মানুষের মতোই শিস দিয়ে শাবকের সঙ্গে কথা বলে শুশুকরা, শুশুকদের রক্ষা করতে উদ্যোগী রাজ্য
Dolphin Mitra

The Truth of Bengal, Mou Basu: ডলফিন বা শুশুকরা হল মানুষের বন্ধু। মানুষের চেয়েও বেশি বুদ্ধিমান এই শুশুক বা ডলফিনরা। মানুষের যেমন নাম থাকে যা দিয়ে আমরা একে অপরকে চিনে থাকি তেমনই শুশুক বা ডলফিনদের আছে শিস। শিসের আওয়াজেই একে অপরকে চিনে থাকে ডলফিনরা। মানুষ যেমন নিজের পরিচয় নামের মাধ্যমে দেয় তেমনই ডলফিনরা নিজেদের আলাদা আইডেন্টিটি তুলে ধরে শিসের আওয়াজের মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন শিস দিয়ে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে ডলফিনরা। এমনকী নিজেদের মধ্যে সম্পর্কও তৈরি করে তারা এই শিস দিয়েই। এই শুশুকদের রক্ষায় এবার বিশেষ উদ্যোগী হয়েছে বাংলার সরকার। ভারতের ন্যাশনাল অ্যাকুয়াটিক অ্যানিমাল বা জাতীয় জলজ প্রাণী হল, গঙ্গার শুশুক বা ডলফিন। ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার Ganges Dolphin বা গঙ্গার শুশুকদের সংরক্ষণের লক্ষ্যে জাতীয় জলজ প্রাণী হিসাবে ঘোষণা করে।
গঙ্গার শুশুকদের রক্ষা করতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘ডলফিন মিত্র’ প্রকল্প শুরু করার পরিকল্পনা করেছে। রাজ্যের বন দফতর গঙ্গার শুশুকদের রক্ষা করতে বিশেষ উদ্যোগী হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, মালদহ, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া জেলার বন দফতরের আধিকারিকরা মিলে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষা ভবনে অনুষ্ঠিত হয় সেই উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক। নদী ও সামুদ্রিক জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় শুশুকদের অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে। তাই পশ্চিমবঙ্গের বন দফতর বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে গঙ্গার শুশুকদের বাঁচাতে। নদীর জল নিয়মিত পরিষ্কার করা হবে, শুশুকদের সংখ্যা গোনা হবে। কারণ, শুশুকদের সংখ্যা বাড়লে তা সুস্থ জীববৈচিত্র্যকে নির্দেশ করে। এছাড়াও শুশুকদের হত্যা রুখতে মৎস্যজীবী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতন করা হবে। প্রয়োজনে তাঁদেরই জনসচেতনতামূলক প্রচারে নামানো হবে।
একসময় গঙ্গায় প্রচুর দেখা পাওয়া যেত শুশুকদের। মাঝেমধ্যেই জলে ভেসে উঠে ডুব দিত মানুষের বন্ধু প্রিয় ডলফিন বা শুশুক। করোনা অতিমারিতে লকডাউনের সময় গঙ্গাতেও দেখা গিয়েছিল এক আধটা শুশুক। আসলে, নির্বিচারে ডলফিনদের শিকার, সমুদ্র ও নদীর দূষণ শুশুকদের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। বিশ্বে ৪ প্রজাতির মিষ্টি জলের শুশুক দেখা যায় তারমধ্যে অন্যতম গঙ্গার শুশুক (Platanista gangetica)। বাকি ৩ প্রজাতির শুশুক হল-বাইজি (চিনের ইয়াং সে কিয়াং নদী), ভুলান (পাকিস্তানের সিন্ধু নদ) আর বোটো (লাতিন আমেরিকার অ্যামাজন নদীতে)। গঙ্গার শুশুক গঙ্গা ছাড়াও দেখা মেলে ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, কর্ণফুলী আর সাঙ্গু নদীতে। ভারতে বাংলা ছাড়া শুশুকের দেখা যায় অসম, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, বিহার ও ঝাড়খণ্ডে। নদীর মিষ্টি জলে একমাত্র বাঁচতে পারে গঙ্গার শুশুক। সাধারণত দৃষ্টিহীন হয় গঙ্গার শুশুক, শরীর থেকে আল্ট্রাসনিক সাউন্ড বের করে শিকার ধরে। বিহারের ভাগলপুরে রয়েছে দেশের একমাত্র শুশুকদের জন্য অভয়ারণ্য, “বিক্রমশীলা গাঙ্গেয় শুশুক অভয়ারণ্য”। ভারতীয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনে শুশুককে তপশিলি ১ ভুক্ত করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার গঙ্গার শুশুককে বিলুপ্ত হওয়ার পথে ঘোষণা করেছে। মাছের মতো কানকো নয় মানুষের মতো ফুসফুসের দ্বারা শ্বাস নেয় শুশুক। শ্বাস নিতেই জলের বাইরে এসে ফের ডুব দেয় শুশুক।ডলফিন বা শুশুকদের প্রধান খাবার গঙ্গার মাছ। মাছ খেতে নদীর তীরে এসেই মৎস্যজীবীদের জালে ধরা পড়ে বেঘোরে মারা যায় নিরীহ শুশুকরা। আবার অনেক স্বার্থপর মানুষ নির্বিচারে শুশুক শিকার করে খাবার ও তেলের জন্য।
Woods Hole Oceanographic Institution এর গবেষকরা তাঁদের একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, শাবকদের সঙ্গে “high-pitched” টোনে শিসের মাধ্যমে কথা বলে শুশুক বা ডলফিনরা।শাবকদের কোনও নির্দেশ দেওয়ার সময় আলাদা হয় শিসের পিচ-টোন।জন্মের পর ৩ বছর পর্যন্ত মায়ের সঙ্গেই থাকে ডলফিন শাবকরা। Woods Hole Oceanographic Institution এর গবেষণায় আরো দেখা গেছে,প্রতিটি প্রজাতির ডলফিনের শিসের আওয়াজ একেবারে আলাদা। এমনকী প্রতিটি ডলফিনের শিসের আওয়াজের ভলিউম, ফ্রিকোয়েন্সি, পিচ আর দৈর্ঘ্যও আলাদা হয়। ২০১৩ সালে করা অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ যেমন একে অপরের গলার স্বর মিমিক্রি বা নকল করতে পারে তেমনই ডলফিনরা পারে শিসের আওয়াজ নকল করতে। ডলফিনরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অন্যের শিসের আওয়াজ নকল করতে পারদর্শী।শিসের আওয়াজের মাধ্যমে ডলফিনরা ২০ বছর বা তার বেশি সময় পরেও একে অপরকে মনে রাখতে পারে। ডলফিনদের স্মৃতিশক্তি এতটাই প্রখর।