সম্পাদকীয়

শিল্প বিকাশে এক নতুন ভোরের জন্ম, স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলায় নতুন যুগের ছোঁয়া

A new dawn in industrial development, a new era in self-sufficient Bengal

ইন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়: ৩৪ বছরের বাম জমানাতেই বাংলার শিল্পের অন্তর্জলি যাত্রা ঘটেছিল। বামেরা অবশ্য স্বীকার করেন না, এখনও ল্যাজে ঠেলেন। বলেন, বামেদের আমলে শিল্পের সুসংহত পরিবেশ ছিল রাজ্যে। সেই সময়ের নাকি মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক দৃষ্টান্তস্বরূপ। তথাকথিত বাম নেতারা ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্পকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন, এটা নাকি ভিক্ষে। একটা সময় তারা বেকার ভাতা চালু করেছিল এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নথিভুক্ত বেকারদের জন্য, তাও মাসিক ৫০ টাকা, বছরে ৬০০ টাকা। সেটা স্থায়ী হয়নি, ২ বছর দেওয়ার পর দরজা বন্ধ। এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বেকারদের ২০ হাজার টাকা লোনের ব্যবস্থা হয়েছিল সেসরু প্রকল্পে, সেটাও ফ্লপ। যারা সেইসময় লোন নিয়েছিলেন, পরে ভিটে-মাটি বিক্রি করে ব্যাঙ্কের লোন পরিশোধ করতে হয়েছে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ দিয়ে। বেকার আরও বেকার হয়েছে। কোনও নতুন শিল্প হয়নি, উল্টে কল্যাণী থেকে ব্যারাকপুরের শিল্পাঞ্চলের তকমা হারিয়ে গিয়েছে। কল্যাণীর ২৫০টির বেশি কারখানা বন্ধ। ইট-কাঠও চুরি হয়ে গিয়েছে। লাল ঝাণ্ডার দাপটে শিল্প মালিকরা তটস্থ হয়ে গিয়েছিল। তবুও ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’, ‘বাংলার মজদুর এক হও’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে থাকতো বাম শাসনকালের সময়। ভরেছে ব্রিগেড।

তবে বাম জমানার শেষের দিকে শিল্পায়নের একটা চেষ্টা হয়েছিল। ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ নতুন স্লোগান দিয়ে। যদিও সেখানে কৃষিকে সমূলে উৎপাটনের ব্যবস্থা হয়েছিল, শিল্পের পরিকল্পনা কোনও শিল্পাঞ্চলে নয়, উর্বর কৃষি জমিতে, হুগলির সিঙ্গুর, অতিমাত্রায় যেখানে আলুর চাষ, দো-ফসলি, তিন-ফসলি জমি। যে জমিতে সোনা ফলে। বন্ধ্যা বা পতিত জমি হলেও কেন প্রশ্ন ছিল না, বিষয়টা ছিল অপরিকল্পিত ভাবনা ও বাম সরকারের গোয়ার্তুমি। তাতে যা হওয়ার ছিল তাই হল। চাষিরা ক্ষেপে গেলেন। শুরু হয়ে গেল কৃষক আন্দোলন। যার প্রভাব পড়েছিল বাংলা ছাড়িয়ে দেশ সর্বত্রই। কৃষকদের সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কৃষকদের সঙ্গে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। কেউ শিল্পের বিরোধী ছিলেন না। ছিলেন সেই সময়কার বাম সরকারের শিল্প নীতির বিরোধী। উর্বর জমিতে কেন শিল্প সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।

বামেরা এখনও কথায় কথায় বলেন, সিঙ্গুরের টাটা মোটরস-এর গল্প। মমতা নাকি শিল্পের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে কি তাই? শিল্প হোক, শিল্পের জায়গায়। তাই বলে কৃষকদের কাছ থেকে উর্বর জমি কেড়ে, তাদের রুজি-রুটির পথ বন্ধ করে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের চাকরির জন্য শিল্প?

