স্বাস্থ্য

সুকৌশলে ঠকাচ্ছে, প্রতিদিন ঠকছি আমরা

Cheating skillfully, we are cheating every day

Truth of Bengal: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয়-এর দ্বিতীয়ভাগে শৈশবে আমরা সকলেই পড়েছি যে ‘না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে চুরি করা হয়’। কিন্তু বর্তমানে বয়সের অভিজ্ঞতায় প্রতিদিনই উপলব্ধ হচ্ছে যে, এই সংজ্ঞা শিশুশিক্ষার পক্ষে যথেষ্ট উপযোগী হলেও ‘চুরি’ শব্দটির অর্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে বড়ই অসম্পুর্ণ এবং সংকীর্ণ। কারণ বর্তমান সভ্যতায় যে বিচিত্র পদ্ধতিতে ও বিচিত্র কৌশলে চুরি হচ্ছে তা এত সরল সংজ্ঞায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এখন শুধু ‘না বলে’ নয় ‘বলে কয়েও’ ভুল বুঝিয়েও চুরি করা করা হচ্ছে। ব্যবসা ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সীমার অধিক লভ্যাংশে দ্রব্য সামগ্রীর বিক্রয়ও কিন্তু একপ্রকারের চুরি। আসুন কিছু উদাহরণ দেখা যাক এবার।

বহুজাতিক সংস্থার সৃদৃশ্য ফোলানো চিপসের প্যাকেটে আপনি জেনেশুনে পয়সা দিয়ে বাতাস কিনছেন। সোয়াবিন, চানাচুর-সহ বেশকিছু খাদ্য সামগ্রীর ১০০ গ্রামের প্যাকেট বলে যা কিনছেন তা কিন্তু৭০-৮০ গ্রাম। ৫০০ গ্রামের প্যাকেট মনে করে কিনছেন আসলে ৪০০ গ্রাম চানাচুর। ১ কেজি মনে করে কিনছেন ৯০০ গ্রামের ওটস, সস ইত্যাদি অনেক কিছুই। প্রত্যেকটি প্যাকেটেই কিন্তু সঠিক ওজন মুদ্রিত আছে। তাই না বলে কিন্তু বিক্রেতা বা কোম্পানি আপনাকে কিছু কম দিচ্ছেন না। কিন্তু সুকৌশলে তাঁরা নিয়ম মেনেই আপনাকে প্রতিদিন ঠকাচ্ছে। অসাধু কিছু ব্যক্তি ফোন করে সুকৌশলে আপনার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ব্যাঙ্ক জালিয়াতি করছে।

চাকরিজীবীরা যখন নির্দিষ্ট সময়ের পর অফিসে ঢুকে আবার ছুটির আগেই অফিস পালাচ্ছেন, মাস্টারমশাই, দিদিমনি যখন প্রতিদিন দশ মিনিট পর ক্লাসে যাচ্ছেন, শিক্ষার্থী স্কুলের পড়া না শুনছে না, হোমটাস্ক করছে না, শিক্ষার্থীরা স্কুল আওয়ারে প্রাইভেট টিউশান নিচ্ছে, প্রাইভেট মাস্টার মশাই নিজের সময়ের মুনাফা করতে স্কুল আওয়ারেই ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন, মিস্ত্রিভাই যখন বিড়িফুঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে সময় অতিবাহিত করে পুরো মজুরি বুঝে নিচ্ছেন– সবই কিন্তু চুরির শামিল। শুধু অর্থ বা দ্রব্য নয়; সময়, তথ্য থেকে শুরু করে অনুপ্রবেশ, জমির বেড়া এগোনো, অন্যের বা রাস্তার জমি দখল, খাদ্যদ্রব্যে সীমার অধিক রাসায়নিক সার, প্রিজারভেটিভ, নিষিদ্ধ রং মেশানো, পরকীয়া ইত্যাদি সবই কিন্তু চুরিরই নামান্তর।

বেশ কিছুদিন আগে সরিষা, রিফাইন, পাম-সহ সকল প্রকার ভোজ্য তেলের দাম আকাশছোঁয়া হয়েগিয়েছিল। রিফাইন তেল কিনতে হচ্ছিল১৬৫ টাকা লিটার দরে ও সরিষার তেলের লিটার পিছু দাম ২১০ টাকাও ছাড়িয়েছিল। সেই সময় তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে চানাচুর, গাঠিয়া-সহ সকল বেকারী প্রোডাক্টের মূল্যের সমানুপাতে বৃদ্ধি ঘটল। ৫৫ টাকার চানাচুরের প্যাকেটের দাম হল ৭৫ টাকা। ৫ ও ৬ টাকা মূল্যের সব চপের দাম হয়ে গেল ১০টাকা। আজকিন্তু২০১ টাকার সরিষার তেল ১৫৫ টাকা, ১৬৫ টাকার রিফাইনতেল মাত্র ১১২ টাকায় নেমে এসেছে। কিন্তু তেলে ভাজা দ্রব্য সামগ্রী কোনেওটির সমানুপাতে মূল্য কমেছে কি? এটা কি তাহলে চুরি নয়? আবার, শুধু ‘পরের দ্রব্য’ দ্রব্য নয় নিজেকে বা নিজেদেরও আমরা কম ঠকাই না।

বিড়ি, সিগারেট, মদ, গাঁজা, হেরোইন সবই আমরা ক্ষতিকারক জেনেও গ্রহণ করে আসলে নিজেদেরই ঠকাই। অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাছ কাটা, পুকুর, জলা ভরাট, ভূ-গর্ভের জলরাশি তুলে নেওয়া, কয়লা, পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের অপচয়, সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা কোন ‘পর’-ব্যক্তির দ্রব্য চুরি করি? যেরাষ্ট্রতার নাগরিককে স্বাস্থ্য বিমা দিতে পারে না, অগত্যা নাগরিক যখন নিজ অর্থে বেসরকারিভাবে তাঁর স্বাস্থ্যের বিমা করাতে অগ্রসর হন, তখন আবার সেই রাষ্ট্রই যখন এগিয়ে এসে তার ওপর কর বসিয়ে টাকা কাটে।

তখন কি সেটা চুরি নয়? এছাড়াও শিশুর পিঠে বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে শৈশব থেকে প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে নিয়ে নিজের সন্তানের শৈশব চুরি করতেও আমরা পিছুপাহইনা। আসলে আমরা সবাই জন্মগত ভাবেই চোর। পার্থক্য শুধু স্থান, কাল, ক্ষেত্র ও পদ্ধতিগত। আমরা কখনওই নিজেদের সংশোধন করিনা, কিন্তু অন্যকে চোর বলতে পারলে তৃপ্ত হই। আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে খাড়া করে নিজেদের চুরিকেও মহত্বে ভূষিত করি। তাই সেই কালজয়ী গানেরপঙতিই বারবার অন্তরে ধ্বণিত হয়—‘ন্যায় নীতি ত্যাগ করে, মানুষ আপোস ক’রে /চুরি গেছে আমাদের সব প্রতিরোধ’।