শাক্ত কবিদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিলেন রামপ্রসাদ সেন
Ramprasad Sen was the most popular of the Shakta poets

Truth Of Bengal: স্বপন কুমার দাস (বিশিষ্ট ক্ষেত্র গবেষক ও সাংবাদিক): শাক্ত কবিদের মধ্যে কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন যে সর্বাধিক জনপ্রিয়, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাঁর জনপ্রিয়তার পেছনে কাব্যোৎকর্ষই একমাত্র কারণ নয়। শাক্ত পদাবলির প্রথম প্রবর্তক রামপ্রসাদ তার জনপ্রিয়তার এটি একটি মুখ্য কারণ। শাক্ত পদাবলির একটি নামান্তর প্রসাদী সঙ্গীত’— বলা বাহুল্য রামপ্রসাদের নামের সঙ্গেই এটি যুক্ত হয়ে আছে। ‘ভক্তের আকুতি’ এবং জগজ্জননীর রূপ’ অর্থাৎ উপাস্য-উপাসনা তত্ত্বের কথা যাবতীয় সাধনতত্ত্বের পদ রচনার পদপ্রদর্শক সাধক কবি রামপ্রসাদ সাধনার ভাবে তিনি আত্মসমাহিত, সম্ভবত তিনি সাধনার সর্বোচ্চ স্তরেই উপনীত হয়েছিলেন— ফলে উপাস্যা দেবীর সঙ্গে তার বেলায় সম্বন্ধ যতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, তেমনটি অপর কোনও কবির বেলায় হয়নি। কবিবর ঈশ্বর গুপ্ত ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে রামপ্রসাদের জীবনী এবং তাঁর রচিত ‘কালীকীর্তন’ প্রকাশ করায় শিক্ষিত সমাজে তিনি অপর শাক্ত কবিদের তুলনায় অনেক আগেই পরিচিতি লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন।
এ সমস্ত কারণ ছাড়াও যে কারণে রামপ্রসাদ বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন, সে বিষয়ে ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘সারা দেশে রামপ্রসাদের জনপ্রিয়তার একটা কারণ বাস্তব দুঃখকে তিনি বৈষ্ণব পদাবলির মতো সূক্ষ্ম রসে পরিণত করেন নাই; তাহাকে স্বীকার করিয়া তাহা হইতে মুক্তির পথ খুঁজিয়াছেন। দুঃখবেদনা হইতে পলায়ন নহে, তাহার দ্বারা আচ্ছন্ন হইয়াও নহে— আদ্যাশক্তির কৃপায় কবি সমস্ত সুখ-দুঃখ ত্যাগ করিয়া মুক্তির পথ খুঁজিয়াছেন। কবি দুঃখের আঘাতে আরও নিবিড় করিয়া জননীকে চিনিয়া লইয়াছেন। কবি দেখিয়াছেন, দুঃখ হইতে পরিত্রাণের পথ শ্যামার চরণে আশ্রয় গ্রহণ। তদানীন্তন কুশাসন, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, নিত্য দারিদ্র্য— ইহা হইতে মুক্তির পথ কোথায়? সেই পথই রামপ্রসাদ দেখাইয়াছেন।
কাজেই তার গানের মধ্যে দুঃখবেদনার কথা থাকিলেও সেই দুঃখবেদনা প্রসাদী সঙ্গীতে ফলশ্রুতি নহে— বাস্তব দুঃখ হইতে সাধনার চিদানন্দময়লোকে উত্তরণই কবির অভিপ্রেত সাধারণ গৃহী মানুষ ইহা হইতে আশার আলোক লাভ করিয়াছে, মুমুক্ষু ইহা হইতে মুক্তি মোক্ষের এষণা লাভ করিয়াছে, লীলারসিক এই সমস্ত গানে মাতাপুত্রের বাৎসল্য রসের সম্পর্ক দেখিয়া তৃপ্ত হইয়াছে। এইজন্যই বাঙালি রামপ্রসাদের পদাবলি জড়াইয়া গিয়াছে।
