া সবকিছু মিথ্যা। ব্রহ্ম থেকেই সকল কিছুর উৎপত্তি, ব্রহ্মতেই অবলুপ্তি।’ দার্শনিক এই মতবাদকে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রথম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। সনাতন ধর্মের এই শ্রেষ্ঠ প্রচারক হলেন ‘শঙ্করাচার্য’। ছিলেন উপনিষদ তথা বেদান্ত দর্শনে বিশ্বাসী এক অন্যতম দার্শনিক।
শঙ্করাচার্যের আবির্ভাব ভারতবর্ষের দক্ষিণ পশ্চিম সমুদ্রের তীরে অবস্থিত কেরল রাজ্যে। প্রবাদ আছে, ভগবান পরশুরাম সমুদ্র গর্ভ থেকে স্থানটিকে টেনে তুলেছিলেন। এখানেই দশ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে ‘আলোয়াই’ নদীর উত্তর তীরে ‘কালাডি’ নামে একটি ছোট গ্রামে শঙ্কর জন্মেছিলেন। শঙ্করের পরিবার ছিল নাম্বুরি ব্রাহ্মণ। এঁরা নিষ্ঠাবান, সদাচারী বৈদিক। আর্যদের বৈদিক ধারা তাঁরা সর্বদাই মেনে চলতেন। শঙ্করের জন্মসাল নিয়ে মতভেদ থাকলেও অনেকের মতে তিনি জন্মেছিলেন ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে। চন্দ্রমৌলি শিবের অংশে অবতার যোগে জন্ম শঙ্করের। তাঁর পিতা শিবগুরু, মাতা বিশিষ্টা। উভয়েই ছিলেন দেবাদিদেব শিবের ভক্ত। কথিত আছে, স্বয়ং ভগবান শিবই এসেছিলেন মাতা বিশিষ্টার গর্ভে। তাই পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল ‘শঙ্কর’। শান্ত, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, শ্রুতিধর আর বিস্ময়কর স্মৃতি নিয়ে জন্মেছিলেন শঙ্কর। বাল্যকালেই তাঁর অসাধারণ মেধার পরিচয় পেয়ে সকলে বিস্মিত হতেন। পিতার কাছে বিদ্যারম্ভ করলেও তাঁর সান্নিধ্য বেশিদিন পাননি শঙ্কর। কারণ তিন বছর বয়সেই তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। তখন পুত্রের লালনপালনের দায়িত্ব বর্তায় মা বিশিষ্টাদেবীর কাঁধে। শঙ্করের পাঁচ বছরের উপনয়ন সমাপ্ত হলে ছেলেকে গুরুগৃহে পাঠান মা বিশিষ্টা। মাত্র দু’বছরেই বিভিন্ন শাস্ত্র অধ্যয়ন করে শঙ্কর অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হন।
শঙ্করের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ব্রহ্ম লাভ। কয়েকজন জ্যোতিষী তাঁর কোষ্ঠী বিচার করে জানিয়েছিলেন যে জাতক ভবিষ্যতে একজন শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ তথা শাস্ত্রবিদ হিসেবে পরিচিতি পেলেও তাঁর আয়ু বেশিদিন নয়। তখন থেকেই মায়ের স্নেহ-বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে চাইতেন শঙ্কর। বিভোর হয়ে থাকতেন এক ভাবরাজ্যে। সংসার ত্যাগের বাসনা মনে প্রভাব বিস্তার করলে মায়ের কাছে অনুমতি চান সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য। প্রথম দিকে বিশিষ্টা দেবী রাজি না হলেও পরে বিশেষ কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ছেলেকে সন্ন্যাস নিতে বলেন।
সন্ন্যাস নেওবার পর শঙ্কর সে যুগের শ্রেষ্ঠ যোগীবর গোবিন্দপাদের কাছে প্রায় তিন বছর ‘আত্মতত্ত্ব’ তথা ‘ব্রহ্মউপলব্ধি’র শিক্ষা নেন। পরে অবশ্য তিনি শিখেছিলেন আরও অনেক যোগক্রিয়া। সে কারণেই শঙ্করের জীবনে দেখতে পাওয়া যায় অতি প্রাকৃত-অলৌকিক ঘটনার সংঘটন।
গোবিন্দপাদের কাছে শিক্ষা সম্পূর্ণ হলে শঙ্কর তাঁর গুরুর নির্দেশ মতো কাশী বেনারসের দিকে যাত্রা শুরু করেন। কাশী হল জ্ঞানপীঠ। জ্ঞানের প্রভাতেই কাশীর প্রকাশ। জ্ঞানকাশীকে জানতে পারলে কাশীলাভ সম্ভব। শঙ্করের ব্যাখ্যায়, ‘জ্ঞানই ত্রিভুবনের জননী, গঙ্গাস্বরূপ, ভক্তি আর শ্রদ্ধাই হল গয়া, গুরুর চরণধ্যানই প্রয়াগ আর ব্রহ্মই বিস্বেশ্বর।’ বারো বছরের আচার্য শঙ্করের খ্যাতি প্রচারিত হতে লাগলো সমগ্র কাশীতে। আলোচনার আসরে জ্ঞানী-গুণী, সাধারণ ভক্তদের আগমন ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে লাগলো। পণ্ডিতদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে তাঁর মেধা, উপলব্ধি, অভিজ্ঞতার কাছে সকলেই নতি স্বীকার করে নিলেন। শঙ্কর হয়ে উঠলেন ‘শঙ্করাচার্য’। যেন তিনি সাক্ষাৎ বেদান্ত। যেন ব্রহ্ম দর্শন করে ব্রহ্মের কথা বলছেন। জীব আর শিব এক হয়ে গেছে সেখানে।
কাশীতে একবছর বাস করার পর শঙ্কর পরিব্রাজনে বের হন। প্রথমে উত্তরপথে নানা তীর্থ ভ্রমণ করে তিনি উপস্থিত হন হিমালয় পর্বতে ব্যাসদেবের পুণ্যাশ্রম বদ্রিকাশ্রমে। এখানে থাকাকালীন তিনি সংস্কৃত ভাষায় অসংখ্য গ্রন্থ ও বিভিন্ন ছন্দে স্তবস্তোত্রাদি প্রণয়ন করেন। এগুলির মধ্যে ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্রহ্মসুত্রভাষ্য, উপনিষদ ভাষ্য, গীতাভাষ্য, সর্ববেদান্ত সিদ্ধান্ত অন্যতম। বারো থেকে সতেরো বছর বয়সের মধ্যে শঙ্কর এইসকল জগৎ বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। শঙ্করের রচিত অন্যান্য গ্রন্থগুলি হল, সাধনপঞ্চক, আনন্দ লহরী, মণিরত্নমালা, বিবেকচূড়ামণি, আত্মবোধ, বেদসার, শিবস্তব, যতিপঞ্চক ইত্যাদি। শঙ্করের প্রণীত স্তবস্তোত্র শ্লোকের সংখ্যা প্রায় ৭৫টি।
শঙ্করাচার্য ভারতের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে চারটি মঠ স্থাপন করেছিলেন বেদান্ত ধর্মপ্রচারের জন্য। উত্তরে বদ্রীনাথ, দক্ষিণে শৃঙ্গেরী মঠ, পূর্বে পুরীধাম (গোবর্ধন মঠ) এবং পশ্চিমে দ্বারকা (সারদা মঠ)। শঙ্করাচার্য উল্লেখিত চারটি মঠের অধীনে আরো বহু মঠ স্থাপন করে সারা ভারতে বৈদিক ধর্মের প্রচারকার্য সুপ্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।





