
অনুপম পাল (টেকসই কৃষি ও দেশজ কৃষির গবেষক): সভ্যতার শুরু থেকেই মহিলারাই দৈনন্দিন কাজকর্ম, গাছ থেকে পরিপক্ক বীজ তোলা, বীজ ঝাড়াই বাছাই, বীজ সংরক্ষণ ও বাড়ি সংলগ্ন জমিতে চাষবাসের কাজ করতেন। পুরুষরা সাধারণত জঙ্গলের ফলমূল এবং পশু জন্তু শিকার করে আনত। এখনও পৃথিবীর সব আদিবাসী সমাজ গোষ্ঠীবদ্ধ। আধুনিক নগর সভ্যতার গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের ধারণা চলে গিয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মানুষ পাহাড়ি ঢালু এখনও ঝুম চাষ করেন। অন্ততপক্ষে ৩০ রকমের ফসল। এখানের আদিবাসী মহিলারা চাষের কাজে যুক্ত। তুলা, ভুট্টা, ধান বিভিন্ন ধরনের সবজি, আদা, হলুদ, তুলো, পেঁপে, কচু, কলা, লঙ্কা বিভিন্ন ধরনের মিলেট, লাউ, কুমড়ো, কলা ইত্যাদি।
কিন্তু তুলোর সুতো কাটা, তাঁত বোনা সবটাই কিন্তু মেয়েরা করেন। ওই তাঁতকে বলা হয় লয়েনস লুম। কোমরে বেঁধে নিয়েই যে কোনও জায়গায় বসে গল্প করতে করতে কাজটা করেন মহিলারা। প্রসঙ্গত, ইংরেজরা এসে দেখলেন বাংলার মহিলারা ঘরে বসে রোজগার করেন তাঁতের কাজ ও সুতো কাটার কাজ থেকে। পৃথিবী বিখ্যাত সূক্ষ্ম কাপড় মসলিন তৈরি করতেন বাংলার মেয়েরাই। বহু মহিলাই কিন্তু সক্ষমতা অর্জন করেছিলেন সেই কালে।
শুধু তুলোর সুতো নয় পাটের থেকেও সুতো বের করে উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে ধোকরা তৈরি হতো। এখনও সেই ধোকরা তৈরি হয়। কিছু জায়গায় মেয়েরা এখনও তাঁত বোনার সঙ্গে যুক্ত আছেন ফুলিয়া, ধনেখালি, সমুদ্রগড়, বাঁকুড়ার কেঞ্জাগুড়া ও বিষ্ণুপুরে। ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুর এক নম্বর ব্লকে তসর রেশমের সুতো এখনও মেয়েরা কাটে পায়ের উপর। সেটাকে বলা হয় থাই রিলিং। এটা কষ্টসাধ্য হলেও সুতোর গুণগত মান কিন্তু খুবই ভাল হয়। এন্ডি রেশমের সুতো কাটা ও তাঁত বোনেন আলিপুরদুয়ার অঞ্চলের মেচ এবং রাভা পুরুষ ও মহিলারা।
পাঁপড় তৈরি, গয়না বড়ি, সবজি শুকিয়ে রাখা, জ্যাম-জেলি তৈরিতে মেয়েরাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে থাকেন। মাটির তৈরি বিভিন্ন রকমের বাসনপত্র, পুতুল, প্রতিমা তৈরির কাজে বহু মহিলা যুক্ত। কৃষ্ণনগর, কুমারটুলি, বাঁকুড়া, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, রায়গঞ্জের কুনোর ইত্যাদি জায়গায়। বহু মহিলা ইট তৈরির কাজে যুক্ত। পিংলায় পট আঁকা ,পট চিত্রের গানের সঙ্গেও মহিলারা যুক্ত।
বাঁশ, বেত, হোগলা ও মাদুর শিল্প ও শোলার কাজের সঙ্গেও মহিলারা যুক্ত আছেন। মুখোশ তৈরির কাজে যুক্ত আছে দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুর ব্লকে মুষ্কিপুর গ্রামের মহিলারা।
প্রসঙ্গত, ইংল্যান্ডে মহিলাদের কোনও সম্পত্তির অধিকার ছিল না, যদি না কোনও পুরুষ তাঁকে সেই সম্পত্তি দিয়ে থাকেন। আসলে আইনি আকবরীতে উল্লেখ আছে যে, মহিলারা কাছারিতে ট্যাক্স দিতে যেতেন। বাংলায় অন্তত ৩০ জন মহিলা জমিদার ছিলেন তার মধ্যে রানি ভবানী অন্যতম। মহিলা জমিদারদের সঙ্গেও একাংশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসার প্রতিযোগিতা ছিল। মহিষাদলের রানি বছরে প্রায় এক লক্ষ টাকার নুন বিক্রি করতেন ১৭৮০ সালে। ইংরেজরা ১৭৮৪ সালে আইন করলেন যে মেয়েরা খাজনা জমা দিতে পারবেন না। উল্লেখ্য, বাংলায় সতীদাহ প্রথা ছিল না বললেই চলে। উচ্চবর্ণের মধ্যে সম্পত্তির অধিকার থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করার জন্য সহমরণের প্রথা বেড়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে সম্পত্তি আইনের পরিবর্তন হয়েছে ১৯৫৫ সালে, সতীদাহ প্রথাও রদ হয় সেই যুগে।
কৃষিকাজে এখনও মহিলারাই বহু অংশে যুক্ত, যেমন ধান রোয়া করা, ধান কাটা, ধান সিদ্ধ ও শুকনো করা, মুড়ি ভাজা ইত্যাদি। আগে প্রচুর মহিলা জীবিকা নির্বাহ করতেন ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে। শ্রমকে লাঘব করার জন্য সঙ্গে ছিল গান। আজ সেই রোজগার থেকে মহিলারা বঞ্চিত। এখন ধানের প্রচুর মিল তৈরি হয়ে গিয়েছে। কারণ, শহরের মানুষকে প্রচুর চাল জোগান দিতে হবে, যেটা ঢেঁকির দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না।
গ্রামীণ মহিলাদের মধ্যে অনেকেই সন্তান প্রসব করাতে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। যারা দাইমা নামে পরিচিত। সেই কাজে অনেক মহিলায় যুক্ত থাকতেন, বিশেষত নিম্নবর্গের মহিলারা। এখন আর তাদের কাজ নেই। সব জায়গায় হাসপাতাল হয়ে গিয়েছে। তবে ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত প্রান্তে এখনও সেই প্রথা চালু আছে। কারণ সেখান থেকে হাসপাতাল বহু দূরে। মানুষের হাতের কাছেই রয়েছে ভেষজ চিকিৎসা এবং পারিবারিক চিকিৎসক এবং দাইমা। সন্তান প্রসব করাতে মানুষের দাইমা লাগত। সন্তানসম্ভবা মহিলারাও দাইমার কাছে স্বচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। এখন মূলত পুরুষ চিকিৎসকের প্রাধান্য।
গ্রামীণ মহিলাদের প্রায় ৭৫ শতাংশই কৃষিকাজ বা পশুপালন ও অন্যান্য কুটির শিল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত। গো পালনের সব কাজে বহু মহিলা যুক্ত। সাম্প্রতিক কালে দুগ্ধ বিপণনের জন্য দক্ষিণ ২৪ পরগণায় গড়ে ওঠা সুন্দরিনী সমবায় একটি উল্লেখযোগ্য সমবায়। ঘরোয়া সবজি বাগানে মহিলারাই কাজ করেন, চালের উপরে লতানে সবজি তুলে দেওয়া, গাছের জল দেওয়া, পরিচর্যা করা– সবই তারা করেন। সুন্দরবনে অনেক মহিলা চিংড়ি মাছের চারা মানে মিন, মাছ ও কাঁকড়া ও গেড়ি-গুগলি, শালুক মূল সংগ্রহ করে রুজি রোজগারের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া অনেক মহিলা মধুর বাক্স পালনে ব্রতী হয়েছেন। শীতকালে খেজুরের রস জাল দেওয়া এবং গ্রীষ্মকালে তালের রস জাল দিয়ে গুড় তৈরিতে বাড়ির পুরুষ মানুষের সঙ্গে মহিলারাও যোগ দিয়ে থাকেন।
বাড়ির রান্নার জ্বালানির জন্য রাঢ় অঞ্চলে অনেক মহিলা জঙ্গলের পাতা ও কাঠ সংগ্রহ করতে যান। এছাড়া মহুয়া ফুল সংগ্রহ, কেন্দু পাতা সংগ্রহ, বর্ষাকালে শাল জঙ্গল থেকে কুরকুরে ও অন্যান্য ছাতু সংগ্রহের জন্য মহিলারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিড়ি বাঁধার কাজে অনেক মহিলা যুক্ত। এছাড়া মহিলারা পুকুর ও ডোবা থেকে ছোট মাছ, গেড়ি-গুগলি সংগ্রহ করে থাকেন এবং বাজারে বিক্রি করেন। গ্রামের হাটগুলিতে মহিলারাই সবজি এবং দুধ বিক্রি করে থাকেন। রায়গঞ্জের অদূরে একটি হাটে দেখা গেল প্রায় দুশো জন মহিলা দুধ বিক্রি করতে এসেছেন। মহিলারা সুচি শিল্পের কাজেও পারদর্শী।
ইদানীং কালে মহিলাদের স্বনির্ভর দল, মহিলাদের ক্ষমতায়নের কথা আমরা জানতে পারছি এবং মহিলারা এই সমস্ত প্রকল্পে নিযুক্ত করে নিজেদেরকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলছেন। সরকারিভাবে মহিলাদের জন্য বিভিন্ন আর্থিক সহায়তা প্রকল্প চালু হয়েছে। তবে অনেক জায়গায় মহিলাদের পারিশ্রমিক কম দেওয়া হয়।