সম্পাদকীয়

কবি নজরুল ব্যতিক্রমী এক প্রতিভা

Poet Nazrul is an exceptional talent

রাজু পারাল (প্রাবন্ধিক):

‘মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত,

আমি সেই দিন হব শান্ত।

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল

আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম

রণ-ভূমে রণিবে না’

নিজের জীবন দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অসামান্য দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছিলেন তিনি। সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যায়, অবিচার ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সর্বদাই তিনি ছিলেন সোচ্চার। একজন কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার ও সংগীতজ্ঞ হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি কবি। বাংলা কাব্যে তিনি পরিচিত ‘বিদ্রোহী’ কবি। আর এই উপাধি তিনি পান সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর কাছ থেকে। ১৯২২ সালের ২২ অক্টোবর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর প্রমথ চৌধুরী উপাধিটি তাঁকে দিয়েছিলেন।

আধুনিক বাংলা কাব্যে কাজী নজুরুল ইসলাম এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। কবির জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। বাবা ফকির আহমদ এবং মা জাহেদা খাতুন। তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তাদের অভাবের সংসার। দুঃখের সংসারে কবির জন্ম, তাই তিনি পরিচিত ‘দুখু মিয়াঁ’ নামে। মা অবশ্য আদর করে ডাকতেন ‘নজর আলি’ নামে। শৈশবে বাবাকে হারিয়ে কবি খুবই দারিদ্রের মধ্যে দিয়ে দিন কাটান। সেই অল্প বয়সেই বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন উন্নত আদৰ্শ ও ধর্মবিষয়ে উদারতা। অল্প বয়সে নিজের চেষ্টায় কবি পড়ে ফেলেছিলেন রামায়ণ, মহাভারত, কোরান, পুরাণ ইত্যাদি। আরবি ও ফারসি ভাষাও কিছুটা শিখেছিলেন তিনি।

গ্রামের মৌলবি কাজি ফজলে আহমদের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন কবি। পরে ভর্তি হয়েছিলেন রানিগঞ্জের শিয়ারশোল হাইস্কুলে। সেখান থেকে বর্ধমানের মাথরুন উচ্চ বিদ্যালয়ে। কিন্তু দারিদ্র্যের জন্য তাঁকে পড়া ছেড়ে দিতে হয়। আসানসোলে এক রুটির দোকানে কাজ জোগাড় করলেন কবি। মাইনে মাত্র পাঁচ টাকা। খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে। তাতেই তিনি খুশি। সব টাকাই তিনি সংসারে দিয়ে দিতেন। এক সময়ে কবি লেটোর দলে (কবিগানের দল) ভিড়ে গেলেন। সেই বয়সেই লেটোর দলে তিনি গান বাঁধতেন। সুর দিতেন।

এখানে তিনি অনেক সাধারণ মানুষ, বাউল, সুফি, ফকির, সাধু-সন্ন্যাসীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। এরপরে কবি পুনারায় শিয়ারশোল হাইস্কুলে ভর্তি হলেন ক্লাস এইটে। সে সময়ে তাঁর সহপাঠী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম লেখক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে এসময় কবি প্রচুর বাইরের বইও পড়ে ফেলেছিলেন। প্রায় এই সময় থেকেই কবির কবিতা লেখার প্রতি আগ্রহ দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন কবি। তাঁর কবিতা বার বার পড়েও কবির আশ মিটত না। কবি যখন দশম শ্রেণির ছাত্র, সে সময় শুরু হয় বিশ্বযুদ্ধ। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কবি যোগ দেন বেঙ্গল রেজিমেন্টে। সুদূর রণাঙ্গনে  শুরু হয় কবির সৈনিক জীবন।

১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। কবি ফিরে আসেন স্বদেশে। শুরু করেন অন্য এক জীবন। মহাযুদ্ধের রক্তাত্ত স্মৃতি তাঁর চেতনায় নিয়ে আসে এক পরিণতি। অনুভব করেন পরাধীনতার দুঃসহ অপমান। যুদ্ধে থাকতেই তিনি লিখেছিলেন—‘রিক্তের বেদন’ এবং ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ নামে উপান্যাস দুটি। দেশে ফিরে কাব্যসাহিত্যের জগতে আত্মনিয়োগ করলেন কবি। উপলব্ধি করলেন কবিতা ও গানে তাঁর প্রতিভা প্রকাশের উপযুক্ত মাধ্যম। তখন বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো সবাইকে আড়াল করে দিয়েছিল। কবি তাঁর রচনায় এমন এক নবীনতাকে নিয়ে এলেন, যার ফলে বাঙালি পাঠক তাঁকে বরণ করে নিল।

দেশে ফিরে কবি কিছুদিন কমিউনিস্ট নেতা মুজফফর আহমদের সঙ্গে থাকতেন। এসময়ে তিনি সাম্যবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠেন। ‘মুসলিম ভারত’ পত্রিকায় লিখে ফেলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পরিচিতি ছড়িয়ে পরে চারদিকে। এই কবিতাই বাংলা কাব্যে কবিকে বিজয়ীর গৌরব ও সম্মান এনে দেয়। ‘আমি চির বিদ্রোহী বীর– আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির’ — বাংলা কবিতায় এমন করে আগে আর কেউ কখনও লেখেননি।

সমকালীন অনেক পত্রপত্রিকায় বেশ কিছু কবিতা, প্রবন্ধও কবি লিখেছিলেন সমাজের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। বেশিরভাগ প্রবন্ধই তিনি লিখেছিলেন ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে। যেগুলি সে সময়কার জনগণের মধ্যে বিরাট আলোড়ন তুলেছিল। ১৯২২ সালে কবি ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ওই পত্রিকায় তিনি বিপ্লবী আন্দোলনকে পূর্ণমাত্রায় সমর্থন করেন। তিনিই প্রথম স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন, ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। সেই সময় ধূমকেতুকে সমর্থন জানিয়েছিলেন যুগান্তর ও অনুশীলন দলের বিপ্লবী গোষ্ঠী। এমনকী সমর্থন করেছিলেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। তবে ধূমকেতুর প্রতিবাদী সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ইংরেজ সরকার সহ্য করল না। রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে ইংরেজ সরকার কবিকে কারারুদ্ধ করল। কারাগারে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে কবি আমরণ অনশন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে অবশ্য তিনি সেই অনশন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।

নিজের জীবনকালে অসংখ্য কবিতা রচনা করেছিলেন কবি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কাব্যগ্রন্থ– অগ্নিবীণা, দোলনচাঁপা, বিষের বাঁশি, ভাঙাগান, সর্বহারা, সাম্যবাদী, ছায়ানট, বিদ্রোহী, বাঁধন হারা ইত্যাদি। এর সঙ্গে তিনি অজস্র সঙ্গীত রচনা করেছিলেন ও সুর দিয়েছিলেন। তাঁর গানের সংখ্যা প্রায় চারহাজারেরও বেশি। যা নজরুল গীতি নামে খ্যাত। আবার শ্যামা সংগীত রচনাতেও কবি নজরুল ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। কথিত আছে, রামপ্রসাদ সেন এবং কমলাকান্ত চক্রবর্তীর পরে সব চাইতে বেশি শ্যামা সংগীত রচনা করেছেন কবি নজরুল। লোকমুখে শোনা যায়, কাজী সাহেব রচিত কিছু গানের ভাব সাধক কবি রামপ্রসাদ ও কমলাকান্তকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, কবির শ্যামা সংগীতের বিপুল ভাণ্ডার আমরা গ্রহণ করতে পারিনি।

উনিশ শতকে বাংলায় নবজাগরণের যে জোয়ার এসেছিল তাতে সংবাদপত্রের বিরাট ভূমিকা ছিল। সেই ক্রান্তিকালে কবি নজরুলও তাঁর সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু করেছিলেন নব উদ্যমে। কবি তাঁর সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ শাসনাধীনে বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসে ‘নবযুগ’-এর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কবি নজরুল এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘ সময়। গবেষক শিরিন আখতার বলেছেন, নজরুলের সাংবাদিক জীবন শুরু হয় ‘নবযুগ’ দিয়ে। আবার তাঁর সাংবাদিকতার পরিসমাপ্তি ঘটে ‘নবযুগ’ পত্রিকার মধ্য দিয়েই। তবে ‘নবযুগ’ পত্রিকার পাশাপাশি কবি সম্পাদনা করেছিলেন ‘ধূমকেতু’ ও ‘লাঙল’ পত্রিকার মতো সাময়িক ও দৈনিক পত্রিকাও। কবির ওই সমস্ত পত্রিকা ও দৈনিকে যে নিরপেক্ষ স্বদেশ প্রেমের চিন্তা-ভাবনা পাওয়া যায় তা আজকের দিনের সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও পাওয়া দুষ্কর।

কবি নজরুল জাতিসত্তার পরিস্ফুটনে হয়ে উঠেছিলেন জাগ্রত সত্তার প্রতীক। তিনি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রীতি রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ঐক্য স্থাপিত হলে বাঙালির জাতীয়তাবাদ বিকশিত হবে। তাই দুটি সম্প্রদায়ের মিলন চাইতেন বারবার। তাঁর কবিতায় গানে সে কথাই তিনি লিখেছেন—

‘মুসলমান আর হিন্দু মোরা দুই সহোদর ভাই

এক বৃন্তে দুটি কুসুম এক ভারতে ঠাঁই।’

তেতাল্লিশ বছর বয়সে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’-র এক অনুষ্ঠানের সময় কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। জানা যায়, কবি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। বহু চিকিৎসা করেও তাঁকে স্বাভাবিক অবস্থায় আর ফিরিয়ে আনা যায়নি। বহুদিন জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে রইলেন তিনি। বাংলাদেশের শেখ মুজিবর রহমন তাঁকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়েছিলেন, দিয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ কবির সম্মানও। অবশেষে কবি চিরবিদায় নিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট কবির জীবনদীপ নির্বাপিত হল। বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন পূরণের সারথি বিলীন হয়ে গেলেন বাংলার মাটিতে।

Related Articles