অভিষেকের ‘মিশন দিল্লি’, কৌশলী চালে বিপাকে বিজেপি
পাল্টা চাপের কৌশল নিচ্ছে বিজেপির শীর্ষনেতৃত্ব

The Truth of Bengal: চালের বদলে পাল্টা চাল, আর কখনও কখনও সেটা হয়ে উঠছে মোক্ষম চাল। দিল্লি বনাম অভিষেকের রাজনৈতিক লড়াই সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের আগে বাংলাকে কীভাবে জব্দ করা যায়, তার চিত্রনাট্য লেকা হয়েছিল দিল্লিতে বসেই। রাজধানীতে ক্ষমতার শীর্ষে বসে থাকা দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা যকন দেখলেন, বঙ্গে তাঁদের দলীয়নেতাদের উড়নতুবড়ি আচরণ, তখন, তাঁরাই ঠিক করে ফেললেন, কলকাঠি নাড়তে হবে দিল্লিতে বসেই।
কেলেঙ্কারি, কেলেঙ্কারি, কেলেঙ্কারি, ঠিক যেভাবে ২০১৪ সালের আগে ইউপিএ টু সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক কেলেঙ্কারির কথা সামনে এসেছিল, সেই একই রূপ যেন নিচ্ছে এই বঙ্গে। টুজি কেলেঙ্কারি, কয়লা ব্লক কেলেঙ্কারি, আদর্শ আবাসন কেলেঙ্কারি, কমনওয়েল্থ গেমস কেলেঙ্কারি। তবে এর মধ্যে যে কেলেঙ্কারি সবচেয়ে বেশি সাধারণ মানুষের মনে জায়গা করেছিল সেটি হল টু জি কেলেঙ্কারি। মজার বিষয়, এই কেলেঙ্কারিতে যাঁরা অভিযুক্ত হয়েছিলেন, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর, তাদের বিরুদ্ধে ফের একবার ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ফলত, ইতিহাস বলছে, যা দেখানো হয়, তার বাস্তব ভিত্তি কতটা থাকে, তা সময় উত্তর দেয়।
বাংলাতেও সেই একচিত্র দেখা যাচ্ছে, শিক্ষক নিয়োগ থেকে, গরুপাচার, কয়লাপাচার কত অভিযোগ উঠেছে। মন্ত্রি থেকে একাধিক কর্মাকর্তারা বিচারাধীন বন্দি রয়েছেন। ঠিক যেমন টু জি কেলেঙ্কারিতে ছিলেন ডিএমকে নেত্রী কানিমোঝি, মন্ত্রী এ রাজা। কিন্তু বাস্তব চিত্র? প্রায়ই দেখা যাচ্ছেন, তাবড় তাবড় গোয়েন্দা আধিকারিকরা আদালতে এসে, দুর্নীতির প্যান্ডরা বাক্স খোলার কথা বললেও, বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না। কখনও কখনও হতাশা দেখা দিচ্ছে বিচারপতিদের গলাতেও। আর এখানেই ওঠে প্রশ্ন, তাহলে কি দিল্লিতে বসে, চব্বিশের বৈতরণী পার করতে এক মেগাসিরিয়ালের চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে? কিন্তু কারণ কী?
পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেই, অভিষেকের কর্মসূচি ছিল, তৃণমূলে নবজোয়ার। শুরু থেকেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখা দেয় এই কর্মসূচিতে। আর এই কর্মসূচিতে মাত্রা জুগিয়েছিল, সাধারণ মানুষের মতামত নিয়ে জনপ্রতিনিধি তুলে আনার সিদ্ধান্ত। কয়েকটি জনসভার পরেই, এই কর্মসূচির গতি রোধ করতে সক্রিয় হয়েছিল সিবিআই ইডি আধিকারিকেরা। তার পরে আরও কয়েক দফা তলব হয়েছে। আর এমন সময়ে ডাকা হয়েছে অভিষেককে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যেমন ইন্ডিয়া জোটের কো অর্ডিনেশন কমিটির প্রথম বৈঠকের দিনেই তলব করা হয়। সেদিন গিয়েছিলেন অভিষেক, এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে এসে ফের একবার তোপ দেগেছিলেন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে।
অভিষেকের আন্দোলনের ঝাঁঝ যত বাড়ছে, ততই পাল্টা চাপের কৌশল নিচ্ছে বিজেপির শীর্ষনেতৃত্ব। আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল, ২ এবং ৩ তারিখ দিল্লিতে মহাকর্মসূচি পালন করবেন তিনি। বাংলা থেকে তৃণমূলের কর্মীসমর্থকদের সঙ্গে নিয়ো শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করবেন তিনি। কিন্তু ঠিক ওই দিনেই অর্থাৎ ৩ অক্টোবর ফের একবার ইডি দফতরে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ এলো। এবার সেই নির্দেশকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি পালনের দিকেই ঝুঁকলেন তিনি। আর এই কড়া সিদ্ধান্ত তাঁকে নিতেই হত, কারণ দিল্লিতে আয়োজিত মহাসংগ্রাম কর্মসূচির পুরোধা এবার তিনি। অভিষেকের উপস্থিতি না থাকলে, পুরো আয়োজনই মাটি। ফলত, সাধারণের মানুষের পাশে যে তিনি রয়েছেন, এবং মানুষের পাশে থাকার জন্য তিনি যে কোনও পদক্ষেপ করতে পারেন, সেই বার্তা দিয়েছেন। এখানেই আসে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ছল। আর এই ছলকে হাতিয়ার করার কারণ, বঙ্গ বিজেপির দুর্বল নেতৃত্ব। গত বিধানসভা নির্বাচন হোক বা পঞ্চায়েত নির্বাচন, কোনওটিতেই সেভাবে জায়গা তৈরি করতে পারেনি বঙ্গ বিজেপির নেতৃত্ব।
আরও পড়ুন- খালিস্তানি আন্দোলনের এক মুছে যাওয়া ইতিহাস
অন্তর্কলহ, দ্বন্দ্ব এমনকী নিজেদের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুড়ি, নীচু তলার কর্মীদের ক্ষোভ, সব মিলিয়ে বেসামাল রাজ্য নেতৃত্ব। কিন্তু এবার হয়তো একটু ভুল চাল দিল বিজেপির শীর্ষ কর্মকর্তারা। দিল্লিতে প্রতিবাদ কর্মসূচির জন্য রেলের কাছে ট্রেন চেয়েছিল তৃণমূলনেতৃত্ব। তার জন্য অর্থও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিশেষ ট্রেন দেওয়া হয়নি। ভাবা হয়েছিল, এখানেই হয়তো ভাটা পড়বে তৃণমূলের দিল্লি যাত্রায়। কিন্তু তা হল না, মহাচিত্রনাট্যে বদল এনে দিল তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্ব। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, বাসে করেই যাওয়া হবে দিল্লি।
আরও পড়ুন- শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ, ও রাজীবের ভুল
কলকাতা থেকে বাসে করে দিল্লি যাত্রা এটা বড় বিষয় নয়, আসল বিষয় হল, বাস যাবে, বিহারের পর উত্তরপ্রদেশ হয়ে। অর্থাৎ বিজেপিশাসিত রাজ্য হয়েই, দিল্লি পৌঁছবে তৃণমূলের রথ। তাহলে কি তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষেত্রে শাপে বর হয়ে গেল? বিশেষ ট্রেনে যাত্রা, জাতীয়স্তরে যতটা সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করত, এটা যে আরও কয়েকগুন বেশি করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে, তৃণমূলের নতুন সিদ্ধান্তে কিছুটা ব্যাকফুটে পড়ল বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। এদিকে রাজ্যের তৃণমূলকর্মীরাও যে চব্বিশের আগে বাড়তি অক্সিজেন পাবে তা বলাই বাহুল্য।
অর্থাৎ চব্বিশের আগে তৃণমূলকংগ্রেস তার রণকৌশল যে সাজিয়ে নিয়েছে, তাই ইঙ্গিত স্পষ্ট, অথচ, বঙ্গে বিজেপি নেতৃত্ব কীভাবে জায়গা দখল করবে, তা নিয়েই এখনও দিশেহারা বিজেপির শীর্ষনেতৃত্ব। কারণ, তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইতো দূর অস্ত, নিজেদের অন্তর্কলহ কীভাবে থামবে তা নিয়ে বিড়ম্বনায় দিল্লির নেতারা।
Free Access