
Truth of Bengal,বাবুল চট্টোপাধ্যায়: এসে গেল শীত। এসেছে ঠিকই, তবে শীত পড়েছে কিনা জানি না। না, ঠিকঠাক পড়েনি এখনও। তাই অনেকেই জাঁকিয়ে শীত পড়ার অপেক্ষায়। আর সঙ্গে যখন আছে মানুষের মনে প্রচুর আবেগ। মানে, মন যে করে উড়ু উড়ু। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি এই সময়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা বলছি। মানে পিকনিক। ছোটদের পিকনিক আর বড়দের আউটিং। ভুল বললাম। গরিবের পিকনিক আর বড়োলোকের আউটিং। ডিসেম্বর পরলেই হল। ভুল বললাম। সঙ্গে জুড়ে নিন জানুয়ারিও।
এই দুই মাসে মোটামুটি মানুষের মন আনচান করেই থাকে। মানে কোথাও ঘুরতে যাওয়া বা কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ভাব। একটু যারা স্বচ্ছল তারা আবার প্ল্যান করে পাহাড় না সমুদ্র। না গতবারে সমুদ্র হয়ে গিয়েছে। এবার তবে পাহাড় হলেও চলবে। চলবে মানে দৌড়াবে– পিকুর উত্তর। পিকু মানে এ বাড়ির একমাত্র ছোট ও বিচ্ছু ছেলে। না, পাহাড়ে যাওয়া যাবে না– বাবার উত্তর। কারণ ওনার শ্বাসকষ্ট। ও তাই তো! মা বলে ফেলে। ছেলে নাছোড়বান্দা– না বাবা চলো না, চলো না বাবা… ও কিছু হবে না। ইনহেলার নিয়ে নেবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমার বন্ধুর বাবারও ছিল, কই কোনও অসুবিধা তো হয়নি। তুমিও পারবে। চলো না বাবা, চলো না। বাবা রাজি হলেন। যাই হোক ছেলে বলেছে বলে কথা। যেতেই হবে। এবার ঠিকঠাক রেডি হওয়ার পালা। তবে কি পেডং? লাভা, লোলেগাঁও-ও কভার করা যাবে। এখন দেখার ঠিকঠাক ছুটিটা পেলেই হল। অনেক আগেই অ্যাপ্লিকেশন করা আছে। ৮ দিন তো দিয়েছি, এখন দেখা যাক ক’দিন হয়! যা হোক হবে। আমাদের তো পাঁচ/ ছয় দিন হলে চলবে। এ তো গেল মধ্যবিত্তের কথা। এবারে আসা যাক নিম্নবিত্ত মানুষের কথায়।
এদের আবার ওই একদিনের কোনও মতে পিকনিক বা বনভোজন হলেই হল। সে বারের কথা খুব মনে আছে রাজেশের। সেবার হাড়িভাঙা খেলায় প্রথম হয়েছিল। না, না চোরটামো করেনি। ভালভাবেই চোখটাকে বাঁধা ছিল। তাও পেরেছি তো। অনিকেত মানবেইই না। বাট আমি যে আন্দাজেই লাঠি দিয়ে মেরেছি তা শুধু আমিই জানি। ব্যস, এতেই কেল্লা ফতে। হাঁড়ি গেল ফেটে। আমি ফাস্ট। রোহিতও মানবে না। কারণ এক ইঞ্চি দূরে ওর লাঠির দাগ। আমার নাকি চোখ আলগা করে বাঁধা ছিল– সে কত কথা।
কিন্তু ও যে উইকেট থ্রোইং-এ ফাস্ট হয়েছে কই আমি তো তাতে কোনও খুঁত ধরিনি। সেবারের পিকনিক ছিল বেশ মজার। অনেক রকম মজার সব খেলা ছিল। গানের লড়াই থেকে শুরু করে ফুটবল গোলে পৌঁছনো, ছোটদের যেমন খুশি আঁকা, কুইজ, হাঁড়িভাঙা, একজনের জিমন্যাস্টিক প্রদর্শন থেকে শুরু করে থ্রুইং দি উইকেট এর মতো দারুণ আনন্দের খেলা। আর খাওয়া দাওয়া কোনও কথা হবে না। সকালে লুচি, আলুর দম, নলেন গুড়ের মোয়া, সঙ্গে কমলা লেবু আর দুপুরে কষা মুরগির মাংস, ডাল তরকারি চাটনি পাঁপড় মিষ্টি– আর কি চাই।
