অফবিট

দুর্গার ৯টি রূপ ও তার ব্যাখ্যা কী জানেন?

Durga Pujo

The Truth of Bengal,Mou Basu: সর্বজনীনতার সর্বোত্তম প্রকাশ দুর্গোসবে। জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মঙ্গল কামনায় এমন বৃহত্তর আয়োজন অন্য কোনও উসবে আর দেখা যায় না। আর বাঙালির সত্ত্বায় রক্ত-মজ্জায় যে সাংস্কৃতিক ভাবটি মিশে আছে আদি-অনন্তকাল থেকে তা যেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যাপক ভাবে এই উৎসবটিকে ঘিরেই। সারা বছরের রোজ-নামচায় শাশ্বত আনন্দকে জীবনের প্রাঙ্গনে উদার চিত্তে আহ্বান জানানোর পরিকল্পনা তার রথের রশির টান ধরা থেকেই। তার পর চলে দিনে-দিনে পরতে পরতে তার প্রস্তুতি পর্ব। আসলে ধর্মাচরণকে উপলক্ষ্য করে সর্বসাধারণের পার্থিব ও অপার্থিব সুখ কতভাবে যে এই সর্বজনীন উৎসবে এসে মিশেছে তার ইয়ত্তা করা কঠিন। বাঙালির জীবন লীলার একান্ত পরিচয় বহন করে এই পুজো।

বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোসব। শরতের অরুণ প্রাতে শীরামচন্দ্র লঙ্কায় রাবণ-বধ করে সীতা দেবীকে উদ্ধারের সময় দক্ষিণায়ন কালে অর্থাৎ দেবতাদের ঘুমনোর সময় দেবী দুর্গার পুজো শুরু করেন। সে জন্য একে অকাল বোধন-ও বলা হয়। মহাশক্তিধারিনী মা দুর্গা আবহমানকাল থেকে অসুর বিনাশিনীরূপে আসমুদ্রহিমাচলে পূজিত হযে আসছেন। আসলে আদ্যাশক্তি মহামায়া হচ্ছেন শক্তিরূপিনী দেবী দুর্গার আদিরূপ। এই মহামায়ার মধ্যেই নিহিত আছে সর্বশক্তি। আর শক্তি হচ্ছে প্রাণস্বরূপ। প্রয়োজনমত সেই শক্তিকে জাগ্রত করার শ্রেষ্ঠ সময় হল নবরাত্রি।maithomythological

নবরাত্রি কী?

শরৎকালে আশ্বিন মাসের শুক্লা প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত ৯ দিন ধরে দেবী দুর্গাকে ৯টি বিশেষ রূপে আরাধনা করা হয়। দেবীর এই ৯টি রূপ নবদুর্গা নামে প্রসিদ্ধ। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে দেবীর এই নব রূপের বর্ণনা আছে অত্যন্ত সুন্দর ভাবে।

শৈলপুত্রী: মা দুর্গার নবরূপের প্রথম রূপটি শৈলপুত্রী নামে প্রসিদ্ধ। পর্বতরাজ হিমালযে কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করায় তাঁর শৈলপুত্রী নাম হয়। দেবীর বাহন ষাঁড়, তাঁর ডান হাতে ত্রিশূল আর বাম হাতে পদ্মফুল শোভাবর্ধন করেছে। নবরাত্রির প্রথমদিন এই দেবীর আরাধনা করা হয়। প্রতিপদে দেবীর শৈলপুত্রী রূপে যে পুজো করা হয় সেখানে ভক্তের প্রার্থনা থাকে সাংসারিক সুখ শান্তির জন্য। সন্তান-সন্ততিরা যাতে সুস্থ-সুন্দর জীবন কাটাতে পারে তারই প্রার্থনা থাকে।

ব্রহ্মচারিনী: মা দুর্গার দ্বিতীয় নবশক্তির রূপ হল ব্রহ্মচারিনী। ব্রহ্ম শব্দের অর্থ এখানে তপস্যা। ব্রহ্মচারিনী অর্থা তপশ্চারিনী। দেবীর রূপ এখানে জ্যোতিতে পূর্ণ, অতি মহিমামণ্ডিত। তিনি ডানহাতে জপের মালা ও বাম হাতে কমন্ডুলু ধারণ করে আছেন। শিবকে স্বামীরূপে পাবার জন্যই দেবীর এই ব্রহ্মচারিনী রূপধারণ। দেবীর এই দ্বিতীয় রূপ ভক্তদের অনন্ত ফল প্রদান করে। তাঁর উপাসনার দ্বারা সদাচার ও সংযম বৃদ্ধি পায়। মা ব্রহ্মচারিনীর কৃপায় সর্বদা সিদ্ধি ও বিজয় প্রাপ্তি ঘটে।

চন্দ্রঘণ্টা: মা দুর্গার তৃতীয় রূপ বা শক্তির নাম মা চন্দ্রঘণ্টা। নবরাত্রির তৃতীয় দিনে এই রূপেই মাযে পুজো করা হয়। পরম শান্তিদায়ক ও কল্যাণকারিনী রূপ দেবীর। দেবী দশভূজা, দশ হাতে খড়্গ, কৃপাণ, প্রভৃতি অস্ত্রে সজ্জিতা। দেবীর গাযে রঙ সোনার মতো, সোনার অলঙ্কারে দেবী সিংহবাহিনী ও রণ ভঙ্গিমায় উদ্যত। তাঁর চন্দ্রঘণ্টা নামটিও তাৎপর্যপূর্ণ। ঘণ্টার মতো চণ্ড ধ্বনিতে সর্বদা দানব-অসুর-দৈত্য ঠক ঠক করে ভয় কাঁপতে থাকে। ভক্তের সব বাধাবিঘ্ন-পাপ দূর হয় এই মাতৃ-আরাধনায়।

কুষ্মাণ্ড: মা দুর্গার চতুর্থ রূপ হল কুষ্মাণ্ড। নবরাত্রির চতুর্থ দিনে এই রূপে দেবীর পুজো করা হয়। দেবী অণ্ড অর্থা ব্রহ্মাণ্ড উপন্ন করায় তাঁকে কুষ্মাণ্ড দেবী বলে অভিহিত করা হয়। স্বল্প হাসি যুক্তা দেবীর রূপ অতি মনোহরা। সিংহবাহনা দেবী অষ”ভূজা। তাঁর ৭টি হাতে যথাক্রমে রয়েছে কমণ্ডুলু, ধনু, বাণ, পদ্মফুল, অমৃতপূর্ণ কলস, চক্র ও গদা। অষ্টম হাতে রয়েছে সকল সিদ্ধি আর ঋদ্ধি প্রদানকারী জপমালা। তিনিও সিংহবাহিনী। সংস্কৃত ভাষায় কুমড়োকে কুষ্মাণ্ড বলে। সকল বলি প্রদত্ত নৈবেদ্যর মধ্যে কুমড়ো বলি দেবীর সর্বাধিক প্রিয়। এজন্য তাঁকে কুষ্মাণ্ড দেবী বলা হয়। নবরাত্রির চতুর্থ দিনে মা কুষ্মাণ্ডর উপাসনা করলে সব রোগ-শোক দূর হযে যায়। আয়ু-যশ লাভ ও আরোগ্য বৃদ্ধি হয়।

স্কন্দমাতা: মা দুর্গার পঞ্চম রূপটি স্কন্দমাতা নামে পরিচিত। স্কন্দ অর্থা দেব সেনাপতি কার্তিকের অপর নাম স্কন্দ। আর স্কন্দের মা হওয়ায় মা দুর্গার পঞ্চম রূপকে স্কন্দমাতা নামে অভিহিত করা হয়। অতি সুন্দর, আনন্দময়ী রূপ মা স্কন্দমাতার। চর্তুভূজা দেবী পদ্মের ওপর বসে আছেন, সে জন্য এঁকে পদ্মাসনাও বলা হয়। দেবীর বাহন হল সিংহ। বালক স্কন্দদেব দেবীর কোলে বসে আছেন। দেবী ওপরের ডান হাত দিযে পুত্রকে ধরে রেখেছেন। আর ডানদিকের নীচের হাত দিযে একটি পদ্মফুল ধরে আছেন। বাঁদিকের ওপরের দিকের হাতটি বরাভয় মুদ্রা রূপে নেমেছে আর নীচের দিকে হাতটি একটা পদ্মফুল ধরে আছে। মায়ের এই অতীব সুন্দর রূপ দেখে ভক্তের মন পব়িপূর্ণ হয়ে ওঠে, সকল ইচ্ছা পূরণ হয়। সন্তান কল্যাণ ও সাংসারিক সুখ শান্তির জন্য মা স্কন্দমাতার আরাধনা অতীব ফলদায়ক।

