
Truth Of Bengal: রাজু পারাল: আজকের সমাজে কাজের ব্যস্ততায় অনেকেই ভুলে গিয়েছেন হাসতে বা রসিকতায় মেতে উঠতে। অথচ শরীর ও মন সতেজ রাখতে ‘হাসা’ বা ‘রসিকতা’রও প্রয়োজন আছে। বলা হয়, দৈনিক হাসির মাত্রা বাড়লে বেঁচে থাকার আয়ুও বেড়ে যায়। হাসির প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে একসময় বিশেষজ্ঞেরা চালু করেছিলেন ‘বিশ্ব হাস্য দিবস’।
বিভিন্ন জনের লেখা থেকে জানা যায়, একসময় বঙ্গ মনীষীরা মেতে উঠতেন রঙ্গ রসিকতায়। তাঁদের কথা বার্তায় উঠত হাসির রোল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন প্রমুখ মনীষীরা যেমন রসিক মানুষ ছিলেন, তেমনই সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন দারুণ রসিক। কিছু কিছু ঘটনা সেই সাক্ষ্য বহন করে।
প্রথমেই ধরা যাক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। তিনি নাকি মজার মজার কথা বলে হাসিয়ে মাতিয়ে রাখতেন প্রিয় লোকেদের। তাঁর সংস্পর্শে এসে অনেকেই রসিকতার মুখাপেক্ষী হয়েছিলেন। জানা যায়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঘরোয়া মিষ্টি ও পিঠেপুলি খেতে পছন্দ করতেন। গুরুদেব তখন শান্তিনিকেতনে, এক শীতের রাতে আশ্রমের এক শিক্ষকের স্ত্রী কবিগুরুর জন্য পিঠে পুলি তৈরি করে নিয়ে এলেন। কবিগুরু বেশ খুশি হয়ে সবকটি পিঠে তৃপ্তি করে খেলেন। ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, ‘পিঠে কেমন লাগল গুরুদেব?’ কবিগুরু মজা করে ছড়া কেটে বললেন, ‘লোহা কঠিন, পাথর কঠিন। আর কঠিন ইস্টক। তার অধিক কঠিন কন্যে। তোমার হাতের পিষ্টক।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ একদিন মৈত্রেয়ী দেবীকে ডেকে বললেন, আচ্ছা একটা জিনিস লক্ষ্য করছি, তোমাদের প্রত্যেকের হাতের লেখা একইরকম, এটা কী করে হয়? সব সেই গোল গোল অক্ষর। মৈত্রেয়ী দেবী বললেন, আর বলবেন না, আপনার লেখা কপি করে করে সারা বাংলার লোকেদের হাতের লেখা প্রায় একই রকম হয়ে গিয়েছে। কবি বললেন, তা হলে তো বড় চিন্তার কারণ। ভাগ্য ভাল, আমার ব্যাঙ্কের খাতা শূন্য, তা না হলে ভাবনায় পড়তে হতো। চিররসিক কবিগুরু এ ভাবেই হাসতে এবং হাসাতে খুব ভালবাসতেন।
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা সাহিত্যে তখন খুব নামডাক। একদিন তিনি হাওড়া ব্রিজ পার হচ্ছেন হেঁটে। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, কাঁধে ব্যাগ। ব্যাগে নতুন লেখা উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। কলকাতার একটা নামজাদা পত্রিকা অফিসে যাচ্ছেন। গঙ্গার ফুর ফুরে হাওয়া খেতে খেতে চলেছেন। স্বভাবতই তিনি একটু অন্যমনস্ক। হঠাৎ এক কম বয়সি পকেটমার হাত বাড়িয়ে বুক পকেট থেকে চেনশুদ্ধ ঘড়িটা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যে এগিয়ে এলে শরৎচন্দ্র তা টের পেয়ে ধরে ফেললেন। চতুর পকেটমার ভয় না পেয়ে শরৎচন্দ্রকে বলল, ‘স্যর, আপনার ঘড়িতে কটা বাজে?’ শরৎচন্দ্র তখন পকেটমারের পিঠে সজোরে একটা কিল মেরে বললেন, ‘একটা’। কিল হজম করে পকেটমার ‘উরি বাবা’! বলে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘ভ্যাগিস বারোটা বাজেনি।’ কথাশিল্পী হো হো করে হেসে উঠে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেন।
