
Truth Of Bengal: বাবুল চট্টোপাধ্যায় (বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক): তারিখটা ২০ জানুয়ারি, ২৫। সারা দেশ টিভিমুখো। কারণ, আরজি করে খুন ও ধর্ষণ মামলায় দোষী সঞ্জয় রাই-এর সাজা ঘোষণার দিন। বিচারক সাজা ঘোষণা করবেন। শিয়ালদহ কোর্টে ২১০ নম্বর রুমে এই সাজা ঘোষণা করবেন বিচারক। কোর্ট চত্বর মুড়ে দেওয়া হয়েছিল নিরাপত্তায়। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। আদালত চত্বরের ঠিক বাইরে শিয়ালদা মেট্রো স্টেশনের সামনে অভয়া মঞ্চের মানুষের ভিড়।
সাধারণ মানুষ থেকে জুনিয়র ডাক্তার কেউ বাদ নেই। ঘড়ির কাঁটায় ১২.৩৫। বিচারক সঞ্জয় রাইকে তার সাজার ব্যাপারে কথা বলতে বললেন। সঞ্জয় জানায় সে একা দোষী নয়। এর পেছনে রয়েছে বড় মাথা। যা আগেও বলেছিল। দাবি তাকে ফাঁসানো হয়েছে। তাকে দিয়ে কাগজে সই করানো হয়েছে। তারপর এও বলে, সে যদি দোষী হতো তবে তার গলায় যে রুদ্রাক্ষের মালা আছে তা খসে যেত। তাকে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করানো হয়েছে।
জোর করে তাকে দিয়ে অনেক কাগজ সই করানো হয়েছে। বিচারক তাকে বলেন আপনি দোষী প্রমাণিত। আপনার সাজা হবেই। এ সম্পর্কে তার কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন। অপরাধী মাথা নিচু করে থাকে। তাকে বলবার অনেক সুযোগ দিলেও সে ঠিকমতো পরিষ্কার করে বলে উঠতে পারেনি। সিবিআইয়ের উকিলপক্ষ চাইল সর্বোচ্চ শাস্তি। মানে ফাঁসি। অন্যদিকে সঞ্জয় রাইয়ের উকিল পক্ষ চাইল সর্বনিম্ন শাস্তি। মানে যাবজ্জীবন। পরে বহু কিছু বাদানুবাদ হাওয়ার পরে বিচারক ২.৪৫ মিনিটে সাজা ঘোষণার কথা জানান।
যথা সময়ে সাজা ঘোষণা হয়। আমৃত্যু কারাবাস। অর্থাৎ, কারাবাসে থাকতে হবে মৃত্যু পর্যন্ত। কারণ হিসাবে বলা হল, এই ঘটনা বিরলের বিরলতম ঘটনা নয়। মানে রেয়ারেস্ট অফ রেয়ার নয়। সেই সঙ্গে তিলোত্তমার পরিবারকে ১৭ লক্ষ টাকা দেওয়ার নির্দেশ। বিচারক জানালেন, ল’ পয়েন্টে তার বিচার হয়েছে। পাবলিক পক্ষের কথানুসারে তিনি বিচার করেননি। আর তার রায় যদি তিলোত্তমার পরিবারের পছন্দ না হয় তবে তারা উচ্চ আদালতে যেতে পারেন।
এই পর্যন্ত সকলে জানেন। কিন্তু কেন ফাঁসি হল না তা নিয়ে কম জলঘোলা হচ্ছে না। সকলে এবার জোট বেঁধে ধুয়ো তুলছে। শাস্তি ফাঁসির পক্ষে। অভয়ার পরিবার থেকে ডাক্তার, সাধারণ মানুষ সকলে নানা অভিমত দিলেন। এর আগে কিন্তু মানুষ চেয়েছিল আদালতের রায়কে স্বাগত জানাবেন। বলেছিলেন শুধু সঞ্জয় রাই-এর ফাঁসি হলে নাকি মূল দোষীরা আড়ালে থেকে গেলেন। তাই আরও দোষীর সাজা চায় সকলে। আবার অনেককে এও বলতে শোনা গিয়েছে যে, মূল বা আসল দোষীরা অধরা কেন? তার বিচার চাই।
