
The Truth of Bengal: শালবন আর সাঁওতাল পল্লীর ভেতর দিয়ে ঝাড়গ্রাম থেকে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার গেলেই পৌঁছনো যায় জামবনি। জামবনির রাজবংশের গড়ই হল চিলকিগড়। কাছেই রয়েছে দুলং নদী। এই নদীর উপত্যকার একটা বিস্তৃত অংশ জুড়ে ছিল চিলকিগড় রাজাদের সীমানা। দুলং নদীর পশ্চিমে রয়েছে রাজবাড়ি, পূর্ব দিকে নদীর ওপারে গভীর জঙ্গলের মধ্যে কণকদুর্গা মন্দির। জঙ্গল অঞ্চল দখল করে নদী বেষ্টিত এই এলাকাকে ভিত্তি করেই চিলকিগড় রাজাদের গড় গড়ে উঠেছিল তা বলাই যায়। শালবনের ভেতর দিয়ে গ্রাম্য মেঠো পথ পেরিয়ে চিলকিগড়ের সামনে এসে দাঁড়ালে মনে হয়, বনেরই কোনও রাজা নির্জন এই চিলকিগড় থেকে চারপাশের এলাকার রাজত্ব চালাতেন। এই অঞ্চলে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ওঠে, জামবনির রাজারা কি এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা? বর্তমানে রাজবংশের উত্তরসুরীরা তা অবশ্য বলেন না। তাঁদের দাবি, তাঁদের পূর্ব পুরুষেরা এখানে এসেছিলেন প্রাচীন ভারতের ভিন রাজ্য থেকে।
তবে, রাজ্যশাসনের লক্ষ্যে তাঁরা আসেননি। রাজ্যলোভের কোনও আশাও ছিল না। এখানে আসার কারণ ছিল পুণ্য অর্জন। যদিও এর কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, পুরোটাই কিংবদন্তী। সেই সময় বঙ্গ এলাকা ছিল শ্রীক্ষেত্রের অংশ। তাই শ্রীক্ষেত্রে পুণ্যার্জনে এসে, কীভাবে রাজ্যলাভের দিকে রাজারা এখানে থেকে গেলেন, তা নিয়েই সন্দেহ রয়েছে ঐতিহাসিক গবেষকদের মধ্যে। ঐতিহাসিকদের মত, চিলকিগড় বা জামবনির রাজারা হলেন ধলভূমের রাজবংশেরই একটি শাখা। সিংভূম জেলার পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব অংশ এবং মেদিনীপুরের জেলার পশ্চিমাংশ জুড়ে ধলভূম পরগনা । ধলভূমে নাকি আগে ধলরাজারা রাজত্ব করতেন। জানা যায়, তারা নাকি রজক ছিলেন বলেন তাঁরা ধবল উপাধি পান। এই বিষয়টিকেও আধুনিক ইতিহাস গবেষকদের কাছে অতি কল্পনার বিষয়বস্তু মনে করেছেন। কারণ সেই কল্পিত ধবল রাজাদের পরাজিত করে বর্তমানের ধলভূম রাজবংশের আদিপুরুষ তার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ধল রাজাদের পরাজিত করেছিলেন বলে ধবলদেব উপাধি পেয়েছিলেন। আর এই রাজবংশ প্রায় সাতশো আটশো বছর ধরে এই অঞ্চলে রাজত্ব করেছেন। রাজবংশের কুলপঞ্জীর সূত্র থেকে এই তথ্য মেলে। অর্থাৎ প্রায় সাতশো বছর ধরে এদের রাজত্বের ইতিহাস পাওয়া যায়। কিন্তু কুলপঞ্জী ছাড়া এদের আর কোনও ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্য নেই। ধলভূম রাজের অধস্তন বিংশ পুরুষ রাজা জগন্নাথ ধবলদেব জামবনির তদানিন্তন রাজা গোপীনাথ সিংহের কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন বলে জানা যায়। গোপীনাথ অপুত্রক বলে তাঁর দৌহিত্র কমলাকান্ত জামবনির রাজ্য লাভ করেন। এই কমলাকান্তের বংশধররাই জামবনির রাজবংশ।
কিন্তু ধলভূমগড়ের ধলরাই কারা এবং জামবনির সিংহরাই কারা, তার কোনও ইঙ্গিত কোথাও রেকর্ড নেই। ইতিহাস গবেষকদের মত, একটা সময়ে জঙ্গলমহলের আদিবাসী সর্দাররাই রাজত্ব করতেন। পরে তাদের মধ্যে কেউ কেউ বহিরাগতদের দ্বারা উৎখাত হয়েছেন। ১৭৭০ সালে মীরকশিম নবাব নাজিমের সিংহাসনে বসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে যখন পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামসহ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলা দান করেন, তার কিছুদিন পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্তের সারা জঙ্গলমহল জুড়ে বিদ্রোহের আগুন ছড়াতে শুরু করে। সেই আগুন ক্রমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে জনবিদ্রোহে রূপান্তরিত হয়, সময়টা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে। প্রধানত স্থানীয় আদিবাসীদের গণবিদ্রোহ বলে ইংরেজরা এর নাম দেয় চুয়াড় বিদ্রোহ। এই চুয়াড় বিদ্রোহই ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম গণবিদ্রোহ। এবং বাংলার পশ্চিম সীমান্তই সেই বিদ্রোহের ক্ষেত্র। জঙ্গলমহলের অন্যান্য স্থানীয় রাজাদের মতো ঝাড়গ্রাম ও জামবনির রাজারাও প্রথমে ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করতে চায়নি। কিন্তু ১৭৬৭ সালে ফার্গুসেন সাহেবের সিপাইরা রাজদুর্গ দখল করতে সক্ষম হয়। সেই সময় রাজারা, বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। যদিও চুয়াড় বিদ্রোহ শুরু হলে, এই সামন্ত রাজারা প্রত্যক্ষ ও পরক্ষোভাবে উৎসাহ দিতে থাকেন। জামবনির রাজাদের ইতিহাস তুলে ধরতে গেলে তাদের কুলদেবীর কথা তুলে ধরতেই হয়। জামবনির রাজাদের যে কনকদুর্গা দেবী, তিনিই চিলকিগড়ের প্রধান দেবী। গভীর জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ি দুলুং নদীর পাড়ারে উপর কনকদুর্গার দেবালয় নির্মিত হয়েছে। আগে পঞ্চরত্নের একটি মন্দির ছিল।