আর এর পর সন্ধে হবে হবে তখন হালকা চা স্ন্যাকস এইসব। তবে পাড়া থেকে অন্য পাড়ার বলে হাঁটাপথে হয়ে গেছে সব। আর কোচিং বলে অনেক স্টুডেন্ট হাওয়ায় একটু টাকাটা কম হয়েছিল।এ তো গেল এপাড়া ও পাড়ার কথা। বাট একটু দূরে গেলে তখন আবার অন্য রকম ব্যাপার। মানে তখন আবার দেখা হবে গাড়ি করে যাওয়ার একটা মজায় আলাদা। সবাই মিলে একসঙ্গে গান হুল্লোড়–কম মজা। এরপর আবার সেরা বন্ধু বা বান্ধবী হলে তো কোনও কথাই হবে না। কতরকম যে প্রেম এখান থেকে তৈরি হয় ইয়ত্তা নেই। কত আবেগ তখন।
একটুতেই কত রাগ, অভিমান যার কোনও মানে নেই। একটু পরে মানে একটু বড় বয়সে ভাবলে জাস্ট হাসি পাবে। কত কত অভিমান তখন? আর ও একটু দেখতে সুন্দরী। ব্যস, কম কেউ ওর পেছনে লাগেনি। বাট ও যে আমাকে ভালবাসে তা জানা গেল। সে যখন শুনলো আমি এবার পিকনিকে যাচ্ছি না। আসলে আমি না গেলে ও যাবে না ঠিক করল। স্যর আগেই জেনে গিয়েছিল আমাদের প্রেমের কথা। তাই পিকনিক না থাকলে আমাদের বোধহয় আর সেভাবে প্রেমটা জমতো না। তা হলে তো মানতেই হবে একটা পিকনিক অনেক কিছু করার ক্ষমতা রাখে।
বড় বয়সে বন্ধুদের নিয়ে আপনি যখন একসঙ্গে পিকনিক করবেন, তখন আরও কত কিছু জানতে পারবেন। দেখবেন আপনার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু কখন আপনার থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছে। কি না সামান্য অর্থের কারণে। দেখবেন আপনার প্রতি কেমন অন্য মানসিকতার আচরণ করছে। আপনার তো কোনও দোষ নেই যে আপনি সরকারি চাকরি করেন। ও ভাবছে অন্য কথা। ও ভাবছে আপনার থেকে বেটার রেজাল্ট হয়েও কেন পিছিয়ে! সবটাই নাকি ভাগ্য। কিন্তু সত্যি কি তাই! কলেজ লাইফের পরের ঘটনা ও জানে না।
কতটা খাটতে হয়েছে তা তো ও দেখেনি। অবশ্য ও দেখলেও তা মানবে না। আর আপনি জানলেন এই পিকনিকে! কত কত ওর রাগ আর ক্ষোভ! নাকি কি সব ছাইপাশ গিলেছিল সেদিন– তাই মনের রাগটা সেদিন উতলে পড়েছিল। না, ওর যে অত হিংসা আপনি তা জানতেই পারতেন না যদি না এই পিকনিক না থাকতো। মানে অনেকটা সময় এক জায়গায় না থাকতেন। এই হয়! কাছের মানুষ কখন অনেক দূরের হয় তা আপনি জানতে পারবেন কিছু বিশেষ মুহূর্তে। কিন্তু কত সহজে ভুলে গিয়েছিল সে অন্য এক রহস্যময় ঘটনার কথা। তখন সুন্দরবন থেকে ফেরার পালা। মাঝি ভুলে গিয়েছিল তার পথ। অনেক অন্ধকার। আর এর মধ্যে পথ ভোলা।
মানে কি আতঙ্ক। ভাবুন একবার! কাকে বলে আতঙ্ক। ভুল বললাম। যাকে বলে আতঙ্ক। তখন ওর আতঙ্ক ছিল দেখার মতো। ও প্রায় ভুলভাল বকা শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু ওর মধ্যে বকাবকি করলে বিপদ আরও ঘনিয়ে আসবে। মাঝি আর হেলপার প্রায় বারণ করছিল কোনও কথা না বলতে। কারণ পথ হারিয়ে আমরা আতঙ্কে জানলে জলদস্যুরা তেড়ে আসবে আমাদের দিকে। কিচ্ছু না জাস্ট লুটপাট করবে। আর বেশি ট্যা ফো করলে কেটে জলের মধ্যে। কোনও কেরামতি আর সেখানে চলবে না। এসব ক্ষেত্রে কোড ল্যাঙ্গুয়েজ আছে মাঝিদের।
কিছুক্ষণ পর জানতে পারা গেল সঙ্গে আরও দু’টো নৌকা পথ হারিয়েছে। তাদের ফলো করতে বলছে। কোড এ আবার কথা হল। ও আর তখন কিছু কথা বলছে না। চোখ দিয়ে অনর্গল জল পড়ছে। আর ফিসফিস করে বলছে আমি বাঁচতে চাই। তুই আমাকে বাঁচা। আমি ওকে নিরস্ত করেছিলাম। ভয় কেটে গেল আরও কিছুক্ষণ পর। জানা গেল মাঝি পথ পেয়েছে। একটা নৌকা সব কিছু চিনতে পেরেছে। ওটা গোসাবা থেকে অনেক দূরে। মানে আমরা গন্তব্য থেকে অনেক দূরের একটা ঘাটে পৌঁছবো। সেখান থেকে রাস্তায় গাড়ি পাওয়া যাবে।
সেদিন ওকে সাহস দেওয়ার জন্যে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল– আমি তোর কথা কোনওদিন ভুলতে পারবো না। আর আজ দেখো সেই পিকনিকে ওর জীবনের কর্মকে গুরুত্বহীন ভেবে আমার কর্মকেও হেনস্থা করছে। আমাকে ছোট করছে। আমার যোগ্যতা নিয়ে কথা বলছে। যাই হোক পিকনিক আর একটা আবেগ। এই নিয়ে কোনও কথা হবে না। পিকনিক শীত ডিসেম্বর জানুয়ারি এক সমন্তরাল ক্ষেত্র।
আমার-আপনার, আপনার সন্তানের প্রতিটি ক্ষেত্র এই পিকনিকে বা বনভোজনকে ঘিরে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই। আমাদের যাদের খুব বেশিদিন বাইরে বের হওয়ার সাধ্য নেই তারাও এই সময়েই মেতে উঠি। আমাদের মনের মধ্যে মেতে ওঠে আর এক অনাবিল আনন্দ। আর বাঙালি হলে তো কোনও কথা হবে না। জাস্ট ফাটাফাটি। আর ইচ্ছা যদি মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় তবে তো আর বাঙালি ঘরে থাকার মানুষ নই। পর্যটন ক্ষেত্রে দেখবেন সেখানে বাঙালির একটা আলাদা ক্ষেত্র আছে। মানে হোটেল থেকে বাঙালি খাওয়া দাওয়া সমস্ত আলাদা।
জাস্ট আপনি বাঙালি বলে। কত লোক আছে যারা কিনা এই কারণে বাংলা ভাষা, বাঙালি লোক পছন্দ করে থাকেন। এমনকী বাংলা ভাষাটাও শিখে নেন। এটা কি কম কথা হল! আসলে বাঙালির আবেগ যা পারে অন্য কোনও জাতির মানুষ তা পারে না। তাই পিকনিক ঘিরে আবেগ আমাদের। তাই পিকনিক ঘিরে আনন্দ আমাদের। তাই পিকনিক ঘিরে এত প্রেম এত আশা, এত ভালবাসা, যত ভালবাসা, এত ভাল লাগা, যত ভাল লাগা– সে আট হোক বা আশি আমরা সবাই পিকনিক ভালবাসি। কি মানবেন তো?