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমানে যে শিল্প উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছেন তার মধ্যে অনেক বাস্তব দিক রয়েছে। একাধিক পরিকল্পনামাফিক এগোচ্ছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। আর সেই পথ ধরে বাংলায় বিনিয়োগ আসছে। শুধু দেশের বিনিয়োগকারীরা নন, বিদেশে বহু বিনিয়োগকারী বাংলায় বিনিয়োগ শুরু করেছেন।

যেখানে বার বার শিল্পপতিদের শিল্পের স্থান ঠিক করা, পরিকাঠামোগত ভাবনা, স্থানীয়স্তরে আলোচনা একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করেই তিনি একের পর এক শিল্প স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছেন। সেক্ষেত্রে সফলতাও মিলছে। বাম আমলের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মমতার তফাত এটাই যে, তিনি খুব প্র্যাক্টিক্যাল, কারও ওপরে নির্ভরশীল নয়, তদারকি তিনি নিজে করেন এবং বাংলাকে ভৌগোলিক দিক দিয়ে তাঁর হাতের তালুতে চেনা। স্মৃতিশক্তি তার প্রখর। আর বাম আমলে আধিকারিকদের রিপোর্টের ভিত্তিতেই কাজে এগোত। সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের মূল্যায়ন গতানুগতিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করেই কাজ করতেন, এখনকার মতো মাঠে-ময়দানে নেমে কাজ করতে হত না।

আজ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই শিল্পে নতুন জোয়ার আসতে চলেছে। বাংলার তরুণ, তরুণীরা তাই নতুন করে স্বপ্ন দেখছে। তিনি কোনও স্বপ্নের ফেরিওয়ালা নন, আচ্ছে দিনের গাল-গপ্পো নয়, কোনও প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তবিক অর্থে তিনি যেমন কথা দিয়েছেন, কথা রাখেনও, তাই তো উত্তরবঙ্গে ঢালাও উন্নয়ন, ঢালাও কর্মসংস্থান, এ জেলার ৩৬৫টি প্রকল্প, যার অর্থমূল্য ২৫০ কোটি টাকা। জেলার স্বাস্থ্যে নতুন সংযোজন, ধূপগুড়িতে ১০০ ও বানারহাটে ৩০ শয্যার হাসপাতাল। ১৯ মে তিনি শিলিগুড়িতে নর্থ বেঙ্গল বিজনেস মিট করেছেন। ৪টি শিল্প পার্কের উদ্বোধন, তার মধ্যে ৪০.৩৩ একর জমিতে ডাবগ্রাম শিল্পপার্ক, ব্যয় ২৮.৩৪ কোটি, ২৬.৭২ একর জমিতে আমবাড়ি ফালাকাটা শিল্পপার্ক, ব্যয় ১৭.৯০ কোটি টাকা, এথেলবাড়ি শিল্প প্রকল্পে জমির পরিমাণ ৪২.৭৩ একর, ব্যয়- ২২.২১ কোটি, জয়গাঁও শিল্প পার্ক, ১৩.৫০ একর জমি, ব্যয় ১০.৮৭ কোটি টাকা।

উত্তরবঙ্গের শিল্প নিয়ে এহেন ভাবনা তো ছিল না বামেদের। বাংলার মানুষও তো জানে সে কথা। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে তো লাভ নেই। গত একুশে এপ্রিল জঙ্গলমহলের শালবনিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্পের শিলান্যাস করেছেন। সেখানে জিন্দাল গোষ্ঠীর ৮০০ মেগাওয়াট করে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে, বিনিয়োগ ১৬ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলনে এবার প্রচুর প্রস্তাব রয়েছে বিনিয়োগের। শিল্প বিকাশে বাংলা এক নতুন ভোরের জন্ম দিয়েছে। যার রূপকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেউচা পাঁচামি প্রকল্পের মাধ্যমে কয়লার জোগানের ক্ষেত্রে ১০০ বছর নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চলছে। বাংলা এগোচ্ছে, বাংলায় কর্মসংস্থান বাড়ছে। অন্যকে বার্তা দিচ্ছে আর কারও কাছে হাত পাততে হবে না, পরজীবী নয়। স্বয়ং সম্পূর্ণ বাংলা। তাই কবির ভাষায় ‘দিসনে সময় কাটিয়ে তোরা সময় বিচার করে, ওরে নূতন যুগের ভোরে।’

Related Articles