কলকাতাফিচার

‘প্রমিস’ রক্ষা করতে কত ‘মাইল’ যেতে পারেন মমতা?

How many 'miles' can Mamata go to keep her 'promise

The Truth of Bengal,সুমন ভট্টাচার্য: 

দ্য উডস আর লাভলি, ডার্ক অ্যান্ড ডিপ,

বাট আই হ্যাভ প্রমিসেস টু কিপ,

অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ,

অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ।

রবার্ট ফ্রস্টের লেখা এই চারটি লাইন ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নাকি এত প্রিয় ছিল, যে তিনি তাঁর নিজের টেবিলে ওই চারটি লাইনকে বাঁধিয়ে রেখে দিয়েছিলেন। অমিতাভ বচ্চনের পিতা, বিখ্যাত হিন্দি কবি হরিবংশ রাই বচ্চন ওই চারটি লাইনের অসামান্য হিন্দি অনুবাদ করেছিলেন। যদি ভাবেন রবার্ট ফ্রস্ট বা নেহরুর প্রিয় কবিতায় ফিরে যাওয়া কেন, তাহলে জেনে রাখা ভাল ভারতবর্ষের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শেষ আমেরিকা সফরের সময় তাঁকে রবার্ট ফ্রস্টের নির্বাচিত কবিতা সংকলনই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু শনিবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার প্রমাণ করলেন, মানুষের কাছে ‘প্রমিস’ করা থাকলে কতটা ‘মাইল’ তিনি যেতে পারেন।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোজা পৌঁছে গেলেন স্বাস্থ্যভবনের সামনে অবস্থানরত ডাক্তারদের ধর্না মঞ্চে।

এই যে মানুষের স্বার্থে, বা রাজনীতিতে করা ‘প্রমিস’ অর্থাৎ প্রতিশ্রুতির স্বার্থে তিনি এক্সট্রা মাইল চলতে পারেন, তা তিনি আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন। একজন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে তিনি এর চাইতে বেশি আর কী-ই বা করতে পারেন! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্না মঞ্চে পৌঁছননি, বরং আরজি করের নির্যাতিতার বিচার চাওয়ার লড়াইতে একজন ‘সহযোদ্ধা’ হিসাবেই স্বাস্থ্যভবনের সামনে ধর্না মঞ্চে গিয়েছেন। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর নিয়ে আবার শুনানি হওয়ার কথা। তার আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দেখিয়ে দিলেন, নির্যাতিতার বিচার হোক কিংবা রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার অচলাবস্থা কাটাতে উদ্যোগী হওয়া, কোনও কিছুতেই তাঁর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সদিচ্ছার অভাব নেই।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাস্থ্যভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নায় পৌঁছে যাওয়ার পর দেখলাম সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যে বিরোধীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুণ্ডপাত করছিলেন, সেখানে ‘শ্মশানের নীরবতা’। আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক বিরোধীরা এবং যেসব ‘এলিট’রা নিত্যদিন তাঁর সমালোচনা করে থাকেন, তাঁরা এখনও তাঁকে চেনেনই না। একজন বামপন্থী দেখলাম মন্তব্য করেছেন, “উনি কি জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন? না ওঁর নিজের ভোটব্যাঙ্ক, গ্রামের মানুষদের জন্য বক্তব্য রাখছিলেন?” এইটা দেখে ভাল লাগল অন্তত সিপিএম এটা বুঝেছে যে গ্রামের মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই শোনে এবং তাঁকে বিশ্বাস করে।

কিন্তু আর একটু এগিয়ে সিপিএমের নেতা, কর্মী এবং সমর্থকরা যদি বুঝতে পারতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিদিন রাজনীতির অঙ্গণটাকে তাঁদের জন্য কতটা বড় করে দিয়ে যাচ্ছেন এবং তথাকথিত বাম আর অতি বামেদের জন্য কতটা কঠিনতম রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৃণমূল নেত্রী তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তিনি পরিসংখ্যান দিয়ে জানিয়েছেন সরকারি হাসপাতালে কর্মবিরতি চলার কারণে এখনও পর্যন্ত কতজন মারা গিয়েছেন, এবং সেই ২৯ জনের পরিবারকে তিনি সরকারি তরফে ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন।

আবার বৃহস্পতিবার নবান্নের বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থানে হামলা চালানোর বিষয়ে যে অডিও টেপ ভাইরাল হয়েছে, তারই ভিত্তিতে রাজ্যের পুলিশ সিপিএমের এক যুবনেতা এবং এক অতি বাম রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। এর পরে শনিবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্না মঞ্চে পৌঁছে জুনিয়র ডাক্তারদের আশ্বস্ত করেছেন, যে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, কিন্তু তাঁরা কাজে ফিরুন।

অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে যেমন তিনি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চাইতে আসা প্রান্তিক মানুষদের সমস্যা বুঝেছেন, তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তেমনই তিনি নিজের ‘সর্বস্ব’ দিয়ে অচলাবস্থা কাটাতে ধর্না মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছেন। রাজনীতিক হিসাবে বা প্রশাসক হিসেবে তিনি কত দূর যেতে পারেন, তার একটা প্রমাণ হয়তো তিনি রাজ্যবাসীর কাছে রেখে দিলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বৃহস্পতিবার নবান্নে সরকারের সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের বৈঠক ভেস্তে গিয়েছিল চিকিৎসকদের তরফে আলোচনার ‘লাইভ স্ট্রিমিং’ করতে হবে এই দাবির কারণে। শনিবার কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যখন ধর্না মঞ্চে এলেন, তখন চারপাশে কম টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না এবং তাঁরা এইদিন মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ‘লাইভ’ই দেখায়।

রাজনীতিতে এবং যুদ্ধে ‘অভিজ্ঞ’রা একটা কথা প্রায়ই বলেন, নিজের ঠিক করা সময়ে, নিজের ঠিক করা মাঠে সবসময় লড়তে হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শনিবার আবার সেটা দেখিয়ে দিলেন। বৃষ্টিস্নাত শনিবারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্না মঞ্চে গিয়ে পৌঁছোবেন, এই কথা তাঁর মন্ত্রিসভার সহকর্মীরা তো দূরের কথা, তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ জনেরাও জানতেন না। তৃণমূল নেত্রী দেখালেন, যে তিনি নিজের সময় এবং নিজের মঞ্চ ঠিকই বেছে নিতে পারেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নির্ণায়ক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে মিত্রশক্তির ‘নরম্যানডি ল্যান্ডিং’। ইউরোপে জার্মানদের পরাজিত করতে মিত্রবাহিনী কোথা দিয়ে আঘাত করবে, এটা নাকি ধুরন্ধর জার্মান সেনাপতি রোমেল আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু নাজিদের কাছে দুর্ভাগ্যের বিষয়, আর আমাদের কাছে সৌভাগ্যের, যে হিটলার ইউরোপের ওই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রোমেলকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তাই ‘নরম্যানডি ল্যান্ডিং’ ইউরোপে জার্মান বাহিনীর পরাজয়কে নিশ্চিত করে দেয়।

আবারও আমাদের কাছে সুখের বিষয়, যে এই রাজ্যের বিজেপির কাছে কোনও ‘রোমেল’ও নেই, যে তাঁদের বলে দেবে কখন এবং কোন পথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে স্বাস্থ্যভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্না মঞ্চে এসে উপস্থিত হবেন! বেচারি গেরুয়া শিবির! বিজেপি স্বাস্থ্যভবনের পাশে তাঁদের সাজানো গোছানো দফতর খুলে দিলেন জুনিয়র ডাক্তারদের জন্য, আর আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা এসে সেখানে ‘বাথরুম’ সেরে চলে গেলেন। আর অন্যদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোজা পৌঁছোলেন আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের ধর্না মঞ্চে।

অনেকদিন আগে লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার এবং মমতা-ঘনিষ্ঠ পূর্ণ অ্যাজিটক সাংমা আমাকে বলেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মোস্ট আনপ্রেডিক্টেবল পলিটিশিয়ান’। উত্তর-পূর্বের রাজনীতিক সাংমার মন্তব্যে সোৎসাহে মাথা নেড়েছিলেন দিল্লির রাজনীতির আর এক বর্ণময় চরিত্র জর্জ ফার্নান্ডেজ। আসলে তো সত্যিই এটা আন্দাজ করা মুশকিল যে তৃণমূল নেত্রীর পরের পদক্ষেপ কী হতে চলেছে! শনিবার তিনি আবার প্রমাণ করে দিলেন, নিজের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকে রক্ষা করবার জন্য, জনগণের কাছে করা ‘প্রমিস’কে সম্মান জানাতে তিনি কত ‘মাইল’ চলতে পারেন। বৃষ্টিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পছন্দ করেন। আর শনিবার সেই বৃষ্টিকে মাথায় করেই তিনি পৌঁছে গেলেন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে।

Related Articles