রাজ্যের খবর

টেক্কা, সাহেব, বিবি, গোলাম নয় এখানকার তাসের চরিত্ররাই আলাদা, কোথায় জানেন?

It's not Ace, Saheb, Bibi, Golam, but the characters on the cards here are different, how do you know?

Truth Of Bengal: – এ কোন সম্পর্কের খেলা , আজ যাচ্ছে চলে স্মৃতির অতলে
টেক্কা আমি, গোলাম তোমার, এ যেন তাসের দশাবতার।।

তরুণ থেকে বৃদ্ধা আজও টেক্কা, সাহেব, বিবি, গোলাম নিয়ে তাসের হরেকরকমের খেলায় নির্ভেজাল আড্ডা জমাতে ভালবাসেন। ব্যতিক্রম নয় বাঁকুড়ার বিষ্ণপুরের তাসপ্রেমীরা। তবে তাঁদের খেলার তাস একটু অন্যরকমের। সাধারণ তাস নয়, এ তাসের গল্প একদমই ভিন্ন। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার এক ঐতিহ্যপূর্ণ অতীত, যা বর্তমানে শুধুই বেঁচে আছে নিঃশব্দে। এককথায় বলতে গেলে বাংলার বিষ্ণুপুর হল লোক শিল্পের আতুরঘর। এই বিষ্ণুপু্রের ‘দশাবতার তাস’ একটি বিচিত্র নিদর্শন। এই তাসের বিশেষত্ব শুধু খেলায় নয়, তাসচিত্রণেও। দশাবতার ভাবনা অনেক প্রাচীন, কিন্তু বিচিত্র রং-রূপে রূপায়িত করে তাকে খেলার তাসে পরিণত করার পরিকল্পনা যে কতকালের প্রাচীন, তা আজও কোনও ঐতিহাসিক সঠিকভাবে বলতে পারেন না।

নানা মুনির নানা মত:

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৮৯৫ সালে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি জার্নাল’-এ প্রথম বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাস খেলা সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত ‘নোট’ লিখেছিলেন। আবার, বিনয় ঘোষও তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ বইতে বলেছেন, ‘শাস্ত্রী মহাশয়ের বিবরণ সম্পূর্ণ নয় এবং তাঁর বিবরণের সঙ্গে আমাদের বিবরণের পার্থক্য আছে। বিষ্ণুপুর সাহিত্য পরিষদের স্থানীয় কর্মীদের সহযোগীতায়, প্রবীণ ও ওস্তাদ খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সম্পূর্ণ বিবরণ আমরা সংগ্রহ করেছি।

শাস্ত্রী মহাশয় তাসচিত্রণের পদ্ধতির কথা অথবা শিল্পী ফৌজদার ও সূত্রধরদের সঙ্গে কথা কিছু উল্লেখ করেননি তাঁর জার্নালে। তবুও দশাবতার তাসের ঐতিহাসিক প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে শাস্ত্রী মহাশয় যা বলেছেন তা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: I fully believe that the game was invented about eleven or twelve hundred years before the present

দশাবতার তাসের চিত্রায়ণের পদ্ধতি থেকে অনুমান করা যায়, পালযুগের সমৃদ্ধিকালেই এই খেলা, এই শিল্প ও শিল্পীদের বিকাশ হয়েছিল। তারই ঐতিহ্য বহন করছেন বিষ্ণুপুরের ফৌজদার ও সুত্রধররা। আজ তাঁদের বংশ প্রায় লুপ্ত বলা চলে। ‘সূত্রধর’রাই ছিলেন বাংলার শিল্পী। কাঠ, পাষাণ, মৃত্তিকা ও চিত্র –এই চার শ্রেণীর সূত্রধর বা শিল্পী ছিলেন। কাঠ-শিল্পীরা কাঠের কাজ করতেন, পাষাণ-শিল্পীরা ছিলেন ভাস্কর, মৃত্তিকা-শিল্পীরা মাটির মূর্তি, পুতুল ও পাত্র গড়তেন, আর চিত্রশিল্পীরা আঁকতেন ছবি। সেসময় সকলেই ‘সূত্রধর’ বলে পরিচিতি পেতেন।

দশাবতার তাসের উৎপত্তি:

প্রায় ৫০০ বছর আগে মল্লভূমে শুরু হয় এই খেলা। অথচ বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতির এই চিহ্নটি আজ অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। সময়টা ১৫৬৫ সালের কাছাকাছি। মল্লভূমের উপর দিয়ে শিষ্যদের নিয়ে বৃন্দাবন থেকে গৌড় যাচ্ছিলেন বৈষ্ণব গুরু শ্রীনিবাস আচার্য। গোটা বাঁকুড়া এবং বর্ধমান, বীরভূম, সাঁওতাল পরগনা, মেদিনীপুর ও পুরুলিয়ার কিছু অংশ নিয়ে তৎকালীন মল্লভূম। হঠাৎ রে-রে-রে। কয়েক মুহূর্তে সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন গুরু ও চ্যালার দল। সঙ্গের পুঁথিগুলিও মুক্তি পেল না, সব লুঠ করে নিয়ে গেল এক দল লুঠেরা।

ইতিহাস মতে শ্রীনিবাস ছিলেন ওড়িশার মানুষ। শ্রীনিবাসের হাত ধরে এই খেলা বাংলায় এলেও, এখানে এসে খেলার নিয়ম কিছুটা বদলে যায়। ওড়িশার দশ অবতারের তাসের একটি সেটে থাকত ১৪৪টি তাস। যেখানে গণেশ, কার্তিককেও বিষ্ণুর অবতার রূপে পাওয়া যায়। বিষ্ণুপুরে দশ অবতার তাসের একটি সেট ১২০টি তাস নিয়ে। গণেশ-কার্তিকের উল্লেখ নেই। এখানে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, জগন্নাথ এবং কল্কি; বিষ্ণুর এই দশ অবতারের মূর্তি আঁকা থাকে তাসে। প্রত্যেক অবতারের আবার ১২টা করে তাস। তার মধ্যে একটা রাজা ও একটা মন্ত্রী। বাকি দশটায় থাকে অবতারের প্রহরণ বা জ্ঞাপক চিহ্ন। যেমন মৎস্য অবতারের মাছ, কূর্মর কচ্ছপ, বরাহের শঙ্খ, নৃসিংহের চক্র, বামনের হাঁড়ি, পরশুরামের টাঙ্গি, রামের বাণ, বলরামের গদা, জগন্নাথের পদ্ম এবং কল্কির তরবারি। প্রথম পাঁচ অবতার, অর্থাৎ মীন, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন— এই পাঁচটি তাসের ক্রমপর্যায় হল রাজা, মন্ত্রী, তার পর দশ, নয়, আটি বা আট, সাতি অথবা সাত ইত্যাদি। দশ অবতার তাস পাঁচ জন মিলে খেলে, যা ১০ মিনিটের মধ্যেও শেষ হতে পারে। আবার এক ঘণ্টাও লেগে যেতে পারে।

আবার অন্যমতে, ব্যাবিলন না মিশর না কি ফ্রান্স…কবে কোথায় প্রথম তাস খেলা শুরু হয়েছিল? উত্তর নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কিন্তু ভারতে তাস খেলার ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। ইউরোপীয়রা ভারতে আসার অনেক আগেই রাজস্থান, মহীশূর, অন্ধপ্রদেশ, কর্নাটকে তাস খেলা হত, যার নাম ছিল ‘গঞ্জিফা’। গঞ্জিফার উল্লেখ পাওয়া যায় বাবর-কন্যা গুলবদন-এর লেখা ‘হুমায়ুননামা’য়, আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’তে। শোনা যায়, সম্রাট আকবর ভালবাসতেন গঞ্জিফা খেলতে। কখনও ১৪৪টি, কখনও ৯৬টি তাস নিয়ে গঞ্জিফার একটি সেট তৈরি হত হাতির দাঁত দিয়ে। এখনও সে জিনিস দেখা যায়, তবে জয়পুর মিউজিয়ামে। রাজা-রাজড়ার খেলা ক্রমশ জনপ্রিয় হয় সাধারণ মানুষের মধ্যেও। পরবর্তী সময়ে এই বাংলায় গঞ্জিফার ইসলামিক চিহ্নের জায়গায় জায়গা করে নেয় হিন্দু দেব-দেবী বা বিষ্ণুর দশ অবতার।

বাংলায় দশাবতার তাসের প্রচলন:

