সাগরের বুকে এক অভিশপ্ত জাহাজ ফ্লাইং ডাচম্যানের কাহিনি, রূপকথা নাকি সত্যি
শুধুমাত্র বিদ্রোহ দমন করেই ক্ষান্ত হলেন না ক্যাপ্টেন, তাদের নেতাকে হত্যা করে ছুড়ে ফেলে দিলেন উত্তাল সমুদ্রে

The Truth of Bengal: ঘন কালো মেঘ জমে রয়েছে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে, আবহাওয়া পুরো থমথমে, বারবার আকাশটাকে দেখে মনে হচ্ছে এই হয়তো সজোরে নেমে আসবে বারির ধারা। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরেও তেমন কোনও বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারলেন না, জাহাজের ক্যাপ্টেন হেড্রিক ভ্যান ডের ডেকেন। দক্ষিণ আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূল ঘেঁষে নিজ শহর আমস্টারডামে ফিরছে বাণিজ্য জাহাজ ফ্লাইং ডাচম্যান। সিল্ক, রঞ্জক আর মশলা নিয়ে নেদারল্যান্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্যাপ্টেন ডেকেনের বাণিজ্যতরী।
সমুদ্রের মাঝে একাধিকবার প্রকৃতির বিরূপ চেহারা দেখেছেন নাবিকেরা। তাই এই পরিবেশেই তারা যুদ্ধ করতেও অভ্যস্ত। শোনা যায় নাকি, এদের মধ্যে কিছু দাগী আসামিও রয়েছে। ওরা ভয় পায় না, কিন্তু এবারে আকাশের রুদ্ররূপটা যেন একটু বেশি ভয়ানক। মনে আতঙ্কের হানা দিচ্ছে হড়পা বানের মতো। তা সত্ত্বেও জাহাজ এগিয়ে চলেছে কেপ অব গুড হোপ নামের এক অন্তরীপের দিকে। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নির্দেশে জাহাজ নিয়ে বাণিজ্য অভিযানে বের হওয়া পোড় খাওয়া নাবিক তিনি।
যাকে কেপ এফ গুড হোপ বলা হয়, আগে তার নাম ছিল, ‘কেপ অব স্ট্রম’। কারণ সামুদ্রিক ঝড় আর সমুদ্রের অগভীর উপকুলে পড়ে থাকা বড় বড় পাথরের চাইঁয়ের ভয়। কোথায় কখন জাহাজে ধাক্কা খায়, আর চিড় ধরে! ফলত গুড হোপ হলেও, ভয়ঙ্কর অন্তরীপই সেটা, আর এই পরিবেশে যেন আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। ১৪৮৮ সালে পর্তুগিজ অভিযাত্রী বার্টলোমিউ ডায়াস, যিনি প্রথম ইউরোপীয় নাবিক এই অঞ্চলে এসেছিলেন, তিনিই এর এই নাম দেন।
দূরবীন দিয়ে দেখা অন্তরীপ যতই কাছে এগিয়ে আসতে লাগল, নাবিকদের মনের চঞ্চলতা বাড়ল। সেই সঙ্গে বদলাতে শুরু করলো আবহাওয়া। একাধিকবার অনুরোধ করা হয়েছিল ক্যাপ্টেনকে জাহাজ থামানোর। কিন্তু তিনি রাজি ছিলেন না, তাঁর অবশ্য যুক্তি ছিল, সময় থাকতে এগিয়ে যাওয়াই ভালো। নয়তো সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ে পড়লে, জাহাজের ছিন্ন ভিন্ন অবস্থা হতে পারে। যদিও নাবিকরা ভাবতে শুরু করল- এই ঝড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার দুটো কারণই হতে পারে। হয় তাদের ক্যাপ্টেন মদের নেশায় বুঁদ হয়ে রয়েছে, নয়তো বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। ক্যাপ্টেনের বিরুদ্ধে নাবিকদের একটি দল কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। বিদ্রোহীদের কাবু করলেন ক্যাপ্টেন। শুধুমাত্র বিদ্রোহ দমন করেই ক্ষান্ত হলেন না ক্যাপ্টেন, তাদের নেতাকে হত্যা করে ছুড়ে ফেলে দিলেন উত্তাল সমুদ্রে। বার্তা দিলেন, তার কাজে বাধা দিয়ে পরিণাম এই হবে।
