সম্পাদকীয়

বার্ধক্য মানুষের জীবনে সত্যিই কি অভিশাপ ডেকে আনে?

Does old age really bring a curse to people's lives?

Truth Of Bengal: বিপ্লব চৌধুরী: লেখক সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বার্ধক্যের মধ্যে এক অপার সৌন্দর্য উপলব্ধি করে তাঁর ‘পালামৌ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘মনুষ্য বৃদ্ধ না হইলে সুন্দর হয় না’। কিন্তু আজকের সমাজে বার্ধক্যের প্রকৃত রূপটি কি সত্যিই সুন্দর? নিঃসঙ্গ, নিরাপত্তাহীন, জরাগ্রস্ত বৃদ্ধদের করুন দুর্দশার চিত্র মানব সভ্যতাকে এক কঠিন প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে এবং বিশ্ববাসীকে রীতিমতো শঙ্কিত করে তুলেছে।

হেল্প এজ ইন্ডিয়ার ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে ৫১ শতাংশ বৃদ্ধ একাকিত্বে ভোগেন, ৩৫ শতাংশ শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তার শিকার, ৬০ শতাংশ অন্যের আর্থিক সাহায্যের ওপর দিন কাটান। ৪০শতাংশ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করেন এবং ২৫ শতাংশ বৃদ্ধের কোনো সামাজিক নিরাপত্তা নেই। ২০১৯ সালের হু -এর তথ্য অনুযায়ী ভারতে ৭০শতাংশ বৃদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন, ৪০শতাংশ মানসিক অবসাদগ্রস্ত , ২৫ শতাংশ চলাফেরার সমস্যায় আক্রান্ত। বার্ধক্য মানব জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। প্রকৃতিই মানুষের জীবনের এই পরিণতি নির্ধারণ করে রেখেছে।

জীববিজ্ঞান বলে, পঁচিশ বছরেই পরিপূর্ণ বিকাশের পর আমাদের সকলের দেহ বার্ধক্যের পথে যাত্রা শুরু করে। দেহ ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে , জীবকোষের সংখ্যা হ্রাস পায়, পেশীশক্তি দুর্বল হয়, দৃষ্টি ও শ্রবণ ক্ষমতা কমতে থাকে এবং সাথে তো বার্ধক্যজনিত অসুখ বিসুখ আছেই। নৃতত্ত্ববিদদের মতে বার্ধক্য মানুষের জীবনে শারীরিক ও মানসিক নানা পরিবর্তন নিয়ে আসে। তাই এইসময় চাই এই বার্ধক্য মানুষগুলোর পরম যত্ন, পারিবারিক সাহচার্য এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। আর সেখানেই দেখা যাচ্ছে ঘাটতি। যে মানুষটি একসময়ে সংসারে কর্তা বা কর্তী হয়ে কিংবা কর্মক্ষেত্রে সম্মান ও দাপটের সাথে দিন কাটিয়েছেন, এখন তিনি ব্রাত্য এবং একাকিত্ব ও নিরাপত্তাহীনতার ঘেরাটোপে বন্দি।

সন্তান সন্ততিরা কাজের সূত্রে কিংবা বিয়ের পর দূরে থাকার কারণে পারিবারিক সান্নিধ্য থেকে এই প্রবীণরা বঞ্চিত হন। আর্থিক স্বচ্ছলতা কমে যায়। সঞ্চিত অর্থভাণ্ডার ক্রমে কমতে থাকে । অনেক ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রীর মৃত্যুর কারণে একা কোনো বাড়িতে বা ফ্ল্যাটে তাঁদের বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো থাকতে হয়, আর তাঁদের অসুরক্ষা ও নিরাপত্তাহীনতার নেতিবাচক সুযোগ নেয় দুর্বৃত্তরা। অর্থের জন্য এই অসহায় বৃদ্ধ মানুষদের তাঁরা হত্যা পর্যন্ত করে ফেলে। একের পর এক ঘটে চলেছে মর্মান্তিক এমন সব ঘটনা। সত্যি বলতে কি সমাজ যত প্রগতির দিকে এগিয়েছে, এবং একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে যত ছোটো হয়েছে তত নিঃসঙ্গতা ও নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করে চলেছে প্রবীণদের।

এই বৃদ্ধ বৃদ্ধারাও চান তাঁদের সন্তান সন্ততিরা জীবনের কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করে সমৃদ্ধি লাভ করুক, উপভোগ করুক জীবনের অনিন্দ্য স্বাদ। কিন্তু তাই বলে মানবিক গুনগুলো ও বৃদ্ধ পিতা মাতার প্রতি দায়িত্ব নিজের অগ্রগতির রথের চাকায় পিষে এগিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। অতএব এই অসহায় বৃদ্ধ মানুষদের ভালো রাখার দায়িত্ব পরিবারের সন্তান সন্ততিদের। তবে অনেক ক্ষেত্রে ছেলে মেয়েরাও পিতা মাতার থেকে দূরে থাকার কারণে কষ্ট পায়। শুধু ফোনে কথা বলে কিংবা টাকা পাঠিয়ে বৃদ্ধ বাবা মায়ের একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা তাঁরা দূর করতে পারে না। এই বিষয় তাঁদেরকেই সমাধান করতে হবে যাতে বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। সরকারেরও উচিত সহায় সম্বলহীন প্রবীণ নাগরিকদের বৃদ্ধকালীন ভাতা ও পেনশনের ব‌বস্থা, যথার্থ স্বাস্থ্য পরিষেবার বন্দোবস্ত এবং সকলের জন্য সামাজিক সুরক্ষা প্রদান করা।