প্রযুক্তি নির্ভর যুগেও ভিড় বাড়ছে ক্যালেন্ডার ও হালখাতার দোকান, ফিরে আসছে অতীত
Even in this technologically-dependent era, calendar and calendar shops are becoming increasingly crowded, and the past is returning.

Truth Of Bengal: মাধব দেবনাথ,নদিয়া : নববর্ষ মানেই হালখাতা ও নতুন ক্যালেন্ডার, নতুন ব্যাগ, নতুন পোশাক। মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাড়িতে গিয়ে মিষ্টিমুখ। এখন প্রযুক্তি নির্ভর যুগে সেই ছবির কোথাও যেন অদল বদল ঘটেছিল। কয়েক বছর ধরে সেভাবে চাহিদা ছিল না ক্যালেন্ডারের। ছিলনা হালখাতারও। কারণ কম্পিউটারের মাধ্যমেই এসবের চাহিদা মেটাচ্ছে প্রযুক্তি। ফলে নদিয়ার ক্যালেন্ডার ও হালখাতা তৈরির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় ঝুঁকেছেন। ব্যবসায়ীদের দাবি, “আগে হাজার হাজার ক্যালেন্ডার ও হালখাতা তৈরি করতাম। চৈত্রর শেষের দিকে সব বিক্রি হয়ে যেত।”
এত ক্যালেন্ডারের যোগান দিতে পারতেন না তারা। এখন সেই ছবি আবার বদলাচ্ছে। এখন হালখাতা ও ক্যালেন্ডারের অর্ডার আবার আগের মত হতে শুরু করেছে। যদিও আগে প্রত্যেকটি ক্যালেন্ডার থেকে প্রায় ৪ টাকা করে লভ্যাংশ থাকত। এছাড়াও হালখাতার কার্ডও ছাপানো হত। সবই এখন ডিজিটাল মাধ্যমে চলে আসায় আর সেভাবে চাহিদা ছিল না।
ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, আগে জমিদারকে খাজনা দেওয়ার অনুষ্ঠান হিসেবে ‘পূণ্যাহ’ প্রচলন ছিল। বছরের প্রথম দিন প্রজারা সাধ্যমতো ভালো পোশাক-আশাক পরে জমিদার বাড়িতে গিয়ে খাজনা পরিশোধ করতেন। তাঁদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হত। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ায় ‘পূণ্যাহ’ বিলুপ্ত হয়ে যায়। ‘পূণ্যাহ’ বিলুপ্ত হওয়ার পর বাংলা সনের প্রথম দিন দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার জন্য শুরু হয় হালখাতা।
১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর থেকেই হালখাতার প্রচলন হয় ভারতে। তবে সেই জনপ্রিয় প্রথায় বছর পাঁচ ছয় ধরে প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছিল মারাত্মকভাবে। ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্যালেন্ডারের বদলে ক্রেতাদের নামিদামি গিফট দিতেন। হালখাতার কার্ডও ছাপাতেন না। হোয়্যাটসঅ্যাপের মাধ্যমে পৌঁছে যেতো হালখাতার কার্ড। ফলে আগের চেনা ভিড় ছিল না ক্যালেন্ডার ও হালখাতার দোকানে। তখন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছিলেন ক্যালেন্ডার ও হালখাতা তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা।
নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের মাজদিয়ার ক্যালেন্ডার ও হালখাতা ব্যবসায়ী স্বপন কুমার ভৌমিক জানান, ‘আমার এই ব্যবসা গত ৫০ বছর ধরে চালাচ্ছি। গত ৫ বছর ৬ বছর ধরে ক্যালেন্ডার ও হালখাতার অর্ডার সেভাবে ছিল না । তবে এখন আবার আগের মতো চাহিদা আসতে শুরু করেছে। আগে চৈত্র মাস পড়লে নাওয়া খাওয়ার সময় থাকত না। গত কয়েক বছর ধরে তার আমূল পরিবর্তন হয়। প্রায় ৮০% বিক্রি কমে যায়। বলা যেতেই পারে কম্পিউটার এসে সেভাবে হালখাতা ও ক্যালেন্ডারের চাহিদা দেখা যায় না। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে অনেক কিছুই পরিবর্তন এসেছে আভিজাত্যের ছোঁয়া। তবে সব কিছুকে ফেলে আবার পুরনোর দিকে এগিয়ে চলেছে ব্যবসায়ীরা।”
স্বপন বাবুর কথায় মনে হচ্ছে যেন এবছর আবার হারানো ও পুরনো দিন ফিরে পেয়েছি । আগের মতই ক্যালেন্ডার ও হালখাতার অর্ডার বেড়েছে। স্কিন প্রিন্টার গোপাল মন্ডল বলেন, দিনরাত পরিশ্রম করে আমরা ও কর্মচারীরা তৈরি করছেন ক্যালেন্ডারের কাজ। তিনি পাশাপাশি এটাও বলেছেন আগে শুধুমাত্র পহেলা বৈশাখ হালখাতা হলেও বর্তমানে অক্ষয় তৃতীয়া বুদ্ধ পূর্ণিমা রথযাত্রা সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই হালখাতার রেওয়াজ চালু হয়েছে ।
এ ব্যাপারে স্থানীয় কাস্টমার ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাস জানান, একদিনে হালখাতা করলে পুরনো বকেয়া টাকা সব জায়গায় দিতে পারে না ফলে পাওনা টাকা ঠিকভাবে আদায় হয় না। বিভিন্ন সময় হালখাতা প্রথা চালু হওয়ায় ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হচ্ছেন তেমনি লাভবান হচ্ছেন দোকানদার রাও । পাশাপাশি তিনি এটাও বলছেন সারা বছর একজন কাস্টমারকে অর্থাৎ ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে খুব সম্পর্ক রাখার জন্যই মিষ্টিমুখ করানো ও একটা ক্যালেন্ডার দিয়ে আতিথিয়তা কে বরণ করার জন্যই হালখাতার রেওয়াজ বাড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দা বিদ্যুৎ বিশ্বাস বলেন যতই কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষকে আমন্ত্রণ করা হোক না কেন মানুষের মধ্যে যে আন্তরিকতা ছিল , সেই আন্তরিকতার নষ্ট হচ্ছিল। এটা সকল ব্যবসায়ীরা যেমন বুঝছেন তেমনি ক্রেতারাও বুঝতে পেরেছেন। যার ফলে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা ও রাখার জন্যই হালখাতা চিঠি খুবই গুরুত্বপূর্ণ । হালখাতার সাথে একটা ক্যালেন্ডার যদি ক্রেতার কাছে পৌঁছায় তাহলে সেই ক্রেতা তার নিজের বাড়িতে দেয়ালে যখন টাঙ্গিয়ে রাখবেন তিনি যেমন সমস্ত কিছু তার ক্যালেন্ডারের মধ্যে দেখতে পাবেন পাশাপাশি তার গুরুত্বপূর্ণ কোন দিন থাকলে তিনি কিন্তু ক্যালেন্ডার এর মধ্যে চিহ্নিত করে রাখতে পারবেন। এই জন্যই এখন পুরো দিনকে ফিরিয়ে আনছে ব্যবসায়ীরা ফলে বাড়ছে ক্যালেন্ডারের চাহিদা । বড় আন্তরিকতার অভাব রয়েছে বলেই মানুষ আবার পূর্বের দিনকে সাধরে গ্রহণ করছেন ।বলা যেতেই পারে, প্রযুক্তি নির্ভর যুগে ক্যালেন্ডার ও হালখাতার দোকানে ভিড় বাড়ছে ।