
Truth of Bengal: বাবুল চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ, হাত বাড়ানোর কথা বলছি। বলছি একটা শক্ত হাতের কথা। এখন সেই হাতের খুব প্রয়োজন। আসলে যা হবে এক যথার্থ ভালবাসার হাত। আর যে হাতে থাকবে একটা পাওয়ার। মানে যাকে মান্য করা যায়। অভিভাবক রূপে একজন সেই হাত ধরবে। যে হাত শিখিয়ে দেবে কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ। মানে সেই হাত হবে আমাদের চোখ। সেই হাত হবে আমাদের মন। যাকে বিশ্বাস করা যায়, যাকে সম্পূর্ণ ভরসাও করা যায়। এক কথায় যে হাত নির্ভরযোগ্যতার হাত। সেই হাত তোমার বাবার হতে পারে, সেই হাত তোমার মায়ের হতে পারে। হতে পারে কোনও ভালবাসার, কোনও বন্ধুরও সেই হাত। যা আকারে ছোট কিন্তু ব্যঞ্জনায় বৃহৎ। হতে পারে আমাদের তা এক সুস্থ সমাজের পথ। চলুন না তবে সেই ঘরে পায়চারি করে আসি।
প্রথমেই আসবো বাবা-মায়ের কথায়। মনে করা হয় বাবাদের থেকে মায়েরাই শিশুদের সময় দেন বেশি। তাই মায়ের সার্বিক শিক্ষার উপর শিশুর যাবতীয় ভাল-মন্দ নির্ভর করে অনেকাংশেই। কিন্তু অধিকাংশ মা জানেন না কীভাবে শিশুদের সঠিক লালন-পালন করতে। আর সব থেকে কষ্টের ব্যাপার হল তারা যে যথাযথ লালন-পালনের টেকনিক জানেন না এটা তারা কোনও মতেই স্বীকার করেন না। দেখেছি এমন অনেক মা আছেন যারা স্বামীদের কোনওমতেই পাত্তা দেন না। ভাবখানা এমন যে, আমাদের টিভি সিরিয়ালে সব জ্ঞান হয়ে গেছে। ভাবখানা এমন, তোমরা বাইরে থাকলেই সব জানবে এমন কোনও কথা নেই। আর বাস্তব থেকেই তো সব সিরিয়াল হয় নাকি! স্বামীটি আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই বুঝে চুপচাপ থাকেন। আর মনে মনে ভাবেন ওরকম চড়া মেকআপে বাড়িতে বেনারসি পরে পালং শাক কাটে কি বাস্তবে! আর মা মেয়েকে হালকা হাওয়ার জন্যে বিয়ার খাওয়াচ্ছেন– এও কি বাস্তবে সম্ভব! আবার সব সিরিয়ালের নারী চরিত্রের একাধিক বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক– এও কি বাস্তবে হয়! আর ভাল মেয়ে নয় দজ্জাল শাশুড়ি বা উল্টোটা– সত্যিই কি বাস্তব? না, কিছু মেলে না। একটা ঝংকার— তা হলে আর সিরিয়ালগুলো চলত না। আর তুই হা হয়ে বসে আছিস কেন? যা অঙ্কগুলো কর। আমি এই পরের সিরিয়ালটা দেখেই আসছি। বুঝুন! এই ভাবেও নাকি পড়াশুনো হয়! ভাবা যায়! আরে বাচ্চাটা যে ওই অঙ্কটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না– সেটাই মাকে বোঝাতে পারল না। তবে বাকি ওইরকম একই অঙ্ক সে কী করে পারবে তাই তো সে নিজে বুঝে উঠতে পারছে না। আবার এখনও ঠিক বাইশ মিনিট সিরিয়ালটা শেষ হতে বাকি। ওটাই হোমওয়ার্ক। তবেই বুঝুন! কত গার্জেনদের যে টিভি দেখা আর সব্জি কাটার কাজ একসঙ্গে করতে গিয়ে হাতের আঙুলে রক্ত ঝরেছে তার হিসেব নেই! এবার আপনারা ভাবুন এভাবে কি সন্তানের কাছে নির্ভরযোগ্যতার হাত বাড়ানো যায়! না, অবশ্যই বাড়ানো যায় না। এমন অনেক মা-বাবাকে দেখা যায় যে তারা শারীরিক দিক থেকে বেশ সুশ্রী ও ফিটফাট হলেও বাচ্চা একেবারেই লিকলিকে। নিশ্চই সেভাবে কেয়ার হয় না। মানবেন তো? নাকি পাশ থেকে শুনবেন– ও একদম কিছু খেতে চায় না।
আসছি বাবাদের কথায়। তারা বাইরের কাজে ব্যস্ত। সেভাবে ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। যারা সত্যিই ব্যস্ততায় পারেন না তাদের কথা বলছি না। আর যারা সময় দিতে পারেন না– এটাকে ছুতো হিসাবে ব্যবহার করেন তারা বাচ্চাকে কত ভালবাসে বুঝে নিন। এমন অনেক পুরুষ গার্জেন আপনি আমি চিনি যে বাচ্চার কোনও কিছুই তেমন খবর রাখেন না। এমনকী এখন বাচ্চা কোন ক্লাসে পড়ে তাও তিনি জানেন না। বললে হয়তো বলবেন ওই ওয়ানের আগে যে ক্লাস থাকে সেই ক্লাস। কেন আপনি সঠিক জানেন না? আসলে ওর পড়াশুনোর দিকটা ওর মা-ই দেখে। অথচ আপনি জেনে অবাক হবেন যে ওই পুরুষ অভিভাবক উচ্চশিক্ষিত। ভাল চাকরিও করেন। তবে, এই সময় না পাওয়ার কথায় ছাড় পায়নি বাচ্চার স্কুল মিটিংএ। সেখানে এই সময় না পাওয়ার কথা বললে ম্যাডাম জানিয়ে দেন যে সময় আপনার বের করতে হবে, সন্তান আপনার। আপনি আপনার সন্তানকে ভালবাসলে তার জন্যে একটু বেশি সময় কি আপনি বের করতে কিছুতেই পারেন না। আজ আপনি ওকে দেখলে কাল ওর রেজাল্ট আপনি দেখবেন। গর্ব হবে আপনার। আপনি কি সন্তানের ভাল ফলের আশা করেন না? পুরুষ গার্জেন নিরুত্তর থাকেন। জানলে অবাক হবেন, তারপর থেকে বাচ্চার প্রতি বাড়িয়ে দেওয়া সেই ভালবাসার হাতে অচিরেই ভাল রেজাল্ট দেখতে পান। তাই মনে হয় চেষ্টা করলে কী না হয়!
আগেকার দিনে ভাল অভিভাবক পাওয়া যেত। মানে রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও অনেকে ভাল অভিভাবক। তখন একটা গ্রামে বাবার বয়সী সবাই অভিভাবক। সবাই শাসন করতে পারত। অবশ্যই ভাল পরামর্শ তথা শাসন। এখন তো তা আর হয় না। একজন অভিভাবক এখন আর কোনওরকম অন্য কারও অভিভাবকত্ব সহ্য করেন না। অনেক আগেই স্কুল থেকে বেত উঠে গেছে। সুতরাং সেই পর্যায়ের আর শাসন নেই। বরং অনেক অভিভাবক খোঁজ নেন কোনও টিচার শাসন সন্তানকে করছেন কি না! অথচ খোঁজ নেন না বাচ্চা আজ পড়াশুনো ঠিকমত করল কিনা। এমনও শুনেছি যে কোনও গার্জেনকে কোনও বাচ্চার প্রতি সামান্য কমপ্লেন সেই টিচারের সম্পর্কে হেড টিচারের কাছে পৌঁছয় নালিশ হিসাবে। এই তো অবস্থা!
