অফবিটলাইফস্টাইল

পাঁজি বিনা অচল বাঙালির জীবন

The life of a Bengali without a calendar is stagnant

Truth Of Bengal: বঙ্গজীবেন পাঁজি বা পঞ্জিকার কদর একেবারে আলাদা। দিনক্ষণ, তিথিনক্ষত্র, রাশিফল, সবকিছুর খবর আমরা পাই পঞ্জিকা থেকেই। তাই পাঁজির কদরই আলাদা। সম্মান অনেক। সেজন্য নতুন বছরের শুরুর আগে থাকতেই দোকানে, ফুটপাতে, ট্রেনের কামরায় পাঁজি বিক্রি হতে দেখা যায়। পাঁজির চাহিদা প্রচুর। জন্ম থেকে মৃত্যু, শুভদিন, শুভকর্ম, অমাবস্যা থেকে পূর্নিমা, মলমাস, সবকিছুই পঞ্জিকা মারফত আমাদের জীবনকে চালিত করছে প্রতিনিয়ত। যতই আধুনিক হই না কেন বাস্তবে হট কেকের মতো বিক্রি হয় পাঁজি।

বাস্তব জীবনে পাঁজি যে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে তার হাতে গরম প্রমাণ আমরা পাই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে, টিভিতে, পত্রপত্রিকায় নির্দিষ্ট ‘আজকের দিন’ বা রাশিফল অংশে। পাঁজি হল এমন এক বিচিত্র বই যা আমাদের মজার মজার নানা তথ্য দেয়। কিন্তু কোথা থেকে উৎপত্তি হল পাঁজির? ছাপাখানা বা কাগজের প্রচলন যখন এদেশে হয়নি তখনকার পাঁজির ইতিহাস অস্পষ্ট। পণ্ডিত সমাজ ও ব্রাহ্মণরাই তিথিনক্ষত্র সময় যোগ, গ্রহ নক্ষত্র দেখে ও পুঁথি পড়ে তিথি ঠিক করতেন।

ইংরেজি ১৮২৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হওয়া পাঁজির কথা জানা যায়। আকারে বেশ বড়ো এই পাঁজি বিষয় বৈচিত্র্যেও ভরা ছিল। দাম ছিল ১ টাকা। ১৮২৫ সালে বিশ্বনাথ দেব নামে এক ব্যক্তি নতুন করে পাঁজি বের করেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় পাঁজির বিক্রি শতগুন বেড়ে যায়। জেমস লং সাহেব নামে এক ইংরেজ কলকাতা বিষয়ক বইতে লেখেন পান ও তামাকের মতো বাঙালিরা আরও এক দ্রব্যকে জীবনে অপরিহার্য বলে মনে করে। সেই বস্তুটি ছিল পাঁজি। তখন কলকাতায় বইয়ের দোকান ছিল না তাই মাথায় ঝাঁকা নিয়ে পাঁজি বিক্রি করা হত। এসময় সবচেয়ে জনপ্রিয় পাঁজি ছিল দুর্গাচরণ গুপ্তর প্রতিষ্ঠিত গুপ্তপ্রেস ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা।

প্রথম ২ খণ্ডে পাঁজি বের করেছিলেন কিশোরীমোহন বাগচী। এক খণ্ডে পঞ্জিকা আর অন্য খণ্ডে ডাইরেক্টরি ছিল। এই বাগচীমশাই ১৮৯৯ সালে যে পঞ্জিকা বের করেছিলেন তাতে লর্ড ও লেডি কার্জনের ছবি দেবদেবীর ছবি ছেপেছিলেন। ১৯ শতকের গোড়া থেকে বাজারে পাঁজি প্রকাশ নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। টিকে থাকতে অনেকে ম্যাজিক, সম্মোহনী বিদ্যা, গুপ্ত রোগের ওষুধের তথ্যও দিতে শুরু করেন। কেউ আবার ব্রিটিশ রাজের আনুকুল্য পাওয়ার জন্য পাঁজির নাম ভিক্টোরিয়া পঞ্জিকা, লর্ড রিপন পঞ্জিকা রেখেছিলেন। পরে পাঁজির ব্যবসাকে ঝাঁ চকচকে করতে প্রকাশকরা আরও বেশি সচেষ্ট হন।

স্বাধীনতার পর বিভিন্ন রাজ্যে অব্দ, সাল, তারিখ নিয়ে গরমিল দেখা যায়। সমস্যা সমাধানের জন্য ডঃ মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে সরকার ১৯৫২ সালে এক বিশেষ পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গড়ে। ১৯৫৭ সালে ১২টি ভাষায় বিশুদ্ধ গণনা অনুসারে প্রকাশিত হয় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা যার চাহিদা আজও অপরিসীম। এছাড়াও বেণীমাধব শীলের পাঁজিও জনপ্রিয়।
অনেক কিছু কালের গর্ভে তলিয়ে গেলেও বঙ্গজীবনে পাঁজির স্থান কিন্তু আজও সবার ওপরে।
বিভিন্ন শিল্পকলাকেও উজ্জীবিত করে পাঁজি। কার্টুনের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল পাঁজিতে। পাঁজি হল এক কালোত্তীর্ণ সাহিত্য যা ঐতিহ্যের ধারক ও বাহকও বটে কারণ শিল্প, বাণিজ্য, সংস্কৃতি, ধর্মের মেলবন্ধন ঘটে পাঁজিতেই।

Related Articles