নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়: বিশ্বের বৃহত্তম জ্ঞান-কোষাগার
Nalanda University: The world's largest knowledge repository

Truth Of Bengal: রাজু পারাল: শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। যুগ যুগ ধরে এখানকার শিক্ষা-দীক্ষার আলোকবর্তিতা বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। সম্ভবত গুপ্ত রাজাদের আমলে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে আজকের বিহার রাজ্যে নালন্দা বৌদ্ধবিহার তৈরি হয়েছিল। গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের পর বৌদ্ধধর্ম ও মতবাদের যাত্রা শুরু হয়। গৌতম বুদ্ধ ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র হিসেবে বিহারগুলিকে বেছে নিয়েছিলেন। কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক অনুশীলন বা ধ্যান যোগই নয়, মানবজীবনের সকল গুণাবলি অর্জনের জন্য তিনি প্রাধান্য দিয়েছিলেন বৌদ্ধবিহারগুলিকে। কালক্রমে এই সব বিহার, সংঘ, মঠগুলি এক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়, যার মধ্যে নালন্দা অন্যতম।
বর্তমানে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। কালে কালে সমগ্র এশিয়ায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব ছড়িয়ে পড়ছে। মহারাজা প্রথম কুমারগুপ্ত ৬ জন রাজার সাহায্যে ৬টি বিহারকে সংযুক্ত করে ভারতে প্রথম এই জ্ঞানদানের বিহারটি গড়ে তোলেন। প্রায় ১৪ হেক্টর জমির ওপর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির কৃতিত্ব তাঁরই। স্থানীয় রাজা এবং জমির মালিকরা ছাড়াও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহায্যে করতেন ইন্দোনেশিয়ার শৈল রাজবংশের রাজারাও। ভারত ছাড়াও চিন, জাপান, তিব্বত, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, ব্যাবিলন, আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও মধ্য এশিয়ার অনেক দেশের মেধাবী ছাত্ররা আসতেন এখানে বিনা খরচে অধ্যয়ন করতে। সঙ্গে মিলতো খাবার, জামাকাপড় এবং ওষুধপত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০টি শ্রেণিকক্ষের ২০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য নিযুক্ত ছিলেন ২ হাজার অধ্যাপক। আর্যভট্ট, নাগার্জুন, অতীশ দীপঙ্কর, শীলভদ্র, ইত সিং, ধর্মপাল, চন্দ্রপাল, গুনমতি, জীনমিত্র, ধর্মকীর্তি, পদ্মসম্ভব, শান্তিরক্ষিত প্রমুখ পণ্ডিতেরা আন্তরিকতার সঙ্গে শিক্ষাদান করতেন এই মহাবিহারে। নালন্দা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের গবেষণা ও চর্চার জন্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখানে পড়ানো হতো নানা বিষয়। বৈচিত্র্যের দিক থেকে যা ছিল সত্যিই অভিনব। বেদ, দর্শন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা, ভাষাতত্ত্ব, ব্যাকরণ সহ আরও নানা বিষয়। মহাযান বৌদ্ধমত চর্চার একটি বড় কেন্দ্র হিসেবে নালন্দার খ্যাতি তখন সারা বিশ্ব জুড়ে।স্বয়ং হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায়, তাঁর আমলে সর্বশ্রেষ্ট পণ্ডিত ছিলেন শীলভদ্র। শীলভদ্রের কাছে শিক্ষা লাভ করে তাঁর শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে, সুদূর চিন থেকে আসা তাঁর সার্থক হয়েছে।
হর্ষবর্ধনের সময়কালে (আনুমানিক ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে) হিউয়েন সাঙ ‘বৌদ্ধ ধর্ম’ ও ‘যোগশাস্ত্র’ অধ্যয়নের জন্যে নালন্দায় আসেন। তিনি আচার্য মহাস্থবির শীলভদ্রের অধীনে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে বৌদ্ধশাস্ত্র, সংস্কৃত, তর্কশাস্ত্র এবং ব্যাকরণ ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানলাভ করেন। মহাস্থবির শীলভদ্র নালন্দা মহাবিহারে কুড়ি বছরের বেশি প্রধান আচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। শীলভদ্রের পাণ্ডিত্যের গুণপনা ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ থেকে দেশান্তরে। পরবর্তীকালে হিউয়েন সাঙ তাঁর এই শিক্ষকের ভূয়সী প্রশংসা করে গিয়েছেন তাঁর রচিত লেখায়।
নালন্দা মহাবিহারের ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায় একস্তূপের কথা। যেটি বুদ্ধের প্রিয় শিষ্য সারিপুত্রের। এটা নালন্দার সবচাইতে প্রাচীন স্থাপত্য। এই স্তূপের কাছেই রয়েছে সোপানযুক্ত আর একটি স্থাপত্য যেটি নবমতল বিশিষ্ট একটি গ্রন্থাগার ভবন। গ্রন্থাগারটির নাম ‘ধর্মযজ্ঞ’। এই গ্রন্থাগারে আনুমানিক লক্ষাধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হতে থাকলে নালন্দারগুরুত্ব আস্তে আস্তে কমতে থাকে। বহু শিলালেখ ও সাহিত্যিক উপাদান থেকে জানা যায়, পাল রাজারা নালন্দার পৃষ্ঠপোষকতা করলেও সে সময়ে নালন্দার আদলে সোমপুরী, ওদন্তপুরী ও বিক্রমশীলা মহাবিহারগুলি গড়ে ওঠায় নালন্দার গুরুত্ব অনেকাংশে কমতে থাকে। দ্বাদশ শতাব্দীতে তুর্কি সেনাবাহিনীর আক্রমণে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হতে থাকে। ধ্বংসের পর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বিস্মৃতির অতলে চলে গেলেও ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখনওআছে।