বিনোদনরাজ্যের খবর

রমা থেকে মহানায়িকা হয়ে ওঠার কাহিনি

The story of Rama becoming a heroine

রাজু পারাল: আজও তিনি রয়ে গেছেন আপামর বাঙালির অন্তরে। একসময় লক্ষ লক্ষ দর্শকের হৃদয়ে ঝড় তুলত যাঁর হাসি। সাফল্যের পিছনে ছোটেননি অথচ একটা সময়ে একাই বক্স অফিস কাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন। যা অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর সাফল্যের একটা বড় খতিয়ান। তিনি বাঙালির মহানায়িকা সুচিত্রা সেন (১৯৩১-২০১৪)। তাঁর গ্ল্যামার, অনণুকরণীয় ভঙ্গিমা, হাসির বিচ্ছুরণ এমনিই যে, তিনি নায়িকার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে নিজের জন্য একটি জায়গা তৈরী করে নিতে পেরেছিলেন।

একমাত্র মহানায়ক উত্তমকুমার ছাড়া তাঁর কাছাকাছি যাওয়ার আশাও কেউ করতে পারেননি! মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর রোমান্টিক জুটি এক ইতিহাস। বাংলা ছবির সুদীর্ঘ ইতিহাসে উত্তম-সুচিত্রা জুটির বিকল্প কোনও দিন ছিল না, আজও নেই। পর্দায় তাঁদের রোম্যান্স দেখে আপামর বাঙালির মনের মধ্যে একটা প্রশ্নই জেগে উঠত, তাঁরা কি পর্দার বাইরেও একটি বিশেষ সম্পর্কে আবদ্ধ? যার সদুত্তর পাওয়া যায়নি দু’জনের কারও কাছ থেকেই।

মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের জন্ম ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল, বাংলাদেশের পাবনা জেলার গোপালপুরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁদের আদি বাড়ি যশোহর। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত কর্মসূত্রে থাকতেন পাবনায়। মা ইন্দিরা দেবী ছিলেন আদর্শ গৃহবধূ। মুখেভাতের অনুষ্ঠানে পিসি বাণী দাসগুপ্ত আদর করে সুচিত্রার নাম রাখেন ‘রমা’। বাড়ির সকলে ডাকত ‘কৃষ্ণা’ বলে। তবে পাবনার মহাকালী পাঠশালায় খাতা কলমে তাঁর নাম কৃষ্ণা দাশগুপ্ত-ই পাওয়া যায়।

চার ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে সুচিত্রা ছিলেন পঞ্চম। ছেলেবেলায় সুচিত্রা পড়াশোনায় ভালো না হলেও নাচ-গানের প্রতি ছিল তাঁর অস্বাভাবিক ঝোঁক। চমৎকার গ্লাস পেন্টিং করতেন। বেড়ে ওঠার দিনগুলিতে সুচিত্রার দিন কাটত ইছামতী ও পদ্মার নদীর তীরে। এখানকার কাশবনে খেলে বেড়ানো, গাছে চড়ে ফল পাড়া, নৌকো দৌড় দেখতে দেখতে কাদায় আছড়ে পড়া ইত্যাদি ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার।

ক্লাস সেভেন থেকে সিনেমা দেখার নেশা চেপে বসে রমার মনে। সুযোগ পেলেই ছুটতেন পাবনার ‘অরোরা’ সিনেমা হলে, পরে যে হলটি ‘বাণী’ নামে পরিচিতি পায়।অভিনয়ে আসা তাঁর কোনদিনই ইচ্ছে ছিল না। দশচক্রে যেমন ভগবান ভূত হয়, ঠিক তেমনিই পাকেচক্রে ৩২ বি, বালিগঞ্জ প্লেসের অবস্থাপন্ন পরিবারের একমাত্র পুত্রবধূ কৃষ্ণা বা রমা সেন হতে শুরু করলেন সুচিত্রা সেন।

যখন রমা সিনেমায় এলেন, তখন পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত-র সহকারী নীতিশ রায় তাঁকে নাম দেন সুচিত্রা সেন। আস্তে আস্তে রমা মানুষের কাছে ‘সুচিত্রা সেন’ নামে পরিচিত হতে থাকেন, হারিয়ে যেতে থাকে আদরের নাম কৃষ্ণা বা রমা। কৃষ্ণা বা রমা সেন যে কোনওদিন সুচিত্রা সেন হয়ে উঠবেন, তা বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। ১৯৫২ সালে বীরেশ্বর বসুর ‘শেষ কোথায়’ ছবি দিয়েই সিনেমার জগতে প্রবেশ। যদিও সে ছবি মুক্তি পায়নি। ১৯৫৩ সালে ‘সাত নম্বর কয়েদি’ দিয়েই তাঁর অভিনয় জীবনের শুরু। ওই বছরেই মুক্তি পেয়েছিল উত্তম-সুচিত্রার প্রথম অভিনীত ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’।

ছবিটি সুচিত্রা সেনকে এনে দিয়েছিল অসামান্য সাফল্য। আরও একটি ছবি ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ ওই বছরেই মুক্তি পেয়েছিল। ছবিটিতে সুচিত্রার অসাধারণ অভিনয় ছিল চোখে পড়ার মতো। ২৫ বছরের অভিনয় জীবনে সুচিত্রা সেন অভিনয় করেছেন মাত্র ৫৩ টি বাংলা ছবিতে। যার মধ্যে ২৯ টি ছবিতেই তিনি মহানায়ক উত্তমকুমারের নায়িকা। মহানায়কের সাথে তাঁর অভিনীত সিনেমাগুলির কয়েকটি – অগ্নিপরীক্ষা, সবার উপরে, সাগরিকা, হারানো সুর, সপ্তপদী, অন্নপূর্ণার মন্দির, রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, মরণের পরে, শাপমোচন, সবার উপরে, শিল্পী, চন্দ্রনাথ, পথে হল দেরি, জীবন তৃষ্ণা, আলো আমার আলো, গৃহদাহ, কমললতা……..ইত্যাদি।

হিন্দি ছবিতেও সুচিত্রা সেন ছিলেন অনবদ্য। বরেণ্য পরিচালক বিমল রায় তাঁর প্রথম হিন্দি ছবিতে নিয়ে এলেন সুচিত্রা সেনকে। ১৯৫৫ সালে তিনি ‘দেবদাস’ ছবিটি পরিচালনা করলেন। যেখানে সুচিত্রার বিপরীতে নায়ক দিলীপ কুমার। ১৯৫৭ সালে সুচিত্রা সেন কাজ করেছিলেন হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘মুসাফির’ ছবিতে। দেবানন্দের বিপরীতে সুচিত্রা করেছিলেন রাজ খোসলা পরিচালিত ‘বোম্বাই কা বাবু’ ছবিটি। ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ মুক্তি পাবার পরই সুচিত্রা সেন সিদ্ধান্ত নেন চিরদিনের জন্য তিনি সিনেমা থেকে বিদায় নেবেন। নিয়েও ছিলেন।

শেষের দিকে তিনি আধ্যাত্মিক অমৃতের সন্ধান পেয়ে চিত্র তারকার জীবন থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেন। প্রায় ৩৬ বছর জনসমক্ষে না এলেও বেলুড় মঠে তিনি নিয়মিতই আসতেন। বেলুড় মঠের দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রটি গড়ার পিছনেও সুচিত্রার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অন্তরালে থাকলেও প্রতি বছরই দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন রাত্রে মেয়ে মুনমুনকে নিয়ে বেলুড়মঠে আসতেন। মহানায়িকা সুচিত্রা সেন অভিনয় জগতে থাকাকালীন বেলুড়মঠের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মহারাজ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজীর কাছে ১৯৭৩ সালে দীক্ষা গ্রহণ করেন। সুচিত্রা তখন থেকেই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। শেষদিকে সুচিত্রা সেন শ্রী শ্রী ঠাকুর, মা সারদামণি এবং স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়া কিছুই জানতেন না।

শ্রী রামকৃষ্ণের বাণী, স্বামীজির কথা, মহারাজদের সহচর্য এবং মঠের পরিবেশ তাঁকে শান্তির সন্ধান দিয়েছিল। পার্থিব জগতের মধ্যে থেকেও অপার্থিব সন্ধানের দিকে বরাবরই আগ্রহ ছিল তাঁর। তিনি একবার জানিয়েছিলেন, ‘গীতা’, ‘কথামৃত’র মতো একাধিক ধর্মীয় বই নিয়মিত পড়তেন তিনি। নির্দিষ্ট সময়ে জপ-ধ্যান-পুজোয় কাটাতেন প্রতিটি দিন। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি আমাদের ছেড়ে চিরকালের মতো চলে গেলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। শারীরিক অসুস্থতা আগেই ছিল। শেষ মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায় তাঁর হৃদস্পন্দন। মহানায়িকার ইচ্ছে অনুযায়ী চন্দনকাঠের চিতায় তাঁকে দাহ করা হয়। তিনি চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু বাঙালির অন্তর জুড়ে তিনি ছিলেন, তিনি আছেন, তিনি থাকবেন। এমনিই শাশ্বত চিরন্তন সুচিত্রা সেন। ২০১৪ সালে সকলের জন্য সুচিত্রার পৈতৃক বাড়িটি খুলে দেন পাবনা জেলা প্রশাসন। যেখানে এখন গড়ে উঠেছে ‘সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা’।

Related Articles