বর্তমান বিশ্বে গান্ধিবাদী দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা
The relevance of Gandhian philosophy in today's world

Truth Of Bengal: বিপ্লব চৌধুরী: বিশ্বশান্তি ও অহিংসার এক উজ্জ্বল ও বিরলতম ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধি। ২০০৭ সালের ১৫ জুন জাতিসংঘের সাধারণ সভায় গান্ধিজির জন্মদিন ২ অক্টোবরকে ‘আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গান্ধিজিকে জানতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন তাঁর দর্শন তত্ত্বকে জানা। সাধারণ জীবনযাপন, অহিংসা, সততা, স্বয়ম্ভরতা এবং সেবা এই দর্শনগুলো দিয়েই গড়া ছিল মহাত্মা গান্ধির জীবন ও কর্ম।
১. অহিংসা
ঐতিহাসিক গুরুত্ব-
গান্ধিজির অহিংস নীতির মূলমন্ত্র হল যে কোনও দ্বন্দ্বের সমাধান করতে হবে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে, কোনও হিংসা ছাড়াই। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করতে সফল হয়েছিল মূলত মহাত্মা গান্ধি পরিচালিত অহিংস আন্দোলনের দ্বারা। এই অহিংস দর্শন সারা পৃথিবীতে আলোড়ন ফেলেছিল।
বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা-
বিশ্বব্যাপী যে সমস্ত আন্দোলন ও প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে, শান্তিপূর্ণ ও অহিংসার পথে- সেই সব আন্দোলন সফলতার মুখ দেখতে পেরেছিল। সাম্প্রতিক কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘটা ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ ছিল গান্ধিবাদী আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত অহিংস আন্দোলন। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সোশ্যাল মিডিয়া, ই-মেল, গেমিং প্লাটফর্ম ও মোবাইল ফোনে অপ্রীতিকর বার্তা প্রেরণ, কাউকে হয়রানি কিংবা ভয় প্রদর্শন, অপমানকর বক্তব্য সরাসরি শারীরিক আঘাতের বাইরে গিয়ে মানসিক ও সামাজিকভাবে ব্যক্তিকে আঘাত করছে। এরকম উদ্বেগের সময় দাঁড়িয়ে গান্ধির অহিংস নীতি বেশি মাত্রায় প্রাসঙ্গিক। আধুনিক কালে সীমান্ত দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ, পারমাণবিক সমস্যা, এই সকল ভয়াবহ বিপদ থেকে রক্ষা করতেপারে কেবল মহাত্মার জীবন্ত অহিংস দর্শন।
২. সততা
ঐতিহাসিক গুরুত্ব –
গান্ধিজির জীবন ছিল সততানির্ভর। তাঁর দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিবাদ ও বিরোধের মূল ভিত্তি ছিল সততা। ১৯৩০ সালে গান্ধির ডান্ডি অভিযান ছিল অন্যায় ও মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন।
বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা-
আজকের দিনে ভুল তথ্য ও ফেক নিউজের বাড়বাড়ন্ত চলছে চারিদিকে। গান্ধিজি সততার প্রতি যে গুরুত্ব দিতেন, সেইরূপ সততা আজও জরুরি। দায়িত্বশীল সংবাদ উপস্থাপনা ও তথ্য যাচাইয়ের বিশেষ প্রয়োজন আছে। যুক্তিপূর্ণ চিন্তা ও তথ্য যাচাইয়ের দক্ষতাই সততার মূল্য অক্ষুণ্ন রাখতে পারবে।
৩. সাদামাটা ও সহজসাধ্য জীবন যাপন
ঐতিহাসিক গুরুত্ব-
স্বাধীনতার আন্দোলন জুড়ে গান্ধিজির সাদামাটা জীবনযাপন, খাদি কাপড়ের ব্যবহার, স্বচ্ছতার প্রতি আগ্রহ, ও পরিবেশের প্রতি প্রেম অসংখ্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা-
‘দ্যা টাইনি হাউস মুভমেন্ট’ যেখানে মানুষ ছোটো বাড়ি বেছে নিচ্ছে বসবাসের জন্য, বিলাসবহুল জীবনযাপনকে কমিয়ে এনে আড়ম্বরবিহীন, অল্পে সন্তুষ্ট ও পরিবেশ বান্ধব হতে আগ্রহী হচ্ছে। এটা গান্ধিবাদী দর্শনের সাদামাটা ও সহজ সরল জীবনযাপনের উদাহরণ।
৪. স্বয়ম্ভরতা ও আত্মনির্ভরশীলতা-
ঐতিহাসিক গুরুত্ব–
গান্ধিজির আহ্বান ছিল স্থানীয় উদ্যোগ ও কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটুক ও গ্রামীণ অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি উন্নতি। গান্ধিজি সর্বদা স্থানীয় উদ্যম ও উদ্যোগকে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা-
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে স্থানীয় উদ্যোগগুলিকে অবশ্যই চাঙ্গা হতে হবে। এ বিষয়ে গোষ্ঠী উন্নয়ন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বিশ্ব বাজারে নিজেদের সাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আত্মনির্ভর হয়ে ওঠা জরুরি প্রতিটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের।
৫. দয়া ও সেবা
ঐতিহাসিক গুরুত্ব-
মহাত্মা গান্ধির সমগ্র জীবনের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে ছিল দয়া ও সেবার ভাবনা। গান্ধিবাদী দর্শন, চিন্তা- মননের মূল ভাবনা ছিল মানব প্রেম। সকলের কল্যাণ, শিক্ষার উন্নতি, লিঙ্গ-সমতা ও বঞ্চিতদের ক্ষমতায়নের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ নজর। বিশ্ব কেবল মহাত্মা গান্ধিকে তাঁর অহিংসার জন্যই নয় তাঁর করুণা ও সহমর্মিতার জন্যও মনে রেখেছে।
বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা-
বর্তমান সময়ে পারস্পরিক হানাহানি ও বিদ্বেষ এবং সাম্প্রদায়িক কলহে দয়া ও সেবার মনোভাব ও সংহতি আজও প্রাসঙ্গিক। পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সমানুভূতি ও সম্প্রীতি গড়ে তুলতে পারে এক সুন্দর সমাজ তথা দেশ।
দ্রুত ও ক্রমাগত পরিবর্তনশীল নানাবিধ প্রতিকুলতা ভরা এবং সমস্যা জর্জরিত বিশ্বে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধির দেখানো পথ বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে আজও নিরন্তর আশার আলো দেখিয়ে চলছে। সমাজ সংস্কার ও বিকাশে গান্ধির সক্রিয় ভূমিকা তাঁকে জাতীয়তাবাদের বেড়া ভেঙে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সারা বিশ্বে ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে একমাত্র পথ হল গান্ধিবাদী দর্শন। আমাদের সবার উচিত এই মহান মানুষটির আদর্শে নিজেদের অনুপ্রাণিত করা।