রঘু ডাকাতের আরাধ্যা এই কালী, এই স্থানেই পড়েছিল সতীর ঠোঁট, জানুন বিস্তারিত
This is Kali, the worshipper of Raghu the robber, this is the place where Sati's lips fell, know the details

Truth Of Bengal: মনিরুল ইসলাম, পূর্ব বর্ধমান: এই গ্রামের শেষ ভাগে রয়েছে অট্টহাস সতীপীঠ। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, এই স্থানে পড়েছিল সতীর ঠোঁট। যে কারণে এই স্থানকে সতীপীঠ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ঈশানী নদীর বাঁকে জঙ্গল ঘেরা এই অট্টহাস মন্দিরে দেবী পূজিতা হন মহিষমর্দিনী রূপে। মন্দিরের সেবকের কথায় এখানে দেবী স্বয়ংভু। তাই এই মন্দিরের সঠিক বয়স বলা যায় না। জঙ্গলাকীর্ণ, নিরিবিলি এই স্থানে দেবীর মূল মন্দির ছাড়াও রয়েছে নাট মন্দির, কালীমন্দির এবং পঞ্চমুণ্ডির আসন। প্রতিবছর দোল পূর্ণিমার সময় মহাপুজো অনুষ্ঠিত হয় এই মন্দির চত্বরে।
পুরাণ মতে, মহাদেব শিবের প্রথমা স্ত্রী সতী স্বামী নিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ করেন। ওদিকে স্ত্রীকে হারিয়ে মহাদেব শুরু করেন ধ্বংসের নৃত্য তাণ্ডব। সেই অবস্থায় মহাদেবের ক্রোধ থেকে মহাবিশ্বকে রক্ষা করতে ও মহাদেবের সম্বিৎ ফেরাতে ভগবান বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র নিক্ষেপ করে দেবী সতীর দেহকে ৫১ খণ্ড করে দেন। সতীর দেহের ৫১টি খন্ড ভূপৃষ্ঠের ৫১টি স্থানে পড়ে। সেই সকল জায়গায় গড়ে ওঠে সতীপিঠ। এমনই এক সতীপিঠ বা শক্তিপিঠ রয়েছে পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রাম সংলগ্ন দক্ষিণডিহি গ্রামে পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার মহাকুমার কেতুগ্রামের অট্টহাসের সতীপীঠে রঘু ডাকাতের আরাধ্য মাকালী আজও পূজিত হয় মহা ধূমধামে।
নতুন করে কালী মূর্তি তৈরি করা না হলেও একটি প্রস্তর কালী মূর্তিতে তন্ত্রাচারে পুজো করা হয়। কালিকা তন্ত্র অনুসারে এই সতীপীঠ তন্ত্র সাধকদের সাধন স্থল হিসাবে বেশি স্বীকৃত। করোনা কালে কালী পুজো হলেও মন্দির কতৃপক্ষ বলিদান সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েছে ভক্তদের দল। মহাভোগ যোগে কালী মন্ত্রে দেবী পূজিত হন এখানকার দেবী। কিছুদিন আগেও দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকার ডাকাতদলের সর্দাররা গভীর রাতে অট্টহাসের ঘন জঙ্গলে তাদের আরাধ্য দেবী মাকালীর পুজো দিত বলে শোনা যায়।
কথিত আছে প্রায় দুশো বছর আগে রঘু ডাকাত নদীয়া থেকে ব্রিটিশ পুলিশের তাড়া খেয়ে কেতুগ্রামের অট্টহাসের জঙ্গলে ডেরা বেঁধেছিল। বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান নদিয়া অবাধে লুটপাট চালাত রঘু । এমনকী স্থানীয় ইতিহাস থেকে জানা যায়, চিঠি দিয়ে ডাকাতি করতে যাবার আগে রঘু ডাকাত অট্টহাস জঙ্গলে মা কালীর পুজো করে রওনা দিত। ব্রিটিশ শাসন কালে রঘু তার দল-বল নিয়ে ঈশাণী নদীর তীরে এই জঙ্গলে বছর সাতেক আস্তানা করে ছিল।
অট্টহাস মূলত সতীপীঠ, এখানে দেবীর অধরোষ্ঠ পড়েছিল। এই সতীপীঠে দেবীর পাষাণ মূর্তির উপর মহিষমর্দিনীর প্রস্তর মূর্তি রেখে নিত্য সেবা করা হয়।
সতীপীঠ সূত্রে জানা যায় সাধক বামাক্ষ্যাপা,মোক্ষদা, গিরীশ ঘোষ এই সতীপীঠে থাকা পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে তন্ত্র সাধনা করেছেন। অট্টহাসের প্রায় তিরিশ একর ঘনজঙ্গলে মধ্যেই থাকা কালীর প্রস্তর মূর্তিকে ঘিরে আজও ভক্তেরা মহাসমারোহে কালীর আরাধনা করেন । অট্টহাসের কালী পুজোয় স্থানীয় বাসিন্দা থেকে প্রশাসনে সকলেই অংশ গ্রহন করেন। জনশ্রুতি আছে এক সময় অট্টহাসের মা কালীকে তুষ্ট করতে রঘু ডাকাত নরবলি দিত। যদিও পরে মা কালীর আদেশেই তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয় বলে জনশ্রুতি আছে। এখন তো মন্দির কতৃপক্ষ পশুবলিও বন্ধের নির্দেশ জারি করেছেন। তবে মন্দিরে হাড়িকাঠ আজও আছে।
রঘু ডাকাত আজ আর নেই কিন্তু অট্টহাসের রঘুর সেই আরাধ্য দেবী মা কালীর পুজোর জৌলুস কমে নি কঙ্কালসার চেহারা। ফুটে উঠেছে বুকের পাঁজর। কান দুটি শরীরের তুলনায় বেশ বড়। বিস্ফারিত গোলাকার চোখ। আঁচড়ানো চুল পিঠের উপর পড়েছে। মুখগহ্বর থেকে বেরিয়ে রয়েছে কুকুরের মতো দুটি তীক্ষ্ণ দাঁত। মুখে হিংস্রতার ছাপ। বাম হাত মাটিতে ভর দিয়ে আর ডান হাত হাঁটুতে রেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে আছেন দেবী। পাথরের উপর খোদাই করা হয়েছে এই সোওয়া এক ফুটের দন্তুরা চামুণ্ডার মূর্তি। শোনা যায় ওই মূর্তির চোখের ওপর কেউ বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারতেন না। এই কারণে কেতুগ্রামের অট্টহাসে আজও প্রকাশ্যে আনা হয় না দেবীর আসল রূপ। অন্তরালেই থাকেন অট্টহাসের দেবী দন্তুরা চামুণ্ডা। মূর্তির একটি আলোকচিত্র মহিষমর্দিনী মূর্তির পাশে রেখে পুজো করা হয়।