সম্পাদকীয়

খেলাধুলা মানেই স্বাধীনতা— লিঙ্গ নয়, যোগ্যতাই হওয়া উচিত মাপকাঠি

টেলিভিশনে পুরুষদের ক্রিকেট ম্যাচ বা ফুটবল ম্যাচ প্রচারের তুলনায় নারীদের খেলাধুলো খুবই সীমিতভাবে দেখানো হয়।

অনন্যা ভট্টাচার্য: খেলাধুলো মানুষের জীবনের একটি অঙ্গ। এটি কেবল শরীরচর্চা নয়, বরং মানসিক বিকাশ, দলগত চেতনা, নেতৃত্বগুণ ও আত্মবিশ্বাস গঠনের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কিন্তু সমাজের নানা স্তরে এখনও খেলাধুলার ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য একটি গভীর সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে। নারী ও পুরুষ উভয়েই সমানভাবে সক্ষম হলেও, আমাদের সামাজিক মানসিকতা, সুযোগের অসাম্য এবং পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীরা প্রায়ই খেলাধুলোর জগতে পিছিয়ে পড়ে। এই বৈষম্যের মূল কারণ সমাজের গড়ে ওঠা দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে খেলাধুলোকে এখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘ছেলেদের বিষয়’ বলে ধরা হয়।

শৈশব থেকেই দেখা যায়, ছেলেদের খেলাধুলোয় উৎসাহ দেওয়া হয়— ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, অ্যাথলেটিক্স— সব কিছুতেই তাদের অংশগ্রহণ স্বাভাবিক ও কাম্য বলে মনে করা হয়। কিন্তু মেয়েরা যদি রোদে বেরিয়ে খেলতে চায়, তখনই সমাজের নানা প্রশ্ন ওঠে— ‘মেয়েরা এত রোদে খেলবে কেন?’, ‘পড়াশোনা না করে খেলাধুলো করলে ভবিষ্যৎ কী হবে?’— এইসব মানসিক বাধাই আসলে লিঙ্গ বৈষম্যের বীজ বপন করে। ফলে অনেক মেয়ে ছোটবেলা থেকেই নিজেদের ইচ্ছা দমিয়ে রাখে, তাদের প্রতিভা অঙ্কুরেই ঝরে যায়।

এদিকে, খেলাধুলোর জগতে নারীদের সাফল্যের গল্প কম নয়। পিটি উষা, মেরি কম, সাইনা নেহওয়াল, পিভি সিন্ধু, দীপিকা পাল্লিকরাম, মিতালি রাজ, হরমনপ্রীত কৌর— এদের প্রত্যেকেই প্রমাণ করেছেন যে দক্ষতা ও অধ্যবসায়ে নারীরা পুরুষের থেকে কোনও অংশে কম নয়। তবুও সমাজের মূলধারায় তারা প্রাপ্য মর্যাদা পান না। টেলিভিশনে পুরুষদের ক্রিকেট ম্যাচ বা ফুটবল ম্যাচ প্রচারের তুলনায় নারীদের খেলাধুলো খুবই সীমিতভাবে দেখানো হয়। বিজ্ঞাপন, স্পনসরশিপ ও মিডিয়া কভারেজ— সব ক্ষেত্রেই নারীরা পিছিয়ে। ফলে আর্থিক ও সামাজিক স্বীকৃতিতেও তৈরি হয় বৈষম্য।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও খেলাধুলোর ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য স্পষ্ট। অধিকাংশ স্কুলে ছেলেদের জন্য ফুটবল বা ক্রিকেটের আলাদা মাঠ থাকে, কিন্তু মেয়েদের জন্য হয়তো শুধু ক্যালিসথেনিক্স বা যোগব্যায়াম নির্ধারিত। শারীরিক শিক্ষকদের মধ্যেও পুরুষদের আধিক্য দেখা যায়, যার ফলে মেয়েদের অংশগ্রহণের পরিবেশও অনেক সময় তৈরি হয় না। অনেক বাবা-মা আবার মেয়েদের নিরাপত্তা, পোশাক, বা সামাজিক মন্তব্যের ভয়ে তাদের মাঠে নামতে দেন না। এই মানসিক শিকলই নারী খেলোয়াড়দের বিকাশে প্রধান বাধা।

তবে সময় পরিবর্তিত হচ্ছে। আজকের প্রজন্মে অনেক মেয়ে সাহসিকতার সঙ্গে মাঠে নামছে, নিজেদের দক্ষতা দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দেশের নাম উজ্জ্বল করছে। কিন্তু সেই সাফল্যের পেছনে লুকিয়ে থাকে অনবরত সংগ্রাম, সামাজিক চাপ, এবং মানসিক যন্ত্রণা। খেলাধুলোয় নারীদের সাফল্য প্রায়ই ‘নারী হয়েও এত কিছু করেছে’ এই মন্তব্যে সীমাবদ্ধ থাকে— যা আসলে এক প্রকার অবমূল্যায়ন। খেলাধুলো মানুষের ক্ষমতার পরীক্ষা, লিঙ্গের নয়— এই বোধ সমাজে এখনও পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি।

লিঙ্গবৈষম্য শুধু অংশগ্রহণ বা স্বীকৃতির ক্ষেত্রেই নয়, সুযোগ ও অবকাঠামোর ক্ষেত্রেও বিদ্যমান। অনেক দেশেই এখনো নারী খেলোয়াড়দের বেতন পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। কোচিং সুবিধা, চিকিৎসা সহায়তা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র— এসব ক্ষেত্রেও পার্থক্য স্পষ্ট। এমনকী কিছু খেলায় নারীদের অংশগ্রহণ এখনও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, যেমন বক্সিং বা রেসলিং। অথচ এই খেলাগুলিতেই ভারতীয় নারীরা অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছেন।

লিঙ্গ বৈষম্যের মূল শিকড় আমাদের সমাজব্যবস্থার মধ্যে নিহিত। ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের শেখানো হয় ‘তুমি শক্তিশালী’, আর মেয়েদের শেখানো হয় ‘তুমি ভদ্র হও’। এই ধাঁচ থেকে বেরিয়ে না আসলে খেলাধুলোয় নারীদের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হবেই। স্কুল পর্যায় থেকেই মেয়েদের সমানভাবে খেলাধুলোয় উৎসাহিত করা উচিত। তাদের জন্য আলাদা সুযোগ, সুরক্ষিত অবকাঠামো, নারী প্রশিক্ষক ও পরামর্শদাতা নিয়োগ করা প্রয়োজন।

সরকারের উদ্যোগেও এই বৈষম্য কমানো সম্ভব। নারী খেলোয়াড়দের জন্য আলাদা বৃত্তি, প্রশিক্ষণ প্রকল্প, এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতার সুযোগ তৈরি করা গেলে সমাজের মানসিকতা বদলাতে শুরু করবে। মিডিয়াকেও এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে— নারী খেলোয়াড়দের কৃতিত্ব নিয়মিত প্রচার করলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে পাল্টাবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, পরিবার ও সমাজের মানসিক পরিবর্তন। মেয়েদের খেলাধুলোর ইচ্ছাকে শ্রদ্ধা করা, তাদের সিদ্ধান্তে আস্থা রাখা এবং ব্যর্থতাকে গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে তোলা জরুরি। একমাত্র তখনই সত্যিকারের সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে। খেলাধুলো শুধু প্রতিযোগিতা নয়— এটি সমতার, স্বাধীনতার, এবং আত্মমর্যাদার প্রতীক।

শেষ কথা, লিঙ্গবৈষম্য দূর হলে খেলাধুলো হবে সবার। মাঠে তখন থাকবে না ছেলে-মেয়ে বিভাজন, থাকবে শুধু প্রতিভা, অধ্যবসায় আর দেশপ্রেম। এক সেই দিনই হবে প্রকৃত অর্থে খেলার উৎসব— যেখানে প্রতিটি শিশু, প্রতিটি তরুণ, প্রতিটি নারী পুরুষ নিজেদের সীমা ভেঙে বলতে পারবে— ‘খেলা আমার অধিকার, আমার স্বাধীনতা।’