খেলায় নেই নীতি, আছে রাজনীতি, আদালত আর অর্থ
There are no principles in the game, there are politics, courts and money

দীপঙ্কর গুহ (বিশিষ্ট সাংবাদিক): হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটে আড্ডা চলছিল। আমার সঙ্গে অন্য প্রান্তে বাংলার এক রাজ্যে সংস্থার শীর্ষ কর্তা। একটি প্রসঙ্গে সেই কর্তাটি লিখে বসলেন—‘সর্বভারতীয় সংস্থায় পদ পাওয়া মানে এখন রাজনৈতিক সমীকরণ ঠিক করে তবে বসা।’ এটা ব্যক্তিগত আলাপচারিতা। তাই তাঁর পরিচয় গোপনই রাখলাম। গোপন রাখলাম না ‘গোপনও কথাটি’।
দেশের অধিকাংশ জাতীয় সংস্থার মাথায় বসে আছেন সব রাজনৈতিক দলের (পড়ুন বিজেপি) ঘনিষ্ঠরা। আর এই রাজনৈতিক দল বলতে, সবচেয়ে আগে যারা এগিয়ে তারা ভারতীয় জনতা পার্টি অর্থাৎ বিজেপি। গেরুয়া বাহিনী।
সর্বভারতীয় ফুটবল সংস্থার সভাপতি কল্যাণ চৌবে। তিনি এই পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় জনতা পার্টির অন্যতম সক্রিয় প্রতিনিধি ছিলেন। এখনও আছেন। এখান থেকে প্রথমে সাংসদ নির্বাচনের সময় লড়াই করেছিলেন। হেরেছিলেন। পরে আবার বিধায়ক পদে লড়লেন। সেখানেও হারলেন। কিন্তু দেশের ফুটবল সংস্থার মাথা জায়গাটা কিন্তু ধরে রেখেছেন তিনি। কারণ একটাই, বিজেপির ঘনিষ্ঠ মানুষ বলেই। হতে পারে একসময় ফুটবলার ছিলেন। দক্ষতার সঙ্গে খেলেছেন ময়দানের বড় দলে। গোলরক্ষক ছিলেন।
রাজনীতিবিদ হয়ে নিজের ঘর সামলাতে না পারলেও তেকাঠির তলায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে গোল সামলাতে আর পরে ভারতীয় ফুটবলে দক্ষতার সঙ্গে নিজের গোলটি সামলে চলেছেন। বহু অভিযোগ, আদালতে মামলা চলা-– সবকিছু সামলে এখনও তিনি ফেডারেশন সভাপতি। আর তাঁর সময় ভারতীয় ফুটবল দলের যা পারফরম্যান্স তাতে লজ্জায় চোখ আর মুখ দুটোই ঢেকে ফেলতে হয়। হাল এতটাই খারাপ যে দলের হয়ে গোল করার জন্য অবসর নিয়ে ফেলা, ভারতীয় ফুটবল তারকা সুনীল ছেত্রীকে আবার মাঠে ফিরে আসতে হয়েছে। ভাগ্যিস ক্রিকেটে এই দুরবস্থা নেই। তা না হলে হয়তো সুনীল গাভাস্কার কিংবা কাপিল দেব কিংবা শচীন তেন্ডুলকরকে অবসরের পরও ভারতীয় দলের হাল ধরতে হচ্ছে– এটা দেখতে হতো।
আজ ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড মানেই বিজেপি বাবুদের রমরমা সেটা সকলে জানে। দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের একমাত্র তনয় জয় ভারতীয় বোর্ড সামলে ‘শাহজাদা’ হয়ে বিশ্ব ক্রিকেটের মসনদে বসেছেন। আর খবর মিলল ‘গুজু’ বিওসাদারি কারসাজি দেখিয়ে, সৌদি আরবকে ফুটবল ‘প্রেম’ থেকে ‘পরকীয়া’ ক্রিয়ায় ক্রিকেটে টেনে এনেছেন! ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করে না ওখানে ‘ক্রিকেট প্রিমিয়ার লিগ’ শুরু হয়। আইপিএলের যোগ্য টক্কর এবার হবে তেল দুনিয়ায়।
দুবাইতে এখন আইসিসি-র সদর দফতর। এবার কাতার ঐশ্বর্য ছড়িয়ে ফুটবলের পর ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজন না করে ফেলে। সব মায়া। নীতি নয়, রাজনীতির মায়া।
যাঁরা যাঁরা এখন ভারতীয় বোর্ডের সামনের সারিতে প্রত্যেকে বিজেপির ঘরের ছেলে বা মেয়ে। আর এইসব পদে বসার জন্য প্রয়োজনে আদালত পর্যন্ত দৌড়েছেন সব বাবুরা। একটা পরিসংখ্যান ঘাটছিলাম। তাতে দেখলাম, ১০ বছরে প্রায় ৭৭০টি বিচারাধীন কেস আছে আদালতে। ঘাটাঘাটি করে তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম যে এর মধ্যে ২০০-র বেশি আছে প্রশাসনিক অব্যবস্থা নিয়ে লড়াইয়ের জন্য। সেখান থেকেই বুঝতে পারলাম যে প্রায় ৭৭০টি আইনি লড়াই চলছে কোর্টে কিংবা সেন্ট্রাল ট্রাইবুনালে। মধ্যে ৪৬২টি আছে হাইকোর্টে (বিভিন্ন রাজ্যের) হাইকোর্টে আর ২২টি আছে সুপ্রিম কোর্টে।
একমাস আগের কথাই বলি। ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন বক্সিং ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া-এর নির্বাচনের ওপর স্থগিতাদেশ বহাল রেখেছিল। দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হল সর্বভারতীয় বক্সিং সংস্থা। সেই স্থগিতাদেশ খারিজ হয়ে গেল। আগামী ২৮ মার্চ নির্বাচন। তাতেও স্বস্তি নেই। হিমাচল প্রদেশের রাজ্য বক্সিং সংস্থা সরভারতীয় সংস্থাকে হুমকি দিয়ে বসল, যে প্রয়োজনে তারাও আদালতে চলে যাবে। কারণ কী? দেশের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের মনোনয়ন নাকি সর্বভারতীয় সংস্থা বাতিল করে দিয়েছে। সেই বিজেপি সংযোগ। আর এই লেখা লিখতে বসার সময় পর্যন্ত যেটুকু খবর পাচ্ছি তাতে সব পরিষ্কার। সর্বভারতীয় বক্সিং সংস্থার সর্বাধিকারী হতে চলেছেন প্রাক্তন বিসিসিআই সভাপতি এই অনুরাগ ঠাকুর। তিনি এক সময় অবশ্য কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রীও ছিলেন।
রাজনীতি আর আদালত, হাত ধরাধরি করে চলছে সংস্থাগুলি প্রশাসনিক দায়িত্ব করতে দখল করতে। শুধু কি তাই, আদালতের পরিসংখ্যান বলছে যে– দল নির্বাচন নিয়েও পর্যন্ত লড়াই চলে এবং সেই লড়াই আদালত অবধি গড়িয়ে যায়। আর দেশের নাকি ৪৯টি ক্রীড়া সংস্থা এখনও– হয় প্রশাসনিক লড়াই নয় দল গঠন করা নিয়ে লড়াই আদালতের দ্বারস্থ হয়ে বসে আছে।
একাধিক প্রাক্তন জাতীয় খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথা বলার পর যে ভাবনাটা খুঁজে পাচ্ছি, তা হল, ন্যাশনাল স্পোর্টস গভর্নেন্স বিল এটা যদি আসে তা হলে নাকি অনেক কিছু রদবদল হবে। এই বিলের মধ্যে এমন কিছু আইন আছে যা অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থাকে বা খেলোয়াড়কে আদালত অবধি পৌঁছতে হবে না। অর্থাৎ আদালতের উপর চাপটা নাকি কমবে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় ক্রিয়া মন্ত্রক এই বিলটি গত অক্টোবর মাসে পাবলিক ফোরামে রেখে দিয়েছে। সকলে পড়ছেন। প্রত্যেকের মতামত চাওয়া হয়েছে। আরও যেটা জানা যাচ্ছে এই যে, চলতি বাজেট সেশন চলছে সেখানেই নাকি এই বিল নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজ্য বলুন কিংবা সর্বভারতীয় প্রতিটি ক্রীড়া সংস্থার যে পরিমাণ আদালতে কড়া নাড়ার হিড়িক, তাকে বলাই যায়-– স্বচ্ছতার ভীষণ অভাব। খোঁজ নিলে জানতে পারছি, প্রত্যেকটা সংস্থার বার্ষিক যে রিপোর্ট এবং অ্যাকাউন্টস রিপোর্ট মিলছে, সেখানে মোটা অঙ্কের খরচ দেখা যাচ্ছে শুধু আইনি লড়াইয়ের জন্য। ছোট থেকে বড়, সব সংস্থার এক অবস্থা। যেমন ধরা যাক ড্রাগন বোট রেস। বল ব্যাডমিন্টন। সিলামবাম। তেমনই একই জটিলতা আছে ফুটবলে-ব্যাডমিন্টনে-হকিতে।
আর আদালতের অবস্থা? পি ইউ চিত্রা। তিনি একজন অ্যাথলিট। কেরল হাইকোর্টে সর্বভারতীয় সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন ২০১৭ সালে। সেই চিত্রা ২০২৩ সালে শেষ বার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা পর অবসর নিয়ে ফেলেছেন। অথচ তার সেই ২০১৭ সালে করা মামলার আজও নিষ্পত্তি হয়নি।
রেকর্ড বলছে, অ্যামেচার বেসবল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার বিপক্ষে ১১টি আলাদা আলাদা আদালতে মামলা চালু হয়েছে ২০১৯ থেকে নভেম্বরের ২০২২ পর্যন্ত। বিভিন্ন রাজ্যসংস্থা এই মামলাগুলি করে বসে আছে। সেইসব মামলার আজও নিষ্পত্তি হয়নি।
সর্বভারতীয় যোগা ফেডারেশনের আইনি লড়াই তো আরও তাজ্জব ব্যাপার। যোগা ফেডারেশনের লড়াই আবার সরকারের সিদ্ধান্তের উপর। সেটা করা হয়েছিল ২০২১ সালে। সেই আইনি লড়াইয়ের পরবর্তী শুনানি আছে একুশে মে! চলছে তো চলছে!
ভারতীয় ফুটবলের কথাই ধরুন। ২০২২ এর রিপোর্ট বলছে আইনি লড়াই লড়তে খরচ হয়েছে তিন কোটি টাকা! তা হলে বুঝুন, এই দেশে কি আর হবে?
রাজনীতির কুশীলবরা সর্বভারতীয় সংস্থার মাথায় বসবেন কিংবা রাজ্য সংস্থার মাথায় বসবেন তাই নিয়েও লড়াই। সঠিকভাবে দল নির্বাচন হয় না তাই নিয়ে খেলোয়াড়রা আদালতের দ্বারস্থ। এ যেন সেই বিখ্যাত মান্না দের গাওয়া গানটা লাইনগুলোর মতো— ‘নিলাম নিলাম শুরু হলো নিলাম, … এ খেলা চলছে নিরন্তর’। নিলাম। হ্যাঁ, অর্থের বিনিময়ে নিলাম। অপেক্ষায় আছি, এই বাংলায় না ক্রিকেট সংস্থায় কিছু দেখা যায়।