ফিচার

ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাওয়া এক বীর যোদ্ধা লাচেত বরফুকানের কাহিনি

Lachit Barfukan a hero of Aham

The Truth of Bengal: ভারতের ইতিহাসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের কথা লিপিবদ্ধ করা আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, তার মধ্যে কিছু যুদ্ধের ইতিহাস, সাম্রাজ্যের কথা, শিল্প, সংস্কৃতির কথাই উল্লেখ করা আছে। কিন্তু এমন অনেক ইতিহাস রয়েছে, যা ভারতের ইতিহাসকে গর্বের অনন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। কিন্তু তা যেন হারিয়ে গিয়েছে ইতিহাসের চোরাবালিতে। যুদ্ধ ছাড়াও এমন কিছু যোদ্ধার ইতিহাস পাওয়া যায়, যা ভারতের শৌর্যকে অনন্য জায়গায় স্থান দিয়েছে। মহারাণা প্রতাপ, পেশোয়া বাজিরাও, ছত্রপতি শিবাজি এনাদের মতোই আর এক যোদ্ধার নাম পাওয়া যায়, তিনি হয়তো এতোটা জনপ্রিয় নন, নাম লাচেত বরফুকান। তাঁর নাম জড়িয়ে রয়েছে বিখ্যাত সরাইঘাট যুদ্ধের ইতিহাসে।

১৬৭১ সালে সরাইঘাট যুদ্ধ হয়েছিল মুঘল ও অহম সাম্রাজ্যের মধ্যে। যা একটা সময় অবস্থিত ছিল ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে, বর্তমানে গুয়াহাটি শহরে অবস্থিত। এই যুদ্ধ ইতিহাসের পাতায় ততটাই গুরত্বপূর্ণ, যতটা হলদিঘাট বা ঝাঁসির লড়াই। কারণ এই লড়াই হয়েছিল জলপথে ও স্থলপথে।

১২২৮ খ্রিস্টাব্দে অহম সাম্রাজ্যের সূচনা হয়, আর এই সাম্রাজ্য চলেছিল ১৮২৬ পর্যন্ত। প্রায় ৬০০ বছর চলেছিল অহম সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যের চাকা গড়িয়েছিল সুকফা নামে এক রাজার হাত ধরে। তিনি এসেছিলেন মায়ানমারের শান প্রদেশ থেকে। জায়গাটি মূলত মায়ানমারের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। এরা এসেছিল পটকাই পাহাড় পার করে।

সময়ের সঙ্গে বিস্তার হয় এই সাম্রাজ্যের। পুরো ব্রহ্মপুত্র তট জুড়ে ছিল অহম রাজ্যের বিস্তার। সময়ের সঙ্গে রাজ্যের রাজধানীও বদল হয়েছিল, কখনও গরগাঁও, কখনও জোড়হাট। মধ্যযুগে অহম রাজ্যের রাজাদের বলা হত, অসম রাজা। যদিও স্থানীয়রা তাঁদের বলতেন চাওফা। চাও শব্দের অর্থ শাসক আর ফা শব্দের অর্থ স্বর্গ। চাওফার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, স্বর্গের শাসক। এই নামটি মূলত ব্যবহার হওয়া শুরু হয়, ১৬ শতাব্দী থেকে।

অহম রাজারা মায়ানমার থেকে আসার দরুণ, তাদের সংস্কৃতি ছিল ভারতীয় জনজাতিদের থেকে কিছুটা ভিন্ন। যদিও ভারতে আসার পর, তারা হিন্দু সংস্কৃতিকে আপন করে নেয়। স্থানীয় সংস্কৃতিও তারা গ্রহণ করতে শুরু করে এবং তার স্থানীয় লোকসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে। স্থানীয়দের কিংবদন্তি রয়েছে, অহম রাজারা দেবরাজ ইন্দ্রের বংশধর। ১৯০১ সালের জনগণনা অনুসারে অসমের ১০০ শতাংশ মানুষই নিজেদের অহম বলে উল্লেখ করেছিলেন। যদিও বর্তমান পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে এখনও ১০-২৫ শতাংশ নাগরিক আসলে অহম। অহম রাজ্যে, যাঁরা মন্ত্রী হতেন, তাঁদের মূলত ৫টি গুরুত্বপূর্ণ পদ থাকতো। সেগুলি হল, *বরঘোঘোঁয়াই, *বরঘোঁয়াই, *বরপাত্রঘোঁয়াই, *বরবড়ুয়া, *বরফুকান। বরফুকান সেনাপ্রধানকে বলা হত।

আগেই বলেছি, এই অহম রাজ্য চলেছিল প্রায় ৬০০ বছর। এই সাম্রাজ্য ছিল অজেয়, অর্থাৎ কারও কাছে হারেনি। মুঘলরাও হারাতে পারেনি। কিন্তু এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, ব্রিটিশ এবং মায়ানমারের যুদ্ধের সময়।

১৮১৭ থেকে মায়ানমারের সাম্রাজ্য লাগাতার অহম সাম্রাজ্যের উপর হামলা চালায়। ১৮২১ সালে অহম সাম্রাজ্য মায়ানমার বা বার্মার অধীনে চলে যায়। কয়েক বছর পর, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বার্মাকে হারিয়ে দেয়। এই সময় ইয়ান্ডাবো চুক্তি হয়। বার্মাকে বেশ কয়েকটি শর্তে আবদ্ধ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তার মধ্যে অন্যতম ছিল, অহম রাজ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দিতে হবে। সেই সময় পুরোপুরি অসামের উপর দখল জমায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং অহম সাম্রাজ্য শেষ হয়।

এর আগের ইতিহাসটাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ ১৬ এবং ১৭ শতাব্দীর। এই সময় উত্তরপূর্ব ভারতে বেশ কয়েকটি বড় স্বাধীন সাম্রাজ্য ছিল। পাশে ছিল কোচ সাম্রাজ্য, অধুনা কোচবিহার। উত্তরে ভুটান, দক্ষিণে জয়ন্তিয়া, পূর্বে মণিপুর, দক্ষিণ পূর্বে কাচার এবং ভারতের অধিকাংশই তখন মুঘল সাম্রাজ্যের অধীন। সেই সময় অবিভক্ত বাংলাও ছিল মুঘলদের দখলে। শুরু থেকেই মুঘল ও অহম সাম্রাজ্যের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না, প্রথম কারণ মুঘলরা প্রথমে কোচবিহারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। আর কোচবিহারের সঙ্গে অহমের শত্রুতা দীর্ঘ সময় ধরে ছিল। দ্বিতীয় কারণ, মুঘলরা চাইছিল উত্তর পূর্ব ভারতে দখল জমাতে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে আকবরের সময়কাল থেকেই। তৃতীয় কারণ, ব্রহ্মপুত্র তটে যত ঊর্বর জমি রয়েছে, সেগুলি নিজেদের দখলে রাখা।

যখন থেকে মুঘল অহম সাম্রাজ্য দখল নেওয়ার চেষ্টা করে, সেই সময় থেকে দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে, ফলে প্রভাব পড়তে থাকে বাণিজ্য এবং সীমানার ক্ষেত্রে। ১৬১৫ সালে মূল সমস্যার শুরু হয় কোচবিহারের কারণে। সেই সময় লড়াই শুরু হয় চলে ১৬৮২ পর্যন্ত। মাঝে ১৮টি বড় ধরণের লড়াই চলে। এই সময় ১৬১৫ সাল বা তার আশে পাশে কোচবিহারের দুই ভাইয়ের মধ্যে লড়াই শুরু হয়, রাজ্যটি দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাইকে মুঘলদের সমর্থন করে, অন্যজন অহমদের। এর পরেই সম্মুখ সমরে নামে অহম ও মুঘল সাম্রাজ্য। আর সেই লড়াই চলেছে ১৬৮২ সাল পর্যন্ত। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব বারবার আক্রমণ চালিয়েও প্রতিহত করতে পারেনি অহম সাম্রাজ্যকে।