এই কাহিনি ইতিহাস নাকি রূপকথা, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। সমুদ্রঝড়ের কবলে পড়ে এর বাণিজ্যতরী কীভাবে একটি নতুন অন্তরীপে পৌঁছল তা নিয়ে বহু চর্চিত কাহিনী রয়েছে। কিন্তু সেই কাহিনিতে যখন, বিশেষ রূপকথা ঢুকে পড়ে, তখন তার কাহিনি আরও রঙিন হয়ে ওঠে। বিদ্রোহী নেতার মৃতদেহ সমুদ্রে নিক্ষেপ করার পর দেবদূত নেমে আসে জাহাজে, জাহাজের তখন অন্তিম লগ্ন উপস্থিত। নিজেকে আর নিজের জাহাজকে রক্ষা করতে তখন ক্যাপ্টেন সেই দেবদূতের কাছে অদ্ভুত এক প্রতিজ্ঞা করে। সেই প্রতিজ্ঞা ছিল, যতদিন পৃথিবী বেঁচে থাকবে, ততদিন সে আর তার জাহাজ ফ্লাইং ডাচম্যান সমুদ্রের মধ্যে বিচরণ করতে থাকবে।
এই কাহিনীর আরও একটি রূপও রয়েছে, জাহাজে একাংশ নাবিকদের বিদ্রোহ দমনের পর, তুমুল ঝড়ের মুখে পড়ে পড়ে ফ্লাইং ডাচম্যান যখন অন্তিম প্রহরের অপেক্ষায়, তখনই ক্যাপ্টেন চিৎকার করে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যে করেই হোক অন্তরীপের কাছে তিনি পৌঁছাবেনই, তাতে যদি বিপর্যয় চূড়ান্ত রূপ নেয় তা নিক।
ফ্লাইং ডাচম্যান জাহাজ নিয়ে আরও কিংবদন্তী রয়েছে, নাবিকদের যে নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল, মৃত্যুর আগে তিনি অভিশাপ দিয়েছিলেন, প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়েও এই জাহাজ ধ্বংস হবে না, সেই সঙ্গে এই জাহাজ আর কোনও দিন কোনও বন্দরেও পৌঁছবে না। পৃথিবীর শেষ সময় পর্যন্ত সমুদ্রের আনাচে কানাচে মাঝসমুদ্রে ঘুরেই বেড়াতে হবে।
সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ফ্লাইং ডাচম্যান জাহাজের কাহিনি ঘুরতে থাকে। মূলত ইউরোপীয় কোনও জাহাজ সমুদ্রের মধ্যে যখনই পাড়ি দিত, তাদের কাছে নতুন আতঙ্ক হয়ে আসত ফ্লাইং ডাচম্যান জাহাজের কাহিনি। সবসময় আতঙ্কে থাকতেন এই হয়তো মুখোমুখি হতে হবে ফ্লাইং ডাচম্যানের।
ইতিহাসের পাতায় এক অদ্ভুত কিংবদন্তীতে পরিণত হওয়া এই জাহাজকে নিয়ে জন্ম নিয়েছিল নানা রহস্যময় কাহিনি। আচমকা কোনও জাহাজের খুব কাছে আবর্তিত হওয়া, পাল তুলে পূর্ণ গতিতে অন্য জাহাজকে ধাওয়া করে চোরা পাথর বা প্রণালীতে ধাক্কা খাইয়ে ডুবিয়ে দেওয়া, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াতে দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে যাওয়া, এমনকি চলতি পথে পাশ দিয়ে যাওয়া জাহজে অভিশপ্ত চিঠি বা বার্তা পাঠানোর কাহিনী। শোনা যায়, সমুদ্রের মাঝে জাহাজ চলার সময় এক অদ্ভুত কুহেলির মধ্যে দিয়ে প্রকট হত ফ্লাইং ডাচম্যান জাহাজ। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উড়ে আসত এক চিঠি, সেখানে বার্তা থাকতো অপঘাতে মৃত্যু অবসম্ভ্যাবী। আর সেই জাহাজে সত্যিঅ নেমে আসত বিপর্যয়। আর এটা হত নাকি ডাচম্যানের অভিশাপের কারণেই।
