শুভঙ্করে কি ‘শুভ’ হবে প্রদেশ কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ
Will Shubhankar be 'good' for the future of the Pradesh Congress

Truth of Bengal, পার্থসারথি গুহ: প্রতিবছরই একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে আমাদের মনে। শুভ মহালয়া কি বলা যায়? বেশিরভাগ মানুষই আগুপিছু না ভেবে শুভ মহালয়ার শুভেচ্ছা জানিয়ে বসেন। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ উপচে পড়ে শুভ মহালয়ার বার্তায়। প্রবীণ শাস্ত্রজ্ঞরা অবশ্য মহালয়াকে শুভ বলার বিরোধী। তাঁদের সাফ কথা, পিতৃতর্পণ পূর্বপুরুষকে স্মরণের দিন। তাঁদের শ্রদ্ধা জানানোর দিন। একে কোনওমতেই শুভ বলা চলে না। শ্রাদ্ধের ক্ষেত্রে কী আমরা শুভ শ্রাদ্ধ বলি? সেরকম ব্যাপার আর কী!
সম্প্রতি রাজ্যে অন্য এক শুভর আবির্ভাব ঘটেছে। তিনি হলেন, প্রদেশ কংগ্রেসের নব মনোনীত সভাপতি শুভঙ্কর সরকার। শুভঙ্কর সরকার প্রদেশ কংগ্রেসের জন্য শুভ কিনা তা বোঝা যাবে আগামীদিনে। কিন্তু রাজ্যে কংগ্রেসের শূন্যে পরিণত হওয়ার রোগটা তিনি ধরতে পারছেন কী পারছেন না, সেটাই আপাতত সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। সিপিএম তথা বামেদের সঙ্গে জোট করাই যে কংগ্রেসের ভরাডুবির এক এবং অদ্বিতীয় কারণ আশা করি তিনি সেটা বুঝতে পারবেন।
আর শুভঙ্কর যত তাড়াতাড়ি এই রোগের উপশম ঘটাতে পারবেন, ততই রাজ্যে কংগ্রেসের জীবনীশক্তি বাড়বে। সাধারণ কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকরা যে সিপিএমের হাত ধরার তীব্র বিরোধী, সেই বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারলেই শুভঙ্কর অনেকটা এগিয়ে যাবেন। যে সিপিএমের হাতে কংগ্রেসের হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক খুন হয়েছেন, যে সিপিএম প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধিকে ‘বোফর্স-গান্ধি’ বলে দেগে দিয়েছিল, ‘গলি গলি মে শোর হ্যায় রাজীব গান্ধি চোর হ্যায়’ স্লোগান তুলেছিল, যে সিপিএম কংগ্রেস সরকারকে উৎখাত করার জন্য বিজেপির হাত ধরেছিল (শহিদ মিনারে বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী ও লালকৃষ্ণ আডবানির হাত ধরেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু) তাদের সঙ্গে জোট করা মানে আত্মহত্যার শামিল।
রাজ্যে বিধানসভা ভোটের আর বছর দেড়েক বাকি। তার আগে শুভঙ্করের নেতৃত্বাধীন প্রদেশ কংগ্রেস সমমনোভাবাপন্ন তৃণমূলের ঘাসফুল ধরুক বা একা লড়ুক, সিপিএম তথা বামেদের সঙ্গে যে আর যাবে না সেটা সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হবে। অধীররঞ্জনের মতো হারাকিরি যে শুভঙ্কর করবেন না, সেটাই বুঝেই হয়তো রাহুল গান্ধি তাঁকে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন।
প্রদেশ কংগ্রেসের সদ্য প্রাক্তন সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরিকে কার্যত অপসারিত করে শুভঙ্কর সরকারকে এই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছে কংগ্রেস হাইকমান্ড। তাঁরা একটা জিনিস পরিষ্কার বুঝেছেন, অধীররঞ্জন চৌধুরি আর বেশিদিন থাকলে প্রদেশ কংগ্রেসটা হয়তো অবলুপ্তই হয়ে যাবে রাজ্যে। সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে সেই দিশা আরও স্পষ্ট হয়েছে। বিগত লোকসভার দুটি আসনের মধ্যে কোনওক্রমে একটি আসন ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে কংগ্রেস।
তার আগের লোকসভা ভোটগুলি ধরলে এই রাজ্যে কংগ্রেসের অধঃপতন হয়েই চলেছে ক্রমাগত। কংগ্রেসের মতো সর্বভারতীয় দল যারা ২০১৪ এবং ২০১৯ য়ের বিপর্যয়ের রেশ কাটিয়ে এবারের লোকসভা নির্বাচনে কিছুটা পুনরুদ্ধার ঘটিয়েছে, তাদের কাছে পশ্চিমবঙ্গে দলের এই বেহাল অবস্থা রীতিমতো উদ্বেগের। প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতি যে রাজ্যে কংগ্রেসকে কার্যত গিনিপিগের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাও দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। সিপিএমের মতো সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট করা যে রাজ্যের অগণিত কংগ্রেস সমর্থক ভাল চোখে দেখছেন না তাও একের পর এক নির্বাচনের ফলে পরিষ্কার।