কর্মজীবনে উচ্চপদে আসীন ছিলেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। আপাতদৃষ্টিতে মানুষটিকে গম্ভীর বলে মনে হলেও তাঁর রসিক মনের পরিচয় পেয়েছেন অনেকেই।
একবার সস্ত্রীক বঙ্কিমচন্দ্র ট্রেনে করে যাচ্ছিলেন। প্রথম শ্রেণিতে তাঁরা ছিলেন। ট্রেনটি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। এক যুবক বঙ্কিমের স্ত্রীর দিকে খালি খালি উঁকি ঝুঁকি মারছিল। যুবকটিকে ডেকে এনে বঙ্কিমচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী করো বাবু?’ যুবকটি উত্তর দেয়, ‘রেলে চাকরি করি।’ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রশ্ন, ‘কত বেতন পাও?’ যুবকটির উত্তর, ‘ত্রিশ টাকা’। বঙ্কিমচন্দ্র স্ত্রীর ঘোমটা খুলে দিয়ে বলেন, ‘ভালো করে দেখো আমার স্ত্রীকে। আমি একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং সাহিত্যিক। আমার নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আটশো টাকা মাইনে পাই। বইপত্র লিখেও ভাল আয় হয়। তা ধরো কম করে সব মিলিয়ে মাসে প্রায় দেড়-দু’হাজার টাকা আয় হয়। এই সব টাকাই ওঁর হাতে সঁপে দিয়েও ওঁর মন পেলাম না। তুমি ত্রিশ টাকার কেরানি হয়ে ওঁর মন পেতে চাও?’ একথা শোনা মাত্র যুবকটি পালাতে পথ পেলো না।
একবার বিদ্যাসাগর মহাশয় এক সাহিত্য সভায় শুঁড় তোলা চটি পরে এলে বঙ্কিমচন্দ্র রসিকতা করে প্রশ্ন করে বসেন, ‘পণ্ডিত মশাই, আপনার চটির শুঁড় তো দেখছি ক্রমশ ওপরের দিকে উঠছে। দেখবেন, শেষে মাথায় গিয়ে না ঠেকে।’ বঙ্কিমের বাঁকা কথায় দমবার পাত্র নন বিদ্যাসাগর, তিনি ঈষৎ হেসে বললেন, ‘কী আর করা যাবে বলো, চট্ট (চটি) যত পুরনো হয় ততই বঙ্কিম হয়।’
এক নিমন্ত্রণ বাড়িতে খেতে বসেছেন নজরুল। একজন লুচির ঝুড়ি এনে বললেন, ‘আপনাকে আর লুচি দেব? ‘নজরুল রসিকতা করে বললেন, ‘না না, আর লুচি লাগবে না। আমি তো বেলুচিস্তা-নের লোক।’ নজরুলের এই কথা শুনে উপস্থিত সকলেই হেসে উঠলেন।
সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা অদ্ভুত ধারণা জন্মেছিল। কবি হতে হলে শেক্সপিয়রকে বুঝতে হবে। এত যাঁর নামডাক নিশ্চই কিছু একটা আছে। একবার তাঁর কাছে এক বন্ধু এসে শেক্সপিয়রের লেখা বুঝিয়ে দিতে বললেন। বুঝিয়ে দিতে পারলে তিনি সুনীলকে সিগারেট খাওয়াবেন। তখন সিগারেট খাওয়া ছিল বিলাসিতা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সিগারেট খাওয়ার লোভে বন্ধুকে কিছু একটা বুঝিয়ে দিলেন। বন্ধুটি ভাল ইংরেজি জানতেন না। তাই যে টুকু বুঝলেন বেশ খুশি হলেন। পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক স্মৃতিচারণে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তাকে অনেক ভুলভাল বুঝিয়েছি। নিজেই কি সব বুঝেছি?’