বাংলার ঘরে ঘরে রামপ্রসাদ-সম্পর্কিত নানান কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। এগুলির মধ্যে রামপ্রসাদের বেড়া বাঁধার গল্পটি বেশ জনপ্রিয়। এই কাহিনি অনুসারে, রামপ্রসাদ একদিন বাড়ির সামনে বেড়া বাঁধছিলেন, সাহায্য করছিল তাঁর ছোট্ট মেয়ে। এক সময় মেয়েটি সেখান থেকে উঠে চলে যায় বাবার অগোচরে। রামপ্রসাদ একমনে বেড়া বেঁধে যান এবং তাঁর হাতে কেউ যেন দড়ি ধরিয়ে দেয়। কিছুটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর যখন মেয়ে এসে বলে, বাবা তোমাকে কে দড়ি ধরিয়ে দিচ্ছিল? তখন রামপ্রসাদ বুঝতে পারেন এতক্ষণ তাঁর মেয়ে নয়, কাজে সাহায্য করছিলেন স্বয়ং শ্যামা মা। একদিন স্নানে যাচ্ছিলেন রামপ্রসাদ। হঠাৎ করেই রামপ্রসাদের গান শুনতে আসে এক অল্প বয়সী সুন্দরী মেয়ে। রামপ্রসাদও মনের আনন্দে তাঁকে অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু স্নান করে এসে তিনি দেখেন সেই রমণী নেই, বদলে চণ্ডী মণ্ডপের দেওয়ালে লেখা, ‘আমি অন্নপূর্ণা, তোমার গান শুনতে এসেছিলাম।’
এই ঘটনার পর এক স্বপ্নাদেশ পেয়ে ত্রিবেণীর কাছে মহামায়াকে গান শুনিয়ে আসেন রামপ্রসাদ। কিংবদন্তি হল বারাণসী যাত্রাকালে রামপ্রসাদের দেবী অন্নপূর্ণার দর্শন লাভ। একবার তিনি গঙ্গাস্নান সেরে নিত্যপুজোর কাজে চলেছেন, এমন সময় একটি সুন্দরী মেয়ে তার কাছে গান শোনার আবদার ধরে। পুজোর দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে রামপ্রসাদ মেয়েটিকে একটু অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু পরে ফিরে এসে তাকে আর দেখতে পান না। পরে তিনি ধ্যানে এক দিব্যজ্যোতি দর্শন করেন এবং দেবীর কণ্ঠস্বর শোনেন, ‘আমি অন্নপূর্ণা (…) আমি বারাণসী থেকে তোর গান শুনতে এসেছিলাম। কিন্তু হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছি।’ রামপ্রসাদ নিজের ওপর ক্রুদ্ধ হন। তখনই দেবী অন্নপূর্ণাকে গান শোনাবার মানসে কাশীধামের উদ্দেশে যাত্রা করেন। কিন্তু ত্রিবেণী সংগমে এসে তার পুনরায় দিব্যজ্যোতি দর্শন হয়। দেবীর কণ্ঠে তিনি শুনতে পান, ‘এখানেই আমাকে গান শোনা। (…) বারাণসীই আমার একমাত্র নিবাস নয়, আমি সমগ্র জগৎ চরাচরে অবস্থান করি।’
এই ঘটনাটি রামপ্রসাদের জীবনের শেষ ঘটনা। প্রতি বছরের মতো সেবারও কালীপুজোয় মগ্ন ছিলেন রামপ্রসাদ। মূর্তি বিসর্জন করার সময় আচমকাই গান করতে শুরু করেন রামপ্রসাদ। মায়ের গলা জড়িয়ে পরপর চারটি গান শোনান প্রসাদ। শেষ গানটি গাওয়ার সময় আচমকাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মহামায়ার সঙ্গেই ইহলোক ছেড়ে পরলোক গমন করেন তিনি। একটি কিংবদন্তি অনুসারে এক বার কলকাতা থেকে হাঁটা পথে হালিসহর ফেরার পথে রামপ্রসাদকে বন্দি করেছিল চিতে ডাকাতের উত্তরপুরুষ বিশু ডাকাত তার উপাস্য দেবী চিত্তেশ্বরীর সামনে বলি দেওয়ার জন্য।
হাঁড়িকাঠের সামনে মৃত্যু আসন্ন জেনে রামপ্রসাদ দেবীস্তুতি শুরু করেছিলেন। তখনই বিশু নিজের ভুল বুঝতে পেরে রামপ্রসাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁকে মুক্ত করেছিলেন। তেমনই এই মন্দিরের পাশেই চিত্তেশ্বরী সর্বমঙ্গলার মন্দিরকে নিয়ে রয়েছে অন্য একটি কাহিনি। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দেবী নাকি আগে দক্ষিণমুখী ছিলেন। এক দিন সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন নৌকায় গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিলেন। তাঁর গান শোনার জন্য দেবী নাকি পশ্চিমমুখী হয়েছিলেন। তেমনই জয়নারায়ণ ঘোষাল প্রতিষ্ঠিত দুর্গা পতিতপাবনীকে দেখে রামপ্রসাদ গেয়ে উঠেছিলেন ‘পতিতপাবনী পরা, পরামৃত ফলদায়িনী স্বয়ম্ভূশিরসি সদা সুখদায়িনী।’ তিনিই এই স্থানটির নামকরণ করেন ভূকৈলাস।