বিষ্ণুপুরের মল্লভূমের ৪৯তম রাজা বীর হাম্বীরের নির্দেশে এই খেলার প্রচলন হয়েছিল বাংলায়। সেই সময় দিল্লির মসনদে ছিলেন সম্রাট আকবর। সেখানে মল্লভূমের রাজা দেখতে পান দিল্লির দরবারে মেয়েরা বা সৈনিকরা এই তাস খেলতেন। যা দেখে তিনি হতবাক হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি এই খেলাকে বাংলায় প্রচলন করেন ফৌজদারদের হাত ধরে। মল্লভূমে তাঁর ৫৫ বছরের শাসনকালকে ইতিহাসে স্বর্ণযুগের তকমা দেওয়া হয়েছে। গুরু শ্রীনিবাসের উৎসাহে তাসের খেলা শুরু হল মল্লভূমে। যে খেলা রাজা-রানি-জোকার নিয়ে নয়, ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতার নিয়ে তাসের খেলা! বাংলায় শুরু হল খেলার ছলে ঈশ্বর ভজনাও। এমনটাই জানালেন বর্তমানে দশবতার তাসের একমাত্র কারিগর ফৌজদার পরিবারের শীতল ফৌজদার।

বীর হাম্বীরের উত্তরসূরি রাজা রঘুনাথ সিংহ এবং তাঁর ছেলে বীর সিংহের আমলেও এই খেলা বাংলায় বেশ জনপ্রিয় হয়। ইউরোপীয়রা এ দেশে নোঙর ফেলার পর ভারতীয়রা পরিচিত হয় চারকোনা ৫২ তাসের খেলার সঙ্গে। ক্রমশ ইউরোপীয় রাজা-রানি-জোকারের জনপ্রিয়তার সামনে কঠিন প্রতিযোগিতায় পড়ে বিষ্ণুপুরের গোলাকৃতি দশ অবতার তাস। তবে বর্তমানে লুপ্ত হওয়ার পথে এসে দাঁড়িয়েছে এই খেলা । একমাত্র বিষ্ণুপুরের মনসাতলার ফৌজদার পরিবারের প্রচেষ্টায় টিমটিম করে বেঁচে আছে দশ অবতার তাসের অস্তিত্ব।

তাস তৈরির উপকরণ:

মূলত, তেঁতুলবিচির আঠা, মেটে সিঁদুর, গালা, বেলের আঠা, শিরীষের আঠা, পুরনো কাপড়, খড়িমাটি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হয় এই অভিনব তাস। এবং ১২০টি তাস নিয়ে খেলা হয়। রং করার জন্য ব্যবহার করা হয়, সিমপাতার রস, হলুদ, কালি, নীল ইত্যাদি। ফৌজদার পরিবার এখনও পুরনো উপকরণ পুরনো প্রথা মেনেই তৈরি করেন এই তাস।
এমনটাই জানা গেল শীতল ফৌজদারের কথায়। পাশাপাশি এই খেলার নিয়মের খুঁটিনাটিও জানালেন তিনি।

দশ অবতার তাস তৈরি করে আর পেট চলে না ফৌজদার পরিবারের। কিন্তু, তবুও এই বংশ পরম্পরায় এই হারিয়ে যেতে বসা বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁদেরই পরিবার। তাই হয়তো জেদটা আরও বেড়ে গিয়েছে শীতলের। এই শিল্পকে আগামি প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার পরিকল্পনাকে ব্যাখ্যা করলেন তিনি। বিষ্ণুপুর শব্দটায় মিশে আছে জোড় বাংলা, শ্যামরাই মন্দির, রাসমঞ্চ, টেরাকোটার মন্দির, বালুচরী শাড়ি।

বলতে বাধা নেই, আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার দৌলতে এই মন্দিরগুলির রক্ষণাবেক্ষণ প্রশংসনীয়। পশ্চিমবঙ্গে পর্যটন শিল্পের বিজ্ঞাপনেও জায়গা পেয়েছে বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার মন্দিরগুলি। কিন্তু সেই অঞ্চলেরই দশ অবতার তাসের ঐতিহ্যের কথা আজ অধিকাংশ মানুষ জানেন না! তা হলে কি এই তাসের ভবিষ্যৎও গঞ্জিফার মতো, কিছু দিনের মধ্যে সেও কি চলে যাবে স্মৃতির অন্তরালে নাকি ফৌজদাররা বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হবে এই বিরল শিল্পের। তার উপরই নির্ভর করছে দশাবতার তাসের ভবিষ্যত।

Related Articles