ভ্রমণ

বাংলার পর্যটনঃ রাজবল্লভী মন্দির এবং হাট থেকেই কি আজকের রাজবলহাট?

Bengal Tourism: Howrah's Rajbalhat today

Truth of Bengal: দামোদর আর রণ নদী বেষ্টিত গ্রাম রাজবলহাট। ত্রয়োদশ শতকে সদানন্দ রায় এই নদী বিধৌত জঙ্গলাকীর্ণ এলাকার বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে রাজপুত্রের উত্থান ঘটান এবং গড়ে তোলেন এক বিশাল হাট। তিনি রাজবল্লভীর স্বপ্নাদেশে মন্দির তৈরি করেন। এই রাজবল্লভীর নাম এবং হাটের নাম যুক্ত হয়ে হয় রাজবল্লভী হাট, পরে তা হয়ে ওঠে রাজবলহাট।

‘রাজবলহাট’ নামটি এসেছে রাজবল্লভী দেবীর নামানুসারে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে রাজবল্লভী দেবীর মন্দিরটি বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে এবং এই মন্দিরে প্রাচীনত্বের কোনো নির্দশন বতর্মানে নেই। মন্দিরের পাশেই একটি নাটমন্দির আছে। ষোড়শ শতকে ভুরশুটের রাজা রুদ্রনারায়ণ রায় এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। ভুরশুট রাজবংশের বসন্তপুর শাখার সম্পত্তির বিবরণ রয়েছে সরকারি রেকর্ডে।

রাজবলহাটেও প্রায় সাত বিঘা ভূমির উপর তাদের গড় ও বসতবাটি ছিল। এবং রাজবল্লভী ঠাকুরানীর নামে দেবোত্তর সম্পত্তি ছিল পাঁচশো বিঘা। রাজার গড় বাড়ির এখন কোনও চিহ্ন নেই রাজবলহাটে। গরীব ব্রাহ্মণকন্যার বেশে রাজবল্লভী দেবী কোনও এক পরিবারে দাসীর কাজ করতেন। পাশে নদীপথে তখন সওদাগরদের ডিঙা যাতায়াত করতো।

রূপবতী ব্রাহ্মণকন্যাকে পাড়ে দেখে বণিক সেই ঘাটে ডিঙা বাঁধেন এবং অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে সেই ব্রাহ্মণকন্যাকে নিজের বজরায় নিয়ে আসার সংকল্প করেন। ব্রাহ্মণকন্যা যখন একটির পর একটি ডিঙায় পা দিয়ে বণিকের বজরার দিকে যাচ্ছিলেন, তখন ডিঙাগুলি একে একে নদী গর্ভে পণ্যের পসরাসহ ডুবতে শুরু করে। আর্যসংস্কৃতির প্রভাবপুষ্ট ধনী সদাগরশ্রেণি গ্রাম্য লৌকিক দেবদেবীদের বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন না।

চণ্ডীর কাহিনীর মধ্যে তার ইঙ্গিত মেলে। রাজবল্লভীর ক্ষেত্রেও তাই। এই দেবী যে চণ্ডীর এক রূপ, তা মনে করেন গবেষকরা। পীঠনির্ণয় গ্রন্থে রাজবলহাটকে শাক্তপীঠ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং পীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম বলা হয়েছে চণ্ডী। সাতটি ছোট ছোট ডিঙা তৈরি হয় এবং তার মধ্যে ছটি ডিঙা দেবীর মন্দির সংলগ্ন পুকুরে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।

তারপরেই পুজো আরম্ভ হয়। এই অনুষ্ঠান দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। হাওড়া হুগলি জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে, প্রধানত দামোদর ও অন্যান্য নদীর তীরবর্তী বহু সমৃদ্ধ গ্রামে যেমন মাকড়দহ, আমতা জয়পুর-ঝিকরা, রসপুরে চণ্ডীর প্রতিপত্তির কথা মনে পড়ে। রাজবল্লভী দেবীর সামনে নিজের ঘট ছাড়া আরও চারটি ঘট রয়েছে।

একটি বাসুদেব, একটি ভগবতীর , একটি লক্ষ্মীর আর একটি নীল সরস্বতীর। গবেষকদের দাবি, এই নীলসরস্বতী আসলে বৌদ্ধদের দেবী তারা। অর্থাৎ বৌদ্ধদেবী ঘটে পুজো পাচ্ছেন। হাওড়া জেলার অন্তর্গত একটি এলাকা রয়েছে রসপুর। তার পাশের রয়েছে কলকাতা গ্রাম, স্থানীয়রা অনেকেই একে রসপুর কলকাতা বলে থাকেন।

আবার কেউ কেউ বড় কলকাতার থেকে আলাদা করতে ছোট কলকাতা বলেও ডেকে থাকেন। রাজবল্লভী দেবীর মূর্তি অদ্ভূত এবং মাটির মূর্তি। গঙ্গা মাটি দিয়ে তৈরি এই মূর্তি। প্রায় ছয় ফুট উচ্চতায় রাজবল্লভী দেবীর মূর্তিটি সাদা রঙের। বাম পায়ে বসে বিরুপাক্ষ শিবের উপর এবং ডান পা বিশ্রাম মহাকাল ভৈরবের বুকে। বাম হাতের তালুতে আছে একটি সিঁদুরের পাত্র আর ডান হাতে দেখা যাচ্ছে ছুরিকা। কোমরে ছোটো ছোটো কাটা হাতের মালা।

গলায় ঘণ্টার মালা। বিভিন্ন শহর ও গ্রাম থেকে আসা ভক্তরা দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাজবলহাটে মিলিত হয়। সকাল সাতটায় মন্দিরের দরজা খোলে। এগারোটায় পুজো শুরু হয়ে দুপুর দুটোয় ভোগ নিবেদন করা হয়। সাতটায় হয় সন্ধ্যারতি। অবিভক্ত বাংলায় মোট তিনটি কলিকাতা গ্রামের নাম পাওয়া যায়। একটি বর্তমানে মহানগরে পরিণত হয়েছে, অন্যদুটির মধ্যে একটি রয়েছে ঢাকা জেলার লৌহজঙ্গ থানা এলাকায় আর দ্বিতীয়টি রয়েছে হাওড়ার আমতা থানা এলাকায়। অর্থাৎ এই গ্রামগুলিতে একটা সময় শামুক পুড়িয়ে কলিচুন তৈরি করা হত।

Related Articles