সম্পাদকীয়

আজারবাইজানকে শত্রু দেশ ভাবা ঠিক হবে না

It would be wrong to consider Azerbaijan an enemy country

রাজাগোপাল ধর চক্রবর্ত্তী: বিগত ২২শে এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগাঁও নৃশংস সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় ৫ মে ভারতীয় সামরিক অভিযান ‘অপারেশন সিন্দুর’ শুরু হয়। ভারতের সংক্ষিপ্ত অথচ জোরালো ও সুনির্দিষ্ট অভিযানে বিধস্ত হয় মৌলবাদী জঙ্গি ঘাঁটি, পাকিস্তানি বিমান সুরক্ষা ব্যবস্থা ও সামরিক যুদ্ধ অভিযানের কাঠামোর বৃহৎ অংশ। তুরস্কের মতো আজারবাইজানও ভারতের এই সামরিক হামলার নিন্দা জানিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি জারি করে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের কাছে রাষ্ট্রদূত খাজার ফারহাদভ কর্তৃক প্রদত্ত আজারবাইজান সরকারের একটি চিঠিতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির প্রতি সমবেদনা জানানো হয়। শুধু তাই নয় বলা হয়েছে, পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রতি আজারবাইজানের সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে, অর্থাৎ পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমানা কেউ অস্বীকার করলে, আজারবাইজান ছেড়ে কথা বলবে না। পাকিস্তানের প্রতি আজারবাইজানের এই অযথা সমর্থন দেশজুড়ে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্বকারী শীর্ষ সংস্থা কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স (সিএআইটি) মেনে নিতে পারেনি। ভারতীয় ব্যবসায়ী এবং নাগরিকদের তুরস্ক এবং আজারবাইজান ভ্রমণ সম্পূর্ণরূপে বয়কট করার আহ্বান জানিয়েছে। ভারতীয় পর্যটকদের বয়কট আজারবাইজানের অর্থনীতির ওপরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আনবে সন্দেহ নেই।

আবেগ নির্ভর পররাষ্ট্র বা বাণিজ্যনীতি দেশকে কোনও সুবিধা দেয় না, তাই বড় কোনও ক্ষতি হওয়ার আগে ভারত আজারবাইজান সম্পর্ক ভাল করে বোঝা দরকার। কেন তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করে সেটাও দেখতে হবে। আজারবাইজান একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। ১৯৯১ সালের ১২ ডিসেম্বর স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকেই সে লড়াই করছে পার্শ্ববর্তী খ্রিস্টান দেশ আর্মেনিয়ার সঙ্গে। দুটি দেশই আগে সোভিয়েত রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত ছিল, তখন ধর্ম নিয়ে ভেদাভেদ বিশেষ দেখা দেয়নি। আজারবাইজানের কারাবাখ অঞ্চল আর্মেনিয়া দখল করলে তুরস্কের সঙ্গে যৌথভাবে পাকিস্তান জাতিসংঘের সুরক্ষা কাউন্সিলের (ইউএনএসসি) প্রস্তাব আনে। পাকিস্তান নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আজারবাইজানের অবস্থানকে সমর্থন করে এবং ২০২০ সালে আজারবাইজানের সামরিক অভিযানকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিল। আর এই সমর্থনের খুশিতে আজারবাইজানও জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়।

৫৭টি সদস্য বিশিষ্ট অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক ফোরামে আজারবাইজান কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। একথা স্মরণে রাখা প্রয়োজন, পাকিস্তানের সঙ্গে আজারবাইজানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলার পরই আজারবাইজান ভারতকে একটি শোকবার্তা দিয়েছিল। সেদেশের রাষ্ট্রপতি ইলহাম হেইদার ওগলু আলিয়েভ ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাকুতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফকে আমন্ত্রণ জানানোর সময় একটি সংবাদ সম্মেলনে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিলেন। বোঝা যাচ্ছে আজারবাইজান কট্টর ভারত বিদ্বেষী নয়। ২০২৫ সালের এপ্রিলের গোড়ার দিকে আলিয়েভকে ইদের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন মদি। আলিয়েভ আবার বাকুতে রাষ্ট্রসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন সিওপি ২৯ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান মোদিকে। মোদি সেখানে উপস্থিত না থাকতে পারলেও, ভারতের উল্লখযোগ্য অবস্থান ছিল।

