জোটেনি কর্পোরেটের চাকরি, কিংবা সরকারি সাহায্য, দ্রারিদ্রে দিন কাটছে বিশ্বকাপারের
With no corporate job, or government help, the World Cup player spends his days in poverty

Truth Of Bengal: শীতের দুপুরে মিঠে রোদের আমেজ নিতে মাদুর পেতে বাড়ির সামনের মাটির বারান্দায় বসে ৭৪ বছরের এক আদিবাসী বৃদ্ধ। একেবারে গ্রাম্য পরিবেশে তাঁর বাসস্থান। বাড়ির সামনে যেমন রয়েছে পুকুর, ঠিক তেমনি রয়েছে লাল-মাটির রাস্তা। রয়েছে নারকেল এবং তালগাছের সাড়িও। রাস্তার দুধার ধরে যে দিকে চোখ যায়, সেদিকেই ধু ধু করছে চাষের জমি। শীতের দুপুরে এই গ্রাম্য দৃশ্য অবাক হয়ে দেখছিলেন তিনি।
আর মনে মনে কী ভাবছিলেন কে জানে! সেই আদিবাসী বৃদ্ধটি হলেন আমাদের স্বাধীন দেশের একজন বিশ্বকাপার। তাও যে-সে বিশ্বকাপার নন, তিনি হকির স্টিক হাতে বিশ্বকাপের মঞ্চে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এর থেকে গর্বের আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না। এই হকি বিশ্বকাপারের নাম ভিনসেন্ট লাকড়া।
সোমবার ছিল জাতীয় কৃষি দিবস। বিশেষ এই দিনে কৃষিজীবী এই বিশ্বকাপারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে, অভিভূত হয়ে যান তিনি। কলকাতা থেকে ফোনে তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে জেনে ভিনসেন্ট বলেন, আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ। আপনারা আমার মতো এক বৃদ্ধকে মনে রেখেছেন। জানেন দুঃখের কথা, আপনারা মনে রাখলেও, আমাকে মনে রাখেনি আমার পড়শি থেকে শুরু করে নিজের রাজ্যের মানুষ পর্যন্ত। তাঁদের কাছে আমার পরিচয় কৃষক ভিনসেন্ট হিসাবেই।
নিজের উত্থান থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত তাঁর জীবন কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে ভিনসেন্ট যেন ফিরে গেলেন, সেই ছোট্ট বেলার দিনগুলিতে। বললেন, আমাদের আদি বাড়ি ছিল যশপুরের কুনকুনি গ্রামে। সেখান থেকেই ১৯৭৬ সালে বাবা-মায়ের হাত ধরে ভিনসেন্ট চলে আসেন বর্তমান ছত্তিশগড়ের রায়গড় জেলার আর এক প্রত্যন্ত গ্রাম শিথরায়। তারপর থেকে আদিবাসী অধুষ্যিত এই গ্রামেই শুরু হয় ভিনসেন্টের দ্বিতীয় ইনিংস। এখানেই স্ত্রী, দুই পুত্র ও নাতি নাতিনদের নিয়ে অভাবের সংসারে প্রতিদিন লড়াই করে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার স্বপ্ন দেখছেন বলেই জানান ৭৪ বছরের এই আদিবাসী হকি বিশ্বকাপার।
ভিনসেন্ট বললেন, সেনাবাহিনীতে কিছুদিন চাকরি করার সুবাদে কিছু পেনশন পাই। কিন্তু তা দিয়ে দিন-আনা দিন খাওয়া পরিবারে ১০ জনের পেট ভরে না। আমাদের এই গ্রামে চাকরি-বাকরি কোথায় হবে? তার জন্য গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হবে। কিন্তু বউ-বাচ্চা সবাইকে নিয়ে বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমার কিছু জমি আছে, ওখানেই চাষ-বাস করে যা কিছু আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চালাই কোনওমতে। সরকার কোনও সাহায্যই করেনি। বার বার আবেদন করেছি। কিন্তু এখন আর বাধ্য হয়ে করি না। দুবার হৃদরোগে আক্রান্ত হলেও পেটের টানে এখনও তাঁকে ছুটে যেতে হয় জমিতে চাষ করতে। কথাগুলি বলতে বলতেই ভিনসেন্ট যেন বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। বললেন, অভাব থাকলেও, আমি ভাল আছি। আমার পরিবার ভাল আছে।
সরকার পাশে দাঁড়ায়নি, কিন্তু প্রয়াত কিংবদন্তী অভিনেতা সুনীল দত্ত যে তাঁকে খুব স্নেহ করতেন, সে কথাও জানাতে ভুললেন না ভিনসেন্ট। বললেন, ওই সময়ে আমাকে দত্ত সাহাব বলেছিলেন, মুম্বই চলে আসতে। কিন্তু আমি আমার গাঁও ছেড়ে কোথাও যাইনি। ওঁনার কথা সে আজও মনে রেখেছেন বলে জানাতে ভুললেন না ভিনসেন্ট।
এই আদিবাসী হকি খেলোয়াড় দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলেছেন ১৯৭৮ সালে। সেবার লাতিন আমেরিকার ফুটবল পাগল দেশ আর্জেন্টিনায় বসেছিল হকির বিশ্বকাপের আসর। চারজন আদিবাসী হকি খেলোয়াড়কে ওই দলে জায়গা দেওয়া হলে ভিনসেন্ট ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাকিরা হলেন গোপাল ডেংরা, জন করকেট্টা ও সিলভানাস ডুংরু। শুধু বিশ্বকাপই নয়, জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলেছেন একাধিক টুর্নামেন্ট-ও। তবে অলিম্পক না খেলতে পারার আফসোস এখনও তাঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় বলে জানাতেও ভুললেন না প্রাক্তন এই বিশ্বকাপার।
বর্তমানে সব খেলাতেই কর্পোরেটের ছোঁয়া। একটু নাম করতে পারলেই যে কোনও খেলাতেই টাকার ছড়াছড়ি। অথচ আদিবাসী সমাজ থেকে উঠে এসে হকি স্টিক হাতে বিশ্বকাপের মঞ্চে খেলা সত্ত্বেও ভিনসেন্ট লাকড়ারা থেকে যান প্রচারের অন্ধকারে। মাটির বাড়িই তাঁদের কাছে বহুতলের সমান। তাঁরা স্বপ্ন দেখেন না চার চাকার গাড়িতে চড়ার, বড় বড় মাল্টি ন্যাশানাল কোম্পানির প্রতিনিধিরাও বাড়িয়ে দেন না সাহায্যের হাত। ফলে ভিনসেন্টরা থেকে যান সেই তিমিরেই। যে তিমিরের প্রতিটি দিনের ভোরের সূর্য বয়ে আনে লড়াইয়ের বার্তা, যে লড়াই শেষ হয় পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়ার আগে পর্যন্ত।
কিন্তু সরকার আপনাকে প্রাপ্য সম্মান না দিলেও আপামর দেশবাসীর কাছে আপনার পরিচয় একজন বিশ্বকাপার হিসাবেই। সোমবার জাতীয় কৃষি দিবস উপলক্ষে ভিনসেন্টের মতো একজন কৃষক বিশ্বকাপারকে তাই অভিবাদনের পাশাপাশি জানাই স্যালুট-ও।