আবার ঠিক রায় বের হওয়ার পর দেখা গেল বেশির ভাগ মানুষই সঞ্জয়ের ফাঁসির পক্ষে। এখানে এক পক্ষ বলছেন তাকে তিলে তিলে মারাটায় ঠিক। ফাঁসি হলে তো একেবারে তার সঙ্গে যুক্ত থাকা আরও অনেকেই অধরা থেকে গেল। আবার যারা ফাঁসির পক্ষে তারা বলছেন এটা সমাজের কাছে কোনও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারল না। ফাঁসি হলে নাকি ঠিক হতো। মানে অপরাধীরা এক্ষেত্রে যেন অক্সিজেন পেল। অপরাধীরা এটা বুঝতে পারন কোনও ভাবেই জীবনহানি হাওয়ার রায় এখানে নেই। তাই অপরাধের মাত্রা আরও বাড়বে। খুন-ধর্ষণের আরও সাহস পেয়ে যাবে সহজে।
একটা রায় আমাদের কাছে অনেক প্রশ্ন তুলে দি। আমরা দেখেছি দুই পক্ষই সঠিক। আবার এও দেখলাম যে আমরা আদালতের রায়কে কোনও ভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। বিচারক রায়ে স্পষ্ট ভাবে গুছিয়ে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বুঝিয়েছেন, আসলে তিনি কীভাবে এই বিচার করেছেন। কিন্তু মানুষের আবেগ বেশ গণ্ডগোলের জায়গায়। আমরা দেখেছি যে, একটা সময় অনেকের দোষ খুঁজতে গিয়ে এমন একটা পরিস্থিতি হয়েছে যে সঞ্জয় নাকি নির্দোষ। এটা অনেকেই বলেছেন। মানে বলতে না চাইলেও তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সঞ্জয় দোষী এতে কোনও সন্দেহ নেই।
আমরা অন্যের দোষ খুঁজতে ওকে মূল অপরাধীর কেউ নয় বলতেই পারি না। আর এখন তো মোটেই নয়। আসলে রায় যাই হতো না কেন আমাদের প্রশ্ন থেকেই যেত। এই যদি ফাঁসির আদেশ হতো তা হলে বলা হতো আদালত ঘটনার মুখ বন্ধ করে দিল। এখানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও এই রায়ের পক্ষে নন। তিনিও সওয়াল করেছেন ফাঁসির পক্ষে। তবে ওই যে বললাম যে রায় যাই হতো না কেন একটা প্রশ্ন থেকেই যেত। এটা হলে ভাল হতো, সেটা হলে ভাল হতো। মনে রাখতে হবে, সকলের মন রাখতে রায় হয় না।
যে রায় হতো তাতে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যেত। তাই মনে হয় আমাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর আমরা নিশ্চয় চাইবো যারা দোষী তারা সকলে সাজা পাক। তবে কোনও কিছুকেই আমরা তদন্তের শেষ বিন্দু অবধি না গিয়ে মন্তব্য করতে পারি না। কারণ আমরা না জেনে অনেক কথা বলে থাকি। কোনও কিছু তলিয়ে না ভেবেই বলি। এটা আমাদের অভ্যাস থেকে ত্যাগ করতে হবে। আমাদের আইনের পথ ছাড়া কোনও কিছুতেই ভরসা রাখা যাবে না। একটা বিচার চটজলদি পাওয়া সম্ভব নয়।
আমাদের ভাবধারা থেকে ঘটনার গভীরে গিয়ে তার থেকে বিচার উঠে আসা অনেক নির্ভরযোগ্য। আর একজন বিচারপতি সেটা অনেক বুঝে, অনেক গভীরে গিয়ে তার বিচার করতে সক্ষম হন। তাই আবেগের কোনও জায়গা নেই। ঘটনা ভীষণ মর্মান্তিক। মারাত্বক। যার কোনও নিন্দাই যথেষ্ট নয়। তবে আমরা বিচারক নই। আমাদের বলবার অধিকার থাকলেও তাকে যথার্থতা দেওয়া আমাদের বুদ্ধিতে প্রবল বাধা দেয়। তাই তিলোত্তমার জাস্টিসের বিচার বা রায় অনেক প্রশ্ন তুলে দিলেও এটা এখনও বেঁচে আছে। যতদিন সঞ্জয় বেঁচে আছে। কি মানবেন তো?