ফিচার

মমতা বিরোধিতা ছাড়া বামেদের আর আছে কী?

What else does the Left have besides opposing Mamata?

Truth Of Bengal: সৈয়দ তানভীর নাসরীন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফুরফুরা শরিফের ত্বহা সিদ্দিকির কাছে পৌঁছনোর কিছুক্ষণ আগে ওই একই ধর্মস্থানে আব্বাস সিদ্দিকির কাছে কংগ্রেস এবং সিপিএম নেতৃত্বের পৌঁছে যাওয়া এবং ইফতারে অংশগ্রহণ করা দেখে যতটা মজা পেয়েছিলাম, তার চাইতে বেশি মজা পেলাম সোশ্যাল মিডিয়ায় বামেদের নতুন আইনজীবী নেতার সগর্ব ঘোষণা দেখে।

এটা ভাল লাগল, যে শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলতে অভ্যস্ত বামেরা অন্তত মুসলিমদের ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’-এর সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করার মরিয়া প্রয়াস করছে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় সগর্ব ঘোষণা দিয়ে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সংখ্যালঘু মন জেতায় টক্কর দেওয়া যাবে? মনে হচ্ছিল, শুধুমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতাই বোধহয় আজকে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সেই কারণেই মুখ্যমন্ত্রী অক্সফোর্ডে আমন্ত্রণ পেয়েছেন কিনা, পেয়ে থাকলে তিনি অক্সফোর্ডের অধীনে কোন কলেজে বলছেন, সেইসব নিয়ে এত চুলচেরা বিশ্লেষণে সিপিএমের নেতাকর্মীরা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন না। আমরা সিপিএমের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করি, আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে বামেদের কোন ভূমিকা নেওয়া উচিত, সেটা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে যদি সিপিএমের নেতাকর্মীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় তৃণমূল নেত্রীকে আক্রমণই একমাত্র কাজ বলে মনে করেন, তাহলে তা শুধু লজ্জাজনক নয়, ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য বিপদও বটে।

ঠিক যেদিন নাগপুরে ঔরঙ্গজেবের সমাধি আক্রমণের গুজব এবং তাকে কেন্দ্র করে তীব্র সাম্প্রদায়িক অশান্তি দেখা দিচ্ছে, সেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করাই যদি এ রাজ্যের বামপন্থীদের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তা শুধু চিন্তাজনক নয়, রাজনীতির পক্ষে গভীর উদ্বেগজনক।

শুভেন্দু অধিকারীর চরম সাম্প্রদায়িক মন্তব্যের পর বিমান বসু বামফ্রন্টের তরফে একটি লিখিত বিবৃতি পাঠিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলেছেন। কিন্তু বামপন্থী ছাত্র-যুবদের আমি মিছিল করতে দেখি। আমি অবশ্য বামপন্থী ছাত্র-যুবদের আজকাল আর প্যালেস্টাইনের প্রতিবাদে আমেরিকান সেন্টারের সামনে মিছিল নিয়ে যেতে দেখি না। কিংবা গোটা দুনিয়া জুড়ে আমেরিকার ভুল নীতির জন্য যেসব বিপর্যয় হচ্ছে, সেই নিয়েও মার্কিন দূতাবাসের সামনে কোনও বিক্ষোভ দেখানোর পরিকল্পনা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ও তাদের কচিকাঁচা ছাত্রনেতাদের আছে বলে মনে হয় না।

তাদের যাবতীয় লক্ষ্য এবং যাবতীয় কর্ম সকাল থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভুল ধরা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী কবিতা লিখেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসতর্ক মুহূর্তে কোন শব্দ মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে— এইসব নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে মিম তৈরি করতেই কাটে।

সিপিএম লক্ষ্যও করছে নাযে, এইসব করতে করতে ২০১৬ থেকে এই ২০২৫-এ আসতে আসতে, অর্থাৎ মাত্র ৯ বছরের মধ্যে তাদের ভোট শতাংশ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, বিধানসভা এবং লোকসভায় কেন তারা শূন্য হয়ে গিয়েছে! পৃথিবীর যে কোনও দলে, ক্রিকেট বা ফুটবল দলে তো বটেই, কর্পোরেট জগতেও একটা পারফরম্যান্স অডিট হয়।

নিজেদের পারফরম্যান্সের জন্য কী ওঠানামা করছে, তা দেখা হয়। সিপিএম বোধহয় সোশ্যাল মিডিয়ায় মিম বানাতে বানাতে ভুলেই গিয়েছে, যে আমজনতা তাদের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করছে? তাদের পারফরম্যান্স অডিট কেন ক্রমশ তলানির দিকে যাচ্ছে?