কাত্যায়ণী: মা দুর্গার ষষ্ঠরূপ পরিচিত কাত্যায়ণী রূপে। দৈত্যরাজ মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গ, মর্ত্য আর পাতাল-ত্রিলোক যখন কম্পিত তখন তার বিনাশের জন্য ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর তাঁদের নিজ নিজ তেজের অংশ দিয়ে সৃষ্টি করলেন এক দেবীমূর্তি। আর মহর্ষি কাত্যায়ণ মর্ত্যে তাঁকে আবাহন করলেন নিজ কন্যা রূপে। তিনিই প্রথম তাঁকে আরাধনা করেন। কাত্যায়ণের কন্যা তাই নাম রাখা হয় কাত্যায়ণী। আশ্বিনের শুক্লা-সপ্তমী-অষ্টমী ও নবমী-তিন দিন ধরে দেবী কাত্যায়ণী পূজা গ্রহণ করেন ও দশমীর দিন মহিষাসুরকে বধ করে ত্রিলোককে অসুর মুক্ত করেন। মাতা কাত্যায়ণী অমোঘ ফলদায়িনী। অতি সুষমামণ্ডিত ও দিব্যরূপ মায়ের। সোনার মতো গায়ের রঙ মায়ের। চর্তুভূজা মা সিংহবাহিনী। ডানদিকের ওপরের হাত দিযে অভয়দান করছেন আর নীচের হাতে ধারণ করছেন বরাভয়মুদ্রা।বাঁদিকের ওপরে হাত দিযে কৃপাণ ধরে আছেন আর নীচের হাতে পদ্মশোভিত। দেবী পরম কল্যাণকারিনী। তাঁর আরাধনায় ভক্তের ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ লাভ হয়ে থাকে।

কালরাত্রি: মা দুর্গার সপ্তম রূপ বা শক্তির নাম কালরাত্রি। ঘন অন্ধকারের মতো কালো গাত্রবর্ণ, এলোকেশী, গলায় বিদ্যুৎ চমকের মতো উজ্জ্বল মালা। দেবী ত্রিনেত্র বিশিষ্টা ও চোখের ৩টি তারা ব্রহ্মাণ্ডের মতো গোলাকার। তার থেকে বিদ্যুতের মতো দ্যুতি বের হয়। দেবীর নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ভয়ঙ্কর অগ্নিশিখা বের হয়। এর বাহন হল গাধা। চর্তুভূজা দেবীর ওপরের ডানহাতে বরমুদ্রা আর নীচের হাতে অভয়মুদ্রা। বাঁদিকের ওপরের হাতে লোহার কাঁটা ধারণ করেছেন। আর বামদিকের নীচের হাতে ধরেছেন খড়গ। মা কালরাত্রি দর্শনে ভয়ঙ্করী হলেও ইনি সর্বদা শভ ফল প্রদান করেন। তাই এঁর অপর নাম শুভঙ্করী। মাতা কালরাত্রি সব সময় দুষ্টের দমন করেন। তাই নিষ্ঠা ও ভক্তি সহকারে আরাধনা করলে তাঁর কৃপায় সার্বিক ভাবে ভক্তগণ ভয়মুক্ত হন।

মহাগৌরি: মা দুর্গার অষ্টম শক্তি হলেন মহাগৌরী। দেবীর গাত্রবর্ণ সম্পূর্ণ গৌরবর্ণ। দেবীর রূপ অতি প্রশান্ত ও প্রসন্নবদনা। শঙ্খ, চন্দ্র ও কুন্দফুলের সঙ্গে তুলনীয় দেবীর গাত্রবর্ণ। চর্তুভূজা দেবীর বাহন ষাঁড়। ডানদিকের ওপরের হাতে অভয়মুদ্রা আর নীচের হাতে ত্রিশূল ধরে রয়েছেন বাঁদিকের ওপরের হাতে ডমরু ও নীচের হাতে রয়েছে বরমুদ্রা। পতিরূপে শিবকে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যায় দেবী ভগবতীর শরীর একেবারে কালো হযে গিয়েছিল তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে যখন ভগবান শিব এঁকে গঙ্গার পবিত্র জলে স্নান করালেন তখন দেবীর শরীর অত্যন্ত গৌরবর্ণ হযে উঠল। তখন থেকেই তাঁর নাম হল মহাগৌরী। দেবীর এই রূপ শুভ ফলদায়িনী। দেবীর এইরূপের উপসনায় ভক্তের সব দৈন্য-দুঃখ, সর্ববিঘ্ন দূর হয়।

সিদ্ধিদাত্রী: নবম দিন অর্থাৎ শেষদিনে দেবীর যে শক্তিরূপের আরাধনা করা হয় তার নাম সিদ্ধিদাত্রী। মায়ের নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর পরিচয়। ইনি সর্বপ্রকার সিদ্ধি প্রদান করে থাকেন। চর্তুভূজা দেবী কখনও সিংহবাহিনী, কখনও পদ্মাসনা। মা ডানদিকের ওপরের হাতে ধরে রয়েছেন গদা আর নীচের হাতে চক্র। বাঁদিকের ওপরের হাতে ধরে রয়েছেন পদ্মফুল আর নীচের হাতে শঙ্খ। মা অত্যন্ত প্রসন্নবদনা আর বরাভয় দান করছেন। নিষ্ঠা ও ভক্তি সহকারে উপাসনায় সব কামনা পূরণ হয়। সব সিদ্ধি প্রাপ্তি হয়।

Free Access

Related Articles