অহম মুঘল লড়াইয়ের একটি পর্বে যার নাম স্বর্ণাক্ষরে রচিত হয়ে রয়েছে, তিনি হলেন লাচেত বরফুকেন। ১৬২২ সালে তাঁর জন্ম। বাবা ছিলেন মোমাই তামুলি। তিনি ছিলেন বরবড়ুয়া, অর্থাৎ একটি বড় অঞ্চলের প্রশাসক। লাচেতকে কলা, দর্শন, যুদ্ধ প্রশিক্ষণ এবং ধর্মীয় আচার রীতির প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। লাচেত অহম সাম্রাজ্যের ভিন্ন সেনাদলে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। পরে তিনি রাজ্যের সেনা প্রধান হয়ে ওঠেন।

১৬৬৭ সালে মুঘলরা গুয়াহাটিতে হামলা চালায় এবং দখল জমায়। ১৬৭১ সালে গুয়াহাটি ফের অহমের দখলে আনেন লাচেত। সেই যুদ্ধই সরাইঘাট যুদ্ধ বলে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। সেই সময় লাচেত ছিলেন সেনাপ্রধান।

লাচেতকে ঘিরে বেশ কিছু কিংবদন্তি রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম, সরাইঘাট যুদ্ধের সময় যখন তিনি নিজের সেনার বিশেষ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেই সময় প্রতিরক্ষার স্বার্থে একটি দরজা তৈরির কাজ দেওয়া হয় তাঁর মামাকে। তাঁর মামা সেই কাজ সম্পূর্ণ করেনি। কাজ ঠিক হয়েছে কিনা দেখতে গিয়ে দেখেন প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত কাজ অসম্পূর্ণ, সেই সময় তার মামার মাথা দেহ থেকে আলাদা করে দেন তিনি। তিনি বার্তা দিয়েছিলেন, দেশের আগে পরিজন বলে কিছু হতে পারে না।

আরও এক ঘটনা শোনা যায়, সরাইঘাট যুদ্ধে একবার তিনি আহত হয়, শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন লাচেত। খবর পান সরাইঘাট যুদ্ধে অহম সেনা হারতে বসেছে, সেই সময় অসুস্থ অবস্থাতেই লাচেত জলপথে অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করেন। এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের বলেন, তোমরা চাইলে চলে যেতে পারো, আমি লড়াই চালিয়ে যাবো, তবে রাজাকে খবর দিও লাচেত বরফুকেন তাঁর দায়িত্ব থেকে পিছপা হয়নি।

১৬৬২ সালে মুঘল ও অহমের মধ্যে প্রথম লড়াই শুরু হয়। ১৬৬৭ সালে মুঘলের বিশাল সেনার দল বড়গাঁওয়ে পৌঁছে যায়। এবং অহম রাজাকে হারিয়ে দেয়। সেই সময় অহম রাজাকে একটা সন্ধি করতে হয়।  মুঘলকে বিশাল অঙ্কের টাকা এবং গুয়াহাটিও দিতে হয়। মূলত কামরূপ এলাকা মুঘলদের দখলে চলে যায়। এর পরেই লাচেতকে সেনাপ্রধান করা হয়, তারই নেতৃত্বে ১৬৬৭ সালে পুনরায় গুয়াটিতে হামলা চালায় অহম রাজা। এবং দখলে।

এই খবর ঔরঙ্গজেবের কাছে যখন যায়, তখন আমেরের রাজা রাম সিংকে পাঠানো হয়। তিনি রাজপুত ছিলেন। তিনি ছিলেন রাজা জয়সিংয়ের পুত্র। রাজস্থান থেকে সেনার দল আসে আসামে। ১৬৬৯ সালে অসমে হামলা চালায় মুঘল। সেই সময় অহমের রাজা ছিলেন চক্রধ্বজ সিংহ। যেহেতু মুঘল সেনার সংখ্যা বেশি ছিল, তাই লাচেত প্রথমে কথাবার্তার কৌশল নেয়। আসল উদ্দেশ্য ছিল, যুদ্ধের জন্য হাতে অতিরিক্ত সময় নেওয়া। ১৬৬৯ থেকে ৭০ পর্যন্ত লড়াই চলে, সেই সময় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল নেয় অহম সেনার দল। প্রায় দেড় বছর যুদ্ধ চলার পর সামনাসামনি যুদ্ধে নামে মুঘল এবং অহম। এই যুদ্ধে প্রায় অহমের প্রায় ১০ হাজার সেনার মৃত্যু হয়। দুর্বল হয়ে পড়ে অহম।  মারা যান, রাজা চক্রধ্বজ সিংহ। অলাবোই এলাকা মুঘলরা দখল নেয়।