এই রাজ্যের বাম এবং অতি বামরা ‘বিপ্লব’ এবং ‘অতি বিপ্লব’-এ বিশ্বাস করে। সেই ‘বিপ্লব’ এবং ‘অতি বিপ্লব’-এর জায়গা থেকে তারা বাংলাদেশ নিয়ে তীব্র উত্তেজিত ছিল, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের উত্তেজনা দেখে মনে হচ্ছিল সবাই যেন লিখে রাখতে চায়, ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন।’

বাংলাদেশে বিপ্লব যে শেষ পর্যন্ত মৌলবাদের হাত ধরে হচ্ছিল, সেকথা হয়তো এই রাজ্যের বাম এবং অতি বাম ও সোশ্যাল মিডিয়ার ‘অতি বিপ্লবী’রা দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছে। তাই আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের আর তেমন উচ্ছ্বাস আর দেখি না।

আরজি কর এবং যাদবপুর নিয়ে নিয়ত ভুল তথ্য প্রচার করে নিজেদের হাস্যস্পদ করার পরেও সম্ভবত আলিমুদ্দিন স্ট্রিট নিজেদের ‘কোর্স কারেকশন’-এর পথে হাঁটেনি। হাঁটেনি বলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদেশ যাত্রা নিয়ে তাদের এত উষ্মা, সোশ্যাল মিডিয়ায় এত উত্তেজনা এবং সিপিএমের মুখপত্রে হেডলাইন স্টোরি।

সিপিএম এটা বুঝতে পারে নাযে, ১৪ বছরের তৃণমূল শাসনের পেছনে একটা ইতিহাস আছে, যে ইতিহাসে ৩৪ বছর বামেদের শাসন ছিল। যাদের বয়স ৩০-এর বেশি, তাদের বামেদের শাসনের কথা মনে আছে। যাদের বয়স ৪০-এর বেশি, তাদের জ্যোতি বসু আর সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বছর বছর বিদেশ যাওয়া আর বিভিন্ন মৌ-স্বাক্ষরের ইতিহাসও মনে আছে।

যাদের আর একটু বয়স বেশি, ৫০-এর বেশি, তাদের বিজন সেতুর ওপরে আনন্দমার্গীদের পুড়িয়ে মারার ঘটনাও স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। আমি বর্ধমানের মানুষ, সাঁইবাড়ির কথা না হয় নাই-বা তুললাম। সিপিএম যদি মনে করে এফআইআর-এ নাম পরিবর্তন করে দিলে সব স্মৃতি ফিকে হয়ে যায়, তাহলে ভুল করছে। আসলে মানুষ কিছুই ভুলে যায়নি।

আবারও বলছি যাদের বয়স ৩০, ৪০ কিংবা ৫০-এর উপরে, তাদের সিপিএম সম্পর্কে সব স্মৃতি টাটকা। কীভাবে কম্পিউটার বসানোর বিরোধিতা করেছিল বামেরা, কীভাবে বাগবাজারের স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে রাস্তার উপর কম্পিউটার নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সিপিএমের কর্মী-সমর্থকরা তা কেউ ভুলে যায়নি।

মুশকিলের বিষয়, তৃণমূলের ১৪ বছরের শাসনে বামেরা মনে করছে তাদের অতীতের সব পাপ মুছে গিয়েছে, জ্যোতি বসু আর সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় কতবার বিদেশে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে কত শিল্পোন্নত রাজ্য করে গিয়েছিলেন, তা আমরা সবাই ভুলে গিয়েছি! এবং সেই কারণেই নতুন বিক্রমে ও অতি উৎসাহে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণে নেমে পড়েছে।

ব্রাত্য বসুর বিখ্যাত নাটক ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’-এর ওই চরিত্রটার মতো আমার মনে হয় সিপিএমের সবাই হঠাৎ করে দীর্ঘ ঘুম থেকে জেগে উঠে চারপাশ দেখে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাসই করতে চাইছে না যে তাদের হাতে আর ক্ষমতা নেই বা চারপাশের সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় কী কী বদল ঘটে গিয়েছে।

তাই যাদবপুর নিয়ে ভুল ন্যারেটিভ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কুৎসা আর তাঁর বিদেশযাত্রা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিম তৈরি করা ছাড়া বৃহত্তর রাজনীতি, দেশের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই কিংবা বেকারি বা কর্মসংস্থানের প্রশ্নে বিজেপিকে বেঁধা— এই সব কিছুই বোধহয় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট এবং তাকেই মক্কা মনে করা কমরেডরা ভুলে গিয়েছে। তারা  বুঝতেই পারছে না যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন, রাজ্যের দাবিদাওয়া আদায়ে সরব হচ্ছেন, তখন তারা কোথায় দাঁড়িয়ে?

কেন নরেন্দ্র মোদির আমলে চাকরি হচ্ছে না, কেন কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাচ্ছে সেই নিয়ে বা, ছাত্র যুবদের আন্দোলনই বা কোথায় বা সামাজিক পরিসরে প্রচারের চেষ্টাই বা কোথায়? সিপিএম যদি মনে করে, যে তাদের একমাত্র কাজ মমতা বিরোধিতা, তাহলে তারা বিজেপির সঙ্গে একই ব্র্যাকেটে পড়ে যাবে।

এটা দুর্ভাগ্যের বিষয়, যে পশ্চিমবঙ্গে বামেদের ভোটই রামে গিয়েছে। শুধুমাত্র তীব্র মমতা বিরোধিতার কারণেই যারা একসময় স্ট্যালিন বা লেনিনের নামে স্লোগান দিত, তারা এখন ‘জয় শ্রীরাম’ বলে। চে গুয়েভ্যারার ট্যাটুকে পাঞ্জাবিতে আড়াল করে বামেদের যুবনেতা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে বিজেপির বিধায়ক হন। তাও মেনে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুধুমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা দিয়ে কি নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে টিঁকিয়ে রাখা যাবে?

Related Articles