ইউরোপীয় নাবিকদের জনশ্রুতিতেই যে ফ্লাইং ডাচম্যানের কথা ঘুরে ফেরে তা নয়, লিখিত নথিতেও উল্লেখ পাওয়া যায় এই অভিশপ্ত জাহাজের। জন ম্যাকডোনাল্ড নামের একজন ভ্রমণকারীর লেখায় প্রথমবারের মতো উল্লেখ পাওয়া যায় এই রহস্যময় বাণিজ্যতরীর কথা। ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকার সমুদ্রে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন ম্যাকডোনাল্ড। তাঁর বইটি প্রকাশ পায় ১৭৯০ সালে। সেই বইয়ের একটি অংশে তিনি উল্লেখ করেন, প্রতিকূল আবহাওয়ার মাঝে দিয়ে জাহাজ চলার সময় নাবিকদের বলতে শুনলাম তারা ফ্লাইং ডাচম্যানকে দেখেছে। প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী, প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ে ফ্লাইং ডাচম্যান কেপের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছিল আর চেয়েছিল সেখানে আশ্রয় নিতে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ ছিলো ডাচম্যানের। দিক নির্দেশ করে বন্দরে নিয়ে যাবার মতো কোনও পাইলট বোট সেসময় উপস্থিত ছিল না। তাই কোনোদিনই আর বন্দরে ফেরা হয়নি ফ্লাইং ডাচম্যানের। প্রবল ঝড়ের মুখে পড়ে, সেই জাহাজ হারিয়ে যায় চিরদিনের মতো।
১৮৩৫ সালে আর এক ব্রিটিশ জাহাজের ক্যাপ্টেনের লেখা থেকে জানা যায়, কীভাবে তারা ভৌতিক এক জাহাজের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। তাদের জাহাজের সামনে আচমকাই উপস্থিত হয়েছিল ভৌতিক জাহাজ। দুটি জাহাজের মুকোমুখি যখন নিশ্চিত, তখনই মিলিয়ে যায় সেই জাহাজ। পুরোটাই যেন স্বপ্নের মতো ঘটে।
শুধু যে সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাহাজের নাবিকেরাই এই ভৌতিক জাহাজকে দেখেছেন তা নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে গ্লেনকেইন বিচে রৌদ্রস্নান করতে আসা একদল পর্যটক, সমুদ্র সৈকতে বসেও ফ্লাইং ডাচম্যানকে দেখেছিলেন বলে দাবি করেছিলেন। ১৯৩৯ সালে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, পালতোলা একটি ভৌতিক জাহাজ তীব্র বেগে তীরের দিকে ছুটে আসছিল, আর তারপর হঠাৎ করেই সেই জাহাজ বাতাসে মিলিয়ে যায়।
পরবর্তী সময়ে ফ্লাইং ডাচম্যান নিয়ে যে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাহিনি রয়েছে, তা আরও অবাক করার মতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মান এক সাবমেরিন থেকে এই দাবী করা হয়েছিল। এক ভৌতিক জাহাজকে জলের তলায় দেখা গিয়েছে, প্রথমে মনে করা হয়েছিল, কোনও জাহাজ ডুবি হয়েছে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ভ্রম কাটে। জাহাজটি সাবমেরিনের দিকে এগিয়ে এসেই মিলিয়ে যায়। ভৌতিক জাহাজের গতিপথ এড়াতে, ডুবোজাহজটিকেও পথ বদলাতে হয়েছিল।
তিনশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা এই কিংবদন্তীর শুধুমাত্র লোককথাতেই আটকে নেই। জায়গা করে নিয়েছে, গল্প, উপন্যাস ও সিনেমায়। বর্তমান সময়ে ফ্লাইং ডাচম্যান নামটা শুনলেই অনেকের সামনে ভেসে ওঠে পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ানের ফ্লাইং ডাচম্যানের কথা। এই সিনেমাতে অবশ্য মূল কাহিনি থেকে অনেকটাই আলাদাভাবে দেখানো হয়েছে ফ্লাইং ডাচম্যানকে। তবে রূপকথার সেই জাহাজ, আরও শতাব্দী পার করে কীভাবে সমুদ্রের মধ্যে বেঁচে থাকবে, আর কত নতুন কাহিনির জন্ম দেবে, সেটাই এখন দেখার।