এবারের লোকসভা নির্বাচন তো সেটা আরও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। যে বহরমপুর প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীরবাবুর গড় হিসেবে পরিচিত, সেখানে রাজনীতিতে নবাগত জাতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেট তারকা তৃণমূলের ইউসুফ পাঠানের কাছে হারতে হয়েছে তাঁকে। গুজরাট থেকে একপ্রকার উড়ে এসে ইউসুফ পাঠান যেভাবে প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতিকে তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা কেন্দ্রে দুরমুশ করলেন তাও রাজ্য রাজনীতিতে অভূতপূর্ব। জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে নিশ্চিত আসন হারানো শুধু নয়, অত্যন্ত অমর্যাদাকর, অসম্মানেরও বটে। বস্তুত, কংগ্রেস হাইকমান্ড অনেকদিন ধরেই বুঝতে পারছিল অধীরবাবুর আমলে কীভাবে ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে প্রদেশ কংগ্রেস।
২০১৬ র বিধানসভা ভোটের আগে থেকে প্রদেশ কংগ্রেসকে পরীক্ষাগারের গিনিপিগ বানানো শুরু হয়েছে। যার মাস্টার মাইন্ড নিঃসন্দেহে অধীরবাবু এবং আলিমুদ্দিনের হর্তাকর্তারা। তার আগে পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর কংগ্রেস আর সিপিএমের মধ্যে জোট হতে পারে এটা ছিল আকাশকুসুম স্বপ্ন। কিন্তু সেটাই বাস্তবায়িত হল অধীররঞ্জন জমানায়। অপরদিকে তখন সিপিএম তথা বামেদের কাণ্ডারি হিসেবে সূর্যকান্ত মিশ্র। এমন কথাও সে সময় আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল যে কং-বাম জোট ক্ষমতাসীন হলে সূর্যবাবু হবেন মুখ্যমন্ত্রী। অধীররঞ্জন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
গল্পের গরু গাছে উঠলে যা হয় আর কী! মনে মনে অধীরবাবু দিল্লি ছেড়ে রাজ্য রাজনীতিতে মনোনিবেশ করার কথা ভেবেছিলেন কিনা সেটা এখন অতীতের গর্ভেই নিমজ্জিত। বেশ কিছু গণমাধ্যম প্রচার আরম্ভ করেছিল কংগ্রেস-বাম এর ‘হাসজারু‘ জোট ক্ষমতার খুব ধারে কাছে চলে আসছে। শাসকের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। পরিণাম কী হয়েছিল তা মানুষ দেখেছে। তৃণমূল দুশোর অনেক বেশি আসন জিতে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফেরে সেবার।
আর যে কংগ্রেসের হাত ধরে ৩৪ বছরের যখের ধন ফিরে পাওয়ার অলীক স্বপ্ন দেখেছিল বামেরা তাদের নিয়ে ভোকাট্টা হয় এই হজবরল জোট। তাও তো সেবার বেশ কিছু আসন জেতা গিয়েছিল। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে ফের সিপিএমের হাত ধরতে গিয়ে রাজ্যে সমূলে বিনাশ ঘটে কংগ্রেসের। সিপিএম তথা বামেদের মতোই শূন্যে নেমে আসে কংগ্রেস। সিপিএমের পচা শামুকে পা কাটার অবস্থা তৈরির জন্য অধীররঞ্জন চৌধুরিকেই কাঠগড়ায় চাপানো হয়েছিল।
তৎকালীন সভাপতি হিসেবে অধীরবাবু যাবতীয় ব্যর্থতার জন্য দায়ী ছিলেন। তাও তিনি বহাল তবিয়তে কংগ্রেস সভাপতি থেকে গিয়েছেন। একবারও তাঁর মনে হয়নি ব্যর্থতার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব নিয়ে সরে দাঁড়াই। রাজ্যে কংগ্রেসটা বাঁচুক। আসলে বহরমপুরে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন জেতার পর অধীর হয়তো ভেবেছিলেন এখনও রাজ্যে কংগ্রেস বলতে তিনিই। সে যতই বিধানসভায় শূন্য হয়ে যাক দল। সে জন্যই সমূহ বিপদ জেনেও প্রদেশ কংগ্রেসকে ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছিলেন। কংগ্রেসের বাঁচা-মরার চেয়েও অধীরের ইগোটা যেন বেশি হয়ে উঠেছিল।