আর এই অবস্থার মধ্যে আপনি ভাল সমাজের আশা করবেন কী করে! আগেকার দিনে একটা ভাল পরিবেশ ছিল। একটা মানবিক দিক ছিল। এখন তা আর দেখা যায় না। আর যাবেই বা কী করে? মানুষ আজ ভীষণ স্বার্থপর। শুধু নিজেরটা বোঝে। কে কত কাকে ভালবেসে তা তো করোনা কালে দেখে নিয়েছি। আমরা দেখেছি, নিজের সন্তানকে ফেলে বাবা পালাচ্ছেন। কী ভয়ানক দৃশ্য। না, আমরা কেউ সেই করোনা কাল আর চাই না। আমরা প্রত্যেকে একটা ভাল সমাজ চাই। কিন্তু তা পাই না। কারণ এটা প্রত্যেকে জানি যে ঘরের পরিবেশে আমরা একটা বড় জীবনকে ধরে রাখতে পারবো না। কারণ বাইরে আমাদের যেতেই হবে। তবে বাইরেও পরিবেশ খারাপ হলে জীবন চলবে কী করে? তাই আমাদের আরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন। কিন্তু তা তো কোনও ভাবেই হচ্ছে না। কারণ অনেকই আছেন এই উন্মুক্ত পরিবেশে নিজেকে সামলাতে পারেন না। অনেকেই বিপথে যায়। তবে যে বয়সে না বুঝে হয় সেই অবধি মানা যায়, কিন্তু যারা সব কিছু জেনে বুঝে করেন তাদের কথা আপনি মানবেন কী করে!
এবার আসি বন্ধুর কথায়। ভুল বললাম। বন্ধুত্বের কথায়। আমরা যা সহজে বাবা-মায়ের কাছে আলোচনা করতে পারি না তা পারি বন্ধুর কাছে শেয়ার করতে। তবে সমবয়সী বন্ধুর বুদ্ধি আর কতই বা হবে! তাই তাতে ভুল হাওয়ার সম্ভবনা থাকে প্রবল। তাই বন্ধু যদি একটু সিনিয়ার হয় তো কোনও কথাই নেই। তবে যে হাতের কথা আমি আজকে বলছি সেটা এই বন্ধুত্বের মধ্যে সব থেকে বেশি দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, কোনও বন্ধুই আরম এক বন্ধুর প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে। আবার দেখা গেছে আপনার কোনও অপরিচিত ব্যক্তি আপনাকে কোনও স্বার্থ ছাড়াই সাহায্য করেছে। এমন অনেক মানুষ আছেন যারা ভাল কাজ করতে বিশেষ তৎপর হন কোনও স্বার্থ ছাড়াই। আমরা করোনা কালেও তা দেখেছি ভীষণ ভাবে। সুতরাং ভাল মানুষ, ভাল কাজের মানুষ আজও মোটেই বিরল নয়। এখনও আমাদের সমাজে অনেক অনেক ভাল চিন্তার মানুষ রয়েছেন। আর যারা রয়েছেন তারা নিঃশব্দে কাজ করে চলেছেন। হ্যাঁ, আমি তাদের বাড়িয়ে দেওয়ার হাতের কথা বলেছি। একটা সমাজ, রাজ্য, দেশ সফল হতে পারে শুধু তাদেরই গুণে। আমি মানুষ– এটা যেন আমরা ভুলে না যাই। আমাদের সভ্যতা, আমাদের শিক্ষা, আমাদের রুচিবোধ, আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের আচার-আচরণ সবেতেই যেন একটা ভালবাসা থাকে। আমার কী পারি আর কী করতে পারি না, সেটা না ভেবে আমরা চেষ্টা তো করতে পারি। আমি চেষ্টা করলেই আমি সফল হবো, আমি চেষ্টা করলেই আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো। আমাকে কোনও শক্তি কোনও ভাবেই টলাতে পারবে না যতক্ষণ না আমি থামবো– এই আমাদের লক্ষ্য হাওয়া উচিত। আমার ভালবাসায় গড়ে উঠবে আমার উত্তরপুরুষ। মানে আমার সৎ কর্মে আমার উত্তরপুরুষ প্রজন্ম বাহিত হবে– এ তো গর্বের বিষয়। একটা ভালবাসার হাত কি পারে না এই সভ্য সমাজে বাড়িয়ে দিতে তার নিজের হাত? পারলে নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করুন। উত্তর পেয়ে যাবেন। তাও যদি না পান তবে হৃদয়ের কাছে যান। সে আপনার কথা শুনবে, ফেরাবে না।