কলকাতা

প্রাচীন কলকাতার ঐতিহ্য হাতে টানা রিকশার অজানা কাহিনী

The unknown story of the hand-pulled rickshaw, a tradition of ancient Kolkata

Truth of Bengal: আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে হাতে টানা রিকশা হল মধ্যযুগীয় শ্রেণীবৈষম্যের চূড়ান্ত উদাহরণ। একথা আজ অনেকেই বলে থাকেন। তবুও অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেনি এখনো। কলকাতার বহু রাস্তা তে আজও দেখা যায় এই হাতে টানা রিকশা। যাত্রীকে রিকশায় বসিয়ে মানুষ টেনে নিয়ে চলেছেন। কলকাতার ঘিঞ্জি পথে বা ব্যস্ততম রাস্তায় মানুষ ছুটছেন রিকশা নিয়ে যাত্রীকে সওয়ারী করে।

মানুষের টেনে নিয়ে যাওয়া কতটা নৈতিক কতটা অনৈতিক সেই বিতর্কে আজ যাচ্ছি না। বরং আমরা দেখি যে এই হাতে টানা রিকশা এল কিভাবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন রিকশা কথাটা কিন্তু আদতে জাপানীজ। পুরো কথাটা হল ‘জিন-রিকি-শ’। ‘জিন’ মানে মানুষ, ‘রিকি’ মানে শক্তি বা ক্ষমতা আর ‘শ’ মানে গাড়ি। অর্থাৎ, মানুষের শক্তিতে চলা বা টেনে নিয়ে যাওয়া গাড়ি।

পুরনো দিনের কলকাতা শহরের বিজ্ঞাপন দেখলে কিন্তু এই নামটাই পাবেন। আস্তে আস্তে ছোট হয়ে দাঁড়িয়েছে রিকশা। কলকাতার ঐতিহ্যের সঙ্গে একাকার হয়ে রয়েছে এই হাতে টানা রিকশা। প্রাচীন কলকাতার ঐতিহ্য বোঝাতে এই যানের বিকল্প নেই। যে ঐতিহ্য আজও বৈঠকখানা রোড কিংবা শিয়ালদা স্টেশনের সামনে দেখতে পাবেন। আজও দেখা যায় বড়বাজার বা গড়িয়াহাটে।

রিকশা কথাটা যেহেতু জাপানীজ তাই জন্মও যে জাপানে তা আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৮৬৯ এ জাপানে চালু হওয়ার পর চীনের সাংহাই ঘুরে রিকশা পদার্পণ করে ভারতে। মনে করা হয় ১৮৮০ সাল নাগাদ। কলকাতার ঐতিহ্যের সঙ্গে হাতে টানা রিকশার গভীর সম্পর্ক তৈরি হলেও ভারতে প্রথম এই রিকশা কিন্তু কলকাতায় চালু হয়নি। প্রথম আবির্ভাব সিমলায়। রেভারেন্ড ফোরডাইস্‌ এর হাত ধরে।

এই সব রিকশার চাকা ছিল লোহার। তাই মোটামুটি ৯ ফুট/৪ ফুট মাপের, গড়ে ১৪০ কিলোগ্রাম ওজনের এই গাড়ীগুলিতে চড়ার অভিজ্ঞতা যে খুব একটা সুখকর হত না তা বলাই বাহুল্য। ১৮৯৮ নাগাদ রবারের টায়ার আসার পর বোধহয় অবস্থার একটু উন্নতি হয়। এদিকে সিমলা পুরসভা ১৯০৪ এ রিকশার লাইসেন্স্ বাধ্যতামূলক করে দেয়। তবে এর মধ্যে কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছে এই হাতে টানা রিকশা।

তখন ভারতের রাজধানী কলকাতা। সব সময় ঘোড়ায় টানা গাড়িতে করে গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। ইংরেজ সাহেবদের হাত ধরে কলকাতায় আগমন হাতে টানা রিকশার। সাহেবরা শহরের এখানে ওখানে যেতে এই হাতে টানা রিকশায় চেপে বসতেন। তবে প্রথম কলকাতায় কাদের হাত ধরে এই হাতে টানা রিকশা এসেছে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেক ইতিহাসবিদ বলে থাকেন ইংরেজরা নিজেদের সুবিধার জন্য এই হাতে টানা রিকশা চালু করেছিলেন।

সিমলা থেকে এদের কলকাতায় আনা হয়। তবে ভিন্নমত রয়েছে। বিংশ শতকের একদম শুরুতেই শহরের কয়েকজন চিনা বাসিন্দা তাদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য আমদানি করে এই গাড়ী। পরে যদিও এরাই রিকশাকে ভাড়া দিতে শুরু করেছিল। কিন্তু ১৯২০ এর মধ্যে রিকশা হয়ে যায় ভারতীয় এবং কলকাতার পরিবহণ ব্যবস্থার অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। দু’ধরনের রিকশা চলত সেই সময়ের কলকাতায়। একজনের বসবার এবং দু’জনের বসবার।

দূরত্ব বা সময়ের হিসেবে, মাইল বা ঘণ্টা প্রতি ৩ অথবা ১.৫ আনা ভাড়া দিয়ে চড়া যেত এই তথাকথিত ‘শ্রেণীবৈষম্যের প্রতীক-এ। আজও প্রবল বৃষ্টিতে আমহার্স্ট স্ট্রিট বা ঠনঠনিয়ার বুক সমান জল জমলে এই রিকশাই হয়ে যায় একমাত্র ভরসা। তখন শ্রেণীবৈষম্যের তর্ক ভুলে, বেশি টাকা দিয়েও এই রিক্সায় চেপে বসে অনেকেই। পাশাপাশি বর্তমানে মাল বহন করার কাজেও ব্যবহার করা হয়। ঐতিহ্য বেঁচে আছে মহানগরীতে হাতে টানা রিকশার হাত ধরে।

Related Articles