
The Truth of Bengal: পিটার ক্যাটের চেলো কাবাব আর সিজলারের প্রেমে পড়া বারণ নয়, প্রেমে পড়া বারণ। এখনও এই গানটা লেখা হয়নি, তাই অহরহ আমাদের চারপাশের লোকজন প্রেমে পড়তেন। আর কী আশ্চর্য, প্রেমে পড়লেই কতজন যে আমাকে ‘পিটার ক্যাট’-এ খাওয়াতে নিয়ে যেতেন! আমার এক নিকট আত্মীয় তখন গড়িয়াহাটের এক মহিলার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন। তাই রাত হলেই আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলে যেতেন পিটার ক্যাট’-এ। তিনি যখন তাঁর প্রেম, বিরহের কথা বলতে বলতে বলতে পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিতেন, আমি তখন মন দিয়ে নান আর চিকেন ভর্তা খেতাম। এটা প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। তখনও পার্ক স্ট্রিটের এই রেস্তোরাঁ কলকাতার ‘ফুড ম্যাপে’ এতটা ‘আইকন’ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আটের দশকের শেষ থেকে পরের কুড়ি বছর যে কতজনের প্রেমের গল্প শুনতে পিটার ক্যাটে গিয়েছি, আর মন দিয়ে চিকেন ভর্তা বা বিভিন্ন ধরনের ‘সিজলার’ খেয়েছি, তা গুনে শেষ করতে পারব না। অন্যের প্রেম যখন উষ্ণতা ছড়াচ্ছে, মানে, তাঁর গল্প বা টুকরো আলতো কথায়, তখন পিটার ক্যাটের ভিতরে আলো আঁধারিতে আমার ‘সিজলারে’ ধোঁয়া উঠেছে। প্রেমে পড়ে গেলাম। মানে এইভাবে যেতে যেতে আর অন্যের প্রেমের গল্প শুনতে শুনতে কবে যেন আমিও পার্ক স্ট্রিটের পিটার ক্যাটের প্রেমে পড়ে গেলাম। এমনিতেই সাহেবি পাড়া বলে পরিচিত পার্ক স্ট্রিটে তো আর ‘ফুড ইটারি’র কমতি নেই। আর তার মধ্যে অনেকগুলোই যেমন ‘আইকনিক’, তেমনই খাবারের দিক থেকেও বিখ্যাত। কিন্তু কীভাবে যেন পিটার ক্যাট হয়ে উঠল মধ্যবিত্ত বাঙালির অভিজাত হয়ে ওঠার চেষ্টার সেরা ঠিকানা।
এই করোনা কালের পর পিটার ক্যাট বিধি মানতে অনেক বদল এনেছে। ঢোকার মুখে তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র, তো ভিতরে দুই টেবিলের মাঝে কাচের দেওয়াল। কিন্তু যেটা বদলায়নি সেটা একটা আলো আঁধারিতে ঘেরা শুধু রমণীয় পরিবেশ শুধু নয়, অসাধারণ খাবার পরিবেশনের এত বছরের ঐতিহ্য। পিটার ক্যাট নামক রেস্তোরাঁর আি ‘গুগলি’ নেই। শেন ওয়ার্নের মতো অনে বল দেরিতে ভেঙে এমনভাবে উইকেট আমাদের সঙ্গে, মানে আমরা যারা পঞ্চাশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, তাদের সঙ্গে পিটার ক্যাটের যখন প্রথম পরিচয়, তখনও পার্ক স্ট্রিটের এই রেস্তোরাঁ এত ‘আইকনিক’ হয়ে ওঠেনি, খোদ রাহুল গান্ধী কলকাতায় এসে পিটার ক্যাটের চেলো কাবাব খেয়ে দেশ জুড়ে চর্চার কেন্দ্রে নিয়ে যাননি। কিন্তু আমাদের বয়সের প্রায় সমান সমান পিটার ক্যাট ধীরে ধীরে নিজের যে ‘ব্র্যান্ড ইকুইটি’ বা সুনাম অর্জন। করেছে, তাই আজও এই রেস্তোরাঁর প্রধান ফিক্সড ডিপোজিট। রাহুল গান্ধী এসে। এবং চেলো কাবার চেখে হয়তো পিটার ক্যাটকে সর্বভারতীয় চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে গেলেন, কিন্তু তার আগে থেকেই কিন্তু পিটার ক্যাটের এই ইরানীয় ডিশ নিয়ে কলকাতার খাদ্যরসিকদের উচ্ছ্বাসের অন্ত ছিল না। “মার্কিনী ফাস্ট ফুড’গুলোর কল্যাণে যখনও অবধি আমরা কম্বো মিল জানি না, তখন থেকেই পিটার ক্যাটের চেলো কাবাবের ডিশ আসলেই একটা ‘কম্বো প্যাক’। কাবাব আছে, ডিম আছে, সবজি আছে, আর আছে মাখন লাগানো ভাত। ঠিক তেহেরানের কোনও রেস্তোরাঁয় এই ইরানীয় ডিশ’কে যেভাবে পরিবেশন করা হয়, পিটার ক্যাটের হয়তো তার রকমফের আছে। কিন্তু এই যে এত কিছুর সমাহার, তাতে মুগ্ধ না হয়ে বাঙালি খাদ্যরসিক যাবেন কোথায়? পিটার ক্যাট নামক রেস্তোরাঁর আস্তিনে অবশ্য শুধু চেলো কাবাবের মতো গুগলি” নেই।
শেন ওয়ার্নের মতো অনেক ‘স্লোয়ার ডেলিভারি’ও আছে। যেখানে “ বল দেরিতে ভেঙে এমনভাবে উইকেট তুলে নিয়ে যাবে, যে খাদ্যরসিকদেরও খেয়াল থাকবে না। যেমন ধরা যাক মটনের বিভিন্ন ডিশ। এমন তুলতুলে করে রান্না করা মটন, যে জিভে জল আসবেই। তার উপর আগেই বলেছি বিভিন্ন ধরনের সিজলার পিটার ক্যাটের তূণে রয়েছে। চিকেন, ফিস, মাটন সিজলারের পাশাপাশি বড় আকর্ষণ স্পেশাল ননভেজ সিজলার, যাতে একই পাত্রে রয়েছে মটন, চিকেন, চিংড়ি, ডিম এবং হরেক রকমের সবজি। জার্মানির বিখ্যাত সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস যেমন চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউয়ের একটি পানশালায় খেয়ে এবং আড্ডা দিয়ে বিখ্যাত করে দিয়েছিলেন, তেমনই রসিকজনদের পান-ভোজনের জন্য পিটার ক্যাটের খ্যাতি কম নয়। ‘পান’-এর জন্য সব আয়োজন পার্ক স্ট্রিটের এই রেস্তোরাঁয় যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে দারুণ সব স্টার্টার। পিটার ক্যাটের ব্যাটিং অর্ডারে ওপেনিংয়ে যদি এইসব থাকে, তাহলে মিডল অর্ডারে তো সিজলার থেকে চেলো কাবাবের মতো দুরন্ত সব ব্যাটসম্যান রয়েইছে। আর একেবারে শেষ পাতে যে সব মিষ্টি কিংবা আইসক্রিম রয়েছে, সেগুলো মারকাটারি। এই ভোটের আবহে যখন চারপাশে উত্তাপ বাড়ছে, তখন পার্ক স্ট্রিটের এই রেস্তোরাঁয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ঢুকে পড়লে মন্দ কী!