সম্পাদকীয়

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে ‘ট্রোল’ করাটা বাঙালি ফ্যাশন হিসেবেই নিয়েছে

Bengalis have taken it as a fashion to 'troll' Sourav Ganguly

Truth Of Bengal: জয়ন্ত চক্রবর্তী: আমি জানি যে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হলেই গড়পড়তা সত্তর শতাংশ বাঙালির আমি বিরাগভাজন হব। তাও সত্য কথাটা মা লিখে পারছি না— সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে ট্রোল করাটা আজ যেন বাঙালির ফ্যাশন হয়ে গেছে। নেই কাজ তো খই ভাজ– নীতি অনুসরণ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় সৌরভকে ট্রোল করাটা বাঙালির অন্যতম হবিও বটে।

এত কথা লিখতাম না যদি না গত বৃহস্পতিবার চন্দননগরে সৌরভের একটা অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা না করতে যেতাম। এই অনুষ্ঠানে সৌরভের সঙ্গে তাঁর দাদা স্নেহাশস গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন। অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা চন্দননগর স্পোর্টিং আসোসিয়েশনের সম্পাদক বামপদ চট্টোপাধ্যায়, আমরা এবং স্বয়ং সৌরভ যাঁকে দামু নামেই চেনে, মাইক্রোফোন ধরেই কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে বলে ফেললেন, দুঃখ লাগে যখন দেখি সোশ্যাল মিডিয়ায় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ট্রোলড হচ্ছেন অকারণে। আমরা যারা মাঠের লোক তাঁরা দাদাকে এই ভাবে আক্রমণের শিকার হতে দেখে কষ্ট পাই।

২০১৫ সালে দাদা সিএবি-র সভাপতি হওয়ার পর জেলার অনুদান বাড়িয়ে দেন। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো একজন ক্রিকেটার বুঝেছিলেন যে বাংলার ক্রিকেটের আঁতুড়ঘর হচ্ছে জেলা। তাই জেলার অনুদান তিনি বাড়িয়েছিলেন। সেবারও চন্দননগরে এসেছিলেন সৌরভ। দশ বছর পরে আজ দ্বিতীয়বার চন্দননগরে পা দিলেন দাদা। তফাতের মধ্যে দাদা তখন এই ভাবে ট্রোলড হতেন না। দাদাকে এই ভাবে অন্যায় আক্রমণ করত না বাঙালি। দামুর বোধহয় স্বরণে নেই কিংবা মনে থাকতেও পারে সেদিনের সে অনুষ্ঠানেরও সঞ্চালক ছিলাম আমি।

সোশ্যাল মিডিয়ার তখন এতটা রমরমা হয়নি। সৌরভও এতটা বিতর্কিত হননি। বৃহস্পতিবার দামুর হাত থেকে কার্যত মাইক কেড়ে নিয়েই বলতে বাধ্য হলাম, হাজার ট্রোলেও মহারাজ (ওই নামেই আমি ডেকে থাকি সৌরভকে) বিচলিত হবে না। সমালোচনায় বাঙালির শিরদাঁড়া সোজা রাখার বিষয়টি তো আমাদের সৌরভই শিখিয়েছে। আমি যে কথাটি সেদিন সঞ্চালনায় বলিনি, আজ বলছি, ক’জন বাঙালি আছেন যে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে একটি অপ্রীতিকর ঘটনায় দল থেকে ছিটকে গিয়ে আবার ১৯৯৬ সালে ভারতীয় দলে ফিরে আসার মত সাহস সঞ্চয় করবে? লর্ডসে সেঞ্চুরি করবে?

নাটওয়েস্ট ট্রফিতে ইংরেজ ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে গিয়ে জামা খুলে খালি গায়ে লর্ডস-এর বালকনিতে প্রতিবাদ জানাবে? আমি সৌরভ ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক বলে নিন্দিত জানি, কিন্তু আমি কি দেখিনি সৌরভকে ধীরে ধীরে টিম ইন্ডিয়া তৈরি করতে, বুক চিতিয়ে লড়াই করার সাহস জোগাতে? মনসুর আলি খান পতৌদির আগে ভারত শুধু ড্র করার জন্যে ক্রিকেট খেলতো, মনসুর আলি খান এই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটান।

সৌরভের আমলে যা আরও আগ্রাসী হয়। মনসুর আলির পরে আর মহেন্দ্র সিং ধোনির আগে সৌরভের মতো নাছোড় কোনও ভারতীয় ক্রিকেট ক্যাপ্টেনকে তো দেখছি না এই সাহস নিয়ে, এই শৌর্য  নিয়ে দল পরিচালনা করেছেন! কলম্বো এশিয়া কাপে তাজ সমুদ্র হোটেলে বসে দেখিনি নাকি মহারাজকে দলের তরুণ ক্রিকেটারদের পাশে দাঁড়াতে? মহারাজের সততা নিয়ে বহু প্রশ্ন ওঠে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

নটিংহামশয়ারে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে একটা ম্যাচে সৌরভ লেগ বিফোর হল। প্রেস বক্স থেকে আমাদের দেখে মনে হয়েছিল বলটা মহারাজের পায়ে লাগেনি। কী মনে হল কলকাতায় প্রতিবেদন পাঠানোর আগে আমি এবং দা স্টেটসম্যান সংবাদপত্রের সাংবাদিক শ্যামসুন্দর ঘোষ টেলিফোন করলাম সৌরভের হোটেলে। গড়পড়তা ক্রিকেটার এই অবস্থায় কী বলতো?

বলতো আম্পায়ার বেনিফিট অফ ডাউট দিতে পারতেন (ফখনও ডিআরএস প্রথা চালু হয়নি)। আর সৌরভ কী বললেন– না না, আমি প্লাম্ব এলবিডব্লু ছিলাম। বলটা আমার পায়েই  লেগেছিল! পাকিস্তান ম্যাচের আগে সৌরভ আহত হন। তখন সোশ্যাল মিডিয়ার এত রমরমা ছিল না। তবু রটে যায় ফাস্ট বোলার শোয়েব আখতারের ভয়েই নাকি মহারাজের এই আহত হওয়ার নাটক।

ম্যাচের আগের দিন পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধা, ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া পায়ের পরিচর্যা করা মহারাজকে আমরা অর্থাৎ আমি ও তদানীন্তন আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্টার গৌতম ভট্টাচার্য দেখেছিলাম বিলেতের হোটেলের ঘরে বসে। দামুকে তাই আশ্বস্ত করতে পারি যে সৌরভের সততা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠার অবকাশ নেই।

প্রশ্ন উঠতেই পারে যে সেই সৌরভ আর এই সৌরভ কি একই ব্যক্তি? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সফরসঙ্গী হওয়াটা যদি সৌরভের অপরাধ হয় তা হলে তিনি অপরাধী। লন্ডনে বাড়ি থাকাটা যদি সৌরভ এর অপরাধ হয় তা হলে তিনি অপরাধী। যদি মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে লন্ডনের রাস্তায় সপরিবারে জগিং করাটা অপরাধ হয় সৌরভ তা হলে অপরাধী।

স্পেনে দাঁড়িয়ে সৌরভ যদি শালবনিতে স্টিল প্লান্ট গড়ার কথা বলেন তা হলে তাকে ‘শিল্পপতি’ বলে ট্রোল করা যায় যাক না। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যের একনম্বর সেলিব্রিটির তো ঘনিষ্ঠ যোগ থাকাটাই সঙ্গত। যে কারণে প্রয়াত তদনীন্তন মুখেমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তদানীন্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচাৰ্য-এর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল।

যে কোনও মুখ্যমন্ত্রী তাঁর রাজ্যের সেরা মুখটিকে ব্যবহার করে থাকেন। মমতাও তাঁর ব্যতিক্রম নন। অন্য রাজ্যেও একই ব্যাপার ঘটে।। অন্য রাজ্যের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য– এই রাজ্যে সেলিব্রিরি ট্রোলড হন। তবে সেলিব্রিটির তাতে কিছু আসে যায় না। ‘কুছ লোগ তো বোলেঙ্গে, লোগ কি তো কাম হ্যায় বলনেকা..!’

Related Articles