সেই সময়ই চক্রধ্বজের ভাই উদাদিত্য সিংহ রাজা হন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, মুঘলদের বিরুদ্ধে আসল লড়াইটা চালাতে হবে গুয়াহাটিতে। যেহেতু ওই অঞ্চল পাহাড়ি এলাকা, তাই প্রতিরোধ গড়ে তোলা ক্ষেত্রে সুবিধা হবে। দ্বিতীয় বিষয় হল, গুয়াহাটি পার না করতে পারলে অহম রাজ্যের মূল অংশে ঢোকা মুশকিল। আসলে, অসমের পাহাড়ি এলাকা অহম সেনার অনুকূলে ছিল। পাহাড়ি এলাকা থাকার দরুণ হাতি ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধে করা মুঘলদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্র নদী, যা, গুয়াহাটি অঞ্চলে কোথাও ১ কিলোমিটার চওড়া, কোথাওবা সাত থেকে আট কিলোমিটার চওড়া, ফলে জলপথে মুঘলরা লড়াই চালিয়ে যাবে, এমন ক্ষমতাও ছিল না।

এদিকে রাজা রামসিংহের সেনা যেমন আগেই মোতায়েন করেছিল মুঘলরা, তেমনই বাংলা থেকে সুবেদার শায়েস্তা খাঁকে নৌসেনা দিয়ে গুয়াহাটি পাঠানো হয়। যুদ্ধ শুরু হয়, এই সময়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে লাচেত বরফুকান। কবিরাজেরা জানিয়ে দেয়, অসুস্থ শরীর নিয়ে যুদ্ধে করা ঠিক হবে না। এদিকে মুঘল সেনার দাপটে প্রায় পর্যুদস্ত অহম সেনা। এই খবর পাওয়ার পরেই, লাচেত নৌ পথে যাত্রা শুরু করেন। আর অসুস্থতার মধ্যেই বরফুকনের উপস্থিতি অহম সেনার মধ্যে বাড়তি শক্তি জোগায়। এখানেই প্রথম নৌকাসেতু তৈরি করে যুদ্ধ চালায় অহম সেনা।

যেখানে ছোট নৌকাগুলিকে জুড়ে সেতু বানিয়ে মুঘল সেনার ছাউনিতে হামলা চালায়। এই যুদ্ধে মুঘল সেনার বেশ কিছু কমান্ডারের মৃত্যু হয় এবং ৪ হাজার সেনার মৃত্যু হয়। পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে মুঘল সেনা। অগত্যা পিছু হটতে বাধ্য হয় তারা। সরাইঘাটের যুদ্ধের এই পর্বটি হয়েছিল ১৬৭১ সালে মার্চ মাসে। পরের মাসেই কামরূপ থেকে সেনা সরাতে বাধ্য হয় মুঘল। এক বছর পর ১৬৭২ সালে লাচেত বরফুকনের মৃত্যু হয়। এর পরেও মুঘল ও অহমের মধ্যে লড়াই চলতে থাকে, কখনও গুয়াহাটি, কখনও ইটাখুলি এলাকা দখল করে মুঘলরা। সেই সময় লাচেতের ভাই লালুক সোলা সেনাপ্রধানের কাজ করতে থাকে। ১৬৮২ সালে ফের একবার মুঘল ও অহমের মধ্যে চরম লড়াই হয়, এবং মুঘলরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি।  তার পর থেকে আর অহম সাম্রাজ্যের দিকে ঘুরে তাকায়নি মুঘলরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দখল করার আগে পর্যন্ত ২০০ বছর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই ছিল অহম সাম্রাজ্য।