ভারত-আজারবাইজান সম্পর্কের লম্বা ইতিহাস রয়েছে। বাকুর সন্নিকটে অবস্থিত ‘আতেশগাহ’ অগ্নি মন্দির ভারত ও আজারবাইজানের প্রাচীন ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি চমৎকার উদাহরণ। অষ্টাদশ শতাব্দীর এই স্মৃতিস্তম্ভে দেবনাগরী এবং গুরুমুখীতে প্রাচীন শিলালিপি রয়েছে। ইউরোপের সিল্ক রুট বাণিজ্যকালে ভারতীয় বণিকরা বাকু এবং গাঞ্জার মতো আজারবাইজানীয় শহরগুলিতে যে বাণিজ্য সংযোগ এবং আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিল তার জলন্ত উদাহরণ এই মন্দির। ভারতের নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডঃ এস রাধাকৃষ্ণান (১৯৫৬ সালে উপরাষ্ট্রপতি হিসাবে) এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু (১৯৬১ সালে) আজারবাইজান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র সফর করেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই ভারত ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে আজারবাইজানকে একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়, কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় কয়েক মাসেই। বাকুতে আবাসিক ভারতীয় মিশন খুলতে সময় নিয়েছিল খোলে ১৯৯৯ সালে। আজারবাইজান ২০০৪ সালের অক্টোবরে নয়াদিল্লিতে তার আবাসিক মিশন চালু করে।

পাকিস্তানের তুলনায় আজারবাইজানের সঙ্গে ভারতের আর্থিক সম্পর্ক অনেক গভীর। ২০২৩ সালে পাকিস্তান আজারবাইজানে মাত্র ২০৬ লাখ ডলারের রফতানি করেছে। এর মধ্যে ছিল আলু (৩০.২ লক্ষ ডলার, তরল পাম্প (২৪.৯ লাখ ডলার) এবং হালকা সিন্থেটিক সুতির কাপড় (২৩.৩ লাখ ডলার)। ২০২৩ সালে আজারবাইজান পাকিস্তানে নাইট্রোজেনাস সার, কাঁচা সীসা এবং পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম নিয়ে ৮২ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। সেই তুলনায় ভারতের বাণিজ্যিক অবদান অনেক গুণ বেশি।

ভারত-আজারবাইজানের সপ্তম বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার, ২০২৩ সালে ভারতে আজারবাইজানের রফতানির মূল্য ১২৩.৫ কোটি ডলার এবং ভারত থেকে আমদানির মূল্য ২০.১ কোটি ডলার। ২০২৪-২৫ সালের এপ্রিল-ফেব্রুয়ারি সময়ে আজারবাইজানে ভারতের রফতানি দাঁড়িয়েছে ৮৬০.৭ লক্ষ ডলার, যা ২০২৩-২৪ সালে ৮৯৬.৭ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় সামান্য কম। অবশ্য, ভারতের মোট বহির্গামী চালানের মাত্র ০.০২ শতাংশ যায় আজারবাইজানে। আজারবাইজানের মোট চাল আমদানির ৮০.৮ শতাংশ যায় ভারত থেকে। ৩৪৪ লাখ ডলার মূল্যের চাল গেছে ভারত থেকে গত বছর। ভারতের স্মার্টফোন আজারবাইজানে যথেষ্ট জনপ্রিয়। বিদেশ থেকে আমদানি করা স্মার্টফোনে ভারত দ্বিতীয় বৃহত্তম। অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড আমদানির ৩৮.৬ শতাংশ আসে ভারত থেকে। ভারত থেকে সামগ্রিক ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল ২৭৭ লক্ষ ডলার।