সেটির বর্তমানে অবশিষ্ট নেই। কিংবদন্তী রয়েছে, একসময় এখানে নরবলি দেওয়া হত। কিন্তু ইতিহাস গবেষকদের মত, আগেকার দিনে জঙ্গলের রাজারা এই দেবীর সামনে শত্রুপক্ষকে মুণ্ডচ্ছেদ করে শাস্তি দিতেন। গবেষকদের মত, জঙ্গলমহলের কোনও বনদেবী হয়েছেন বনদুর্গা এবং পরে জামবনির রাজাদের রাজকীয় পোষকতায় কনকমণ্ডিত হয়ে তিনি কনকদুর্গা নাম ধারণ করেছেন। আজও দলুং নদীর তীরে কনকদুর্গা যেখানে বিরাজ করেন, সেখানকার পরিবেশে যেন হারানো অতীতের আরণ্যক হিংস্রতার গন্ধ বাতাসে ভেসে আসে। গা ছম ছম করে। কনকদুর্গা ছাড়াও, চিলকিগড়ে বিখ্যাত রঙ্কিনী দেবীও আছেন। জামবনিতে তিনি খুব বিখ্যাত না হলেও, রাজবাড়ির সীমানার মধ্যে তাঁর অধিষ্ঠান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রাজবংশের কুলদেবতার মতোই তিনি পূজিত হন, অথচ কনকদুর্গার কনকের সমারোহের কাছে তাঁর প্রতিপত্তি যেন চাপা পড়ে গিয়েছে। ধলভূম রাজাদের সঙ্গে রঙ্কিনী দেবীর সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ট। কিংবদন্তী রয়েছে রঙ্কিনী দেবী আগে ছিলেন খড়গপুরের কাছে। সেখানে পীর লৌহানির সঙ্গে তাঁর লড়াই হয়। লড়াই মূল কারণ হল নরবলি নিয়ে বিবাদ।
গ্রামের লোককে পালাক্রমে রঙ্কিনীদেবী একটি করে মানুষ জোগাতে হত, নরবলির জন্য । একবার এক বিধবার পালা পড়ে। বিধবার ছিল একটি মাত্র পুত্র সন্তান। তার দুঃখে সে যখন কাতর হয়ে কাঁদছে, তখন পীর লোহানি, তার জন্য ওকালতি করতে যান রঙ্কিনীদেবীর কাছে। পীরের সঙ্গে দেবীর বিবাদ হয় এবং লড়াইও হয়। পীরের কাছে হেরে গিয়ে দেবী খড়গপুর ছেড়ে ধলভূম রাজাদের কাছে জঙ্গলভূমিতে চলে যান। ধলভূমের রাজারা তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে নরবলির ব্যবস্থা করেন। কিংবদন্তীর মধ্যে পীরের মহানুভবতা কৌশলে প্রচার করা হলেও, রঙ্কিনী দেবীর আনুষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্যটি লক্ষনীয়। রঙ্কিনীও যে জঙ্গলের দেবী, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পশ্চিম মেদিনীপুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু ইতিহাস। তার মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় অঞ্চল গড়বেতা। আর এখানেই রয়েছে এক প্রচীন জনপ্রিয় সর্বমঙ্গলার মন্দির। এই মন্দিরকে ঘিরে গড়বেতা অ়ঞ্চলে বহু কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। যেমন, উজ্জয়িনীতে মহারাজ বিক্রমাদিত্য যখন রাজা ছিলেন তখন একজন যোগী পুরুষ বগড়ীর বনপ্রদেশ ঘুরতে আসেন। গভীর অরণ্যে তিনি মন্ত্রবলে দেবী সর্বমঙ্গলার মন্দির নির্মাণ করেন। তারপর
মহারাজা বিক্রমাদিত্য লোকমুখে গড়বেতার সর্বমঙ্গলাদেবীর মহাশক্তির মাহাত্ম্যের কথা শুনে নিজে গড়বেতায় আসেন এবং শব সাধনা করেন। মহারাজের শব সাধনায় খুশি হয়ে দেবী তাঁকে অলৌকিক শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা দেন। এবং তালবেতালকে তাঁর আজ্ঞাধীন অনুচর করেন। মহারাজা শক্তি পরীক্ষার জন্য তালবেতালকে নির্দেশ দেন, দেবীর মূর্তিকে উত্তরমুখী করতে। তার ফলেই মন্দির উত্তরমুখী। এবং তাল বেতালের নাম থেকেই বেতা ও গড়বেতা নাম হয়। মহারাজা বিক্রমাদিত্যকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে। তবে সেইসব জনশ্রুতির মূল কোথায় তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। রাজা বিক্রমাদিত্য বঙ্গের গভীর অরণ্যে এসে শবসাধনা করবেন এমন কিংবদন্তী অবিশ্বাসযোগ্য। বরং মন্দিরের নির্মাণশৈলী দেখে গবেষকদের মত, সর্বমঙ্গলা মন্দিরের আগাগোড়া উড়িষ্যার রেখ দেউলের রীতি অনুসারে তৈরি। বগড়ী পরগনