
Truth Of Bengal: তুহিনশুভ্র মণ্ডল: লেখার একদম শুরুতেই একটা অকপট স্বীকার করে নিয়ে চাই। কখনও কখনও হতাশ হয়ে কথার মাঝে কোনও কিছুর উদাহরণ প্রসঙ্গে বা উপমা দিতে গিয়ে ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ কিংব ‘রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি’ ব্যবহার করেছি ঠিকই, কিন্তু ভিতর থেকে আমি একজন গর্বিত বাঙালি। কেন? তার একাধিক কারণ আছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা ও বাঙালির অংশগ্রহণ, বাংলার মনীষী, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াই, বাঙালির ফুটবল এবং আরও কত কি!
একই সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহসী অংশগ্রহণ ও জয় ছিনিয়ে আনার জন্য বাঙালিদের লড়াই, আন্দোলন, আত্মত্যাগ, প্রাণবিসর্জন সমগ্র পৃথিবীতে একটা উদাহরণ। এই প্রসঙ্গে রাজশেখর বসুর স্মরণীয় উক্তি ‘বাঙালির হাজার বছরের যে ইতিহাস তাতে সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব হল মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালি জাতি একত্রিত হলে যে দা, শাবল, বটি, কুড়াল নিয়েও ট্যাঙ্ক, কামানের মোকাবিলা করতে পারে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই তার প্রমাণ।’
কবি সুনির্মল বসু লিখেছিলেন, ‘আমরা বাঙালি, এ কথা জানাই গর্বে ও গৌরবে বাংলার বুকে আজো বেঁচে আছে অতীতের সৌরভে’।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির যে অংশগ্রহণ ও লড়াই তা বাঙালি হিসেবে গর্বিত করে। সুভাষচন্দ্র বোস, বিনয়-বাদল দীনেশ, মাস্টারদা সূর্য সেন, বাঘা যতীনের লড়াই আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। পৃথিবীবাসী সামনে স্বামী বিবেকানন্দের
অনুপ্রেরণামূলক ভাষণ, যুবদের জন্য তাঁর পথ প্রদর্শন, ভ্রাতৃত্ব বোধে ভারতবাসীদের জাগিয়ে দেওয়া কোথায় আছে এমন নিদর্শনা ভয়াবহ সতীদাহ প্রথা রদে রামমোহন রায়ের অবিসংবাদী ভূমিকা, বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনন্য ভূমিকা পাল ছাড়া আর কোথায়?
যখন মানুষ নতুন মত ও পথের সন্ধান করছে, তখন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ, সারদা মায়ের দৃষ্টিভঙ্গি, পথ প্রদর্শন সীমাহীন এক আশ্রয়। ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ ঘুরে দেখেছি বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের কাছে স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ একটা অবলম্বন ও উজ্জীবনের নাম।
১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন তখন বিশ্ব চিনল বাঙালিকে। কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই তো তাঁর গান, লেখা, সমবায় উদ্যোগ পথ দেখিয়েছে বাঙালিকে। উত্তরণের সন্ধান দিয়েছে। বাঙালি হয়ে গর্ববোধ তো হবেই যখন দেখি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আন্তরিক অনুরাগীদের।
বাঙালির ইতিহাসে সেরা বিস্ময় যে রবীন্দ্রনাথ, এতে সন্দেহ নেই। তবে তিনিই তো বাঙালির একমাএ পরিচায়ক নন। জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বোস, রাজশেখর বসু, সত্যজিৎ রায়, অমর্ত্য সেনও গর্বিত বাঙালির পরিচয়। চলচ্চিত্রে জীবনকৃতি সম্মাননা হিসেবে সত্যজিতের অস্কার প্রাপ্তি, কল্যাণকর অর্থনীতিতে অমর্ত্য সেনের অর্থনীতিতে নোবেল বাঙালির নাম চিরভাস্বর করে রেখেছে পৃথিবীতে। এই কৃতবিদ্য বাঙালিদের উত্তরসূরী হওয়া যে গৌরবের, তা আর বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে!
বাঙালির ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দ্বৈরথকে ফিফা ডার্বি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশের ফুটবলে আছে এমন নজির? ফুটবলার হিসেবে পিকে, চুনী, ক্রিকেটার হিসাবে সৌরভ, খুলন, সাঁতারু হিসেবে বুলা চৌধুরী, দাবাড়ু হিসেবে দিব্যেন্দু বড়ুয়া বাঙালিকে দিয়েছে উজ্জ্বল সময়। সেই উজ্জ্বল সময় একজন বাঙালি হিসেবে আমাকেও আচ্ছন্ন করে রাখে। বাঙালি লেখক ঝুম্পা লাহিড়ী, অমিতাভ ঘোষের লেখা যখন ইংরেজি সাহিত্যে সাড়া ফেলে হয় তখনও গর্বে ভরে ওঠে বুক।
একবার নদী ও পরিবেশের জাতীয় সম্মেলনে দিল্লিতে মহারাষ্ট্রের এক নদী ও পরিবেশ কর্মী যে কথা বলেছিলেন, তা লেগে আছে। হিন্দিতে বলা কথাগুলো ছিল ‘আপনারা, বাঙালির এখনও কয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের গঠনে ও নানান ক্ষেত্রে যেভাবে অবদান রেখেছেন তা অন্য প্রদেশে কোথায়?’ বলাই বাহুল্য এই কথা শুনে একজন বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করেছি। এবং এই বোধ থেরে যাবে আজীবন বুকের ভিতর।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন একবার বলেছিলেন, ‘যদি ভারতবর্ষকে একখানা উপন্যাস মনে করেন, তবে বাঙালি তাহার নায়িকা! ভারতের পুরুষ সমাজে আমরা পুরুাষকা! অতএব আমর মূর্তিমান কাব্য!
বাংলার এই বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি আর তার বিপুলা সম্ভার অনল কোথাও পাই না। বাংলার মাটি দুর্বৃত্তদের বারবার নিরস্ত ও পরাস্ত করেছে। বাংলা একসময় ভারতকে পথ দেখিয়েছে। মহামতি গোখেলের কথা এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যাক- বাঙালি আজ যা ভাবে, ভারত আগামীকাল তাই ববে। সেই দিন কি আর আছে? নিজে একজন বাঙালি হয়ে বাঙালির প্রতি অভিমান, আত্মসমালোচনা কি নেই? অবশ্যই আছে।
তবু বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে এখনও রক্ত জেগে ওঠে, কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট…’ শৃঙ্খল মোচনের ডাক দেয়। ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি’ এবার ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে…’ আমাদের কাঁদিয়ে দেয়, গর্ব অনুভর করায় আর চিরকাল মনে করাবে দুটো দেশের চিরকালের এই পার রচনা করেছেন একজন বাঙালি। যিনি দেশ কালের ঊর্ধ্বে জেগে থাকা, জাগিয়ে রাখা এক বাঙালি, আপামর বিশ্ব যাঁকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে চেনে।
সৌজন্যে – কণ্ঠস্বর