ভারত আজারবাইজানের চতুর্থ বৃহত্তম পর্যটন উৎস হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আজারবাইজান ট্যুরিজম বোর্ডের মতে, ২০১৪ সালে ৪,৮৫৩ জন থেকে ২০২৪ সালে ভ্রমণকারী ভারতীয়দের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪৩,৫৮৯ জনে। ২০২৩ সালে প্রায় ১.১৭ লক্ষ ভারতীয় আজারবাইজানে এসেছিলেন। কয়েক বছর ধরে, দিল্লি ও আজারবাইজান রাজধানী বাকুর মধ্যে সরাসরি সপ্তাহে দশটি বিমান যোগাযোগ রয়েছে। মুম্বই ও বাকুর মধ্যে সপ্তাহে চারটি সরাসরি ফ্লাইট রয়েছে। বয়কট আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভারতীয় পর্যটক তুরস্ক ও আজারবাইজানে বেড়াতে যাওয়া ব্যাপক ভাবে কমিয়েছেন। যেহেতু ভারতীয় ভ্রমণকারীরা মূলত অবসর, বিবাহ, বিনোদন এবং অ্যাডভেঞ্চার ক্রিয়াকলাপের জন্য আজারবাইজান যান, এতে আজারবাইজানে লক্ষ্যণীয় অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। আর একটি ক্ষেত্র যা প্রভাবিত হতে পারে তা হ’ল চলচ্চিত্র। গত কয়েক বছরে আজারবাইজানের বিভিন্ন লোকেশনে অন্তত ৩০টি ভারতীয় সিনেমা ও বিজ্ঞাপনের শুটিং হয়েছে।

ভারত আজারবাইজানের অপরিশোধিত তেলের তৃতীয় বৃহত্তম ক্রেতা। আজারবাইজান থেকে ভারতের সমগ্র রফতানির ৯৮ শতাংশ আসে অপরিশোধিত তেল থেকে। ২০২৩ সালে ভারত আজারবাইজান থেকে প্রায় ১২২.৭ কোটি ডলারের অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছে। পরের বছর, ২০২৪ সালে আজারবাইজান থেকে ভারতের অপরিশোধিত তেল আমদানি কমে হয় ৭৩.৩১ কোটি ডলার। তবু বুঝতে হবে, ভারতের বহুমুখী শক্তি আমদানি কৌশলে আজারবাইজান একটি গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী দেশ। তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ আজারবাইজান ভারতকে তার শক্তির উৎসের বৈচিত্র্যকরণের সুযোগ এনে দিয়েছে।

আজারবাইজানের শাহ ডেনিজ ক্ষেত্রকে ইউরোপের সঙ্গে সাউদার্ন গ্যাস করিডর সংযুক্ত করে, আজারবাইজান বুঝিয়ে দিয়েছে কাস্পিয়ান অঞ্চলে তেল ও গ্যাস সম্পদ বণ্টনে তার শক্তি। ভারতও অংশীদার হচ্ছে আজারবাইজানের শক্তির কাছে। ভারতের ম্যাঙ্গালোর রিফাইনারি অ্যান্ড পেট্রোকেমিক্যালস লিমিটেড (এমআরপিএল) এবং তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কর্পোরেশন লিমিটেড (ওএনজিসি) আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় তেল সংস্থা (এসওসিএআর) পেট্রোলিয়াম পণ্য বাণিজ্য, অপরিশোধিত তেল এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এছাড়াও, ভারতের সরকারী সংস্থা ওএনজিসি বিদেশ লিমিটেড, আজেরি-চিরাগ-গুনাশলি (এসিজি) তেল ও গ্যাস এবং বাকু-তিবিলিসি-চেইহান (বিটিসি) পাইপলাইনের অংশীদারিত্বে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

পাকিস্তান আজারবাইজান সম্পর্ক অনেকটাই ধর্মীয় বোঝাপড়ার। দুই দেশের সম্পর্ক তখনই মজবুত হয়, যখন দুই দেশই একে ওপর থেকে লাভবান হয়। ভারত আজারবাইজান সম্পর্ক কোন শূন্য-সমষ্টি ক্ষেত্র নয়, যেখানে এক পক্ষের লাভ অন্য পক্ষের ব্যয়ে আসে। দীর্ঘ সংগ্রামে এই সম্পর্ক ‘উইন উইন’ বা ‘জয়-জয়’ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিতে, দুই দেশই লাভবান। সামান্য আবেগ থেকে সম্পর্ক নষ্ট করা ঠিক হবে না। যুদ্ধ সময়কালীন আবেগ দেশপ্রেম ভিত্তিক আর শান্তির আবেগ হওয়া উচিত বাস্তব ভিত্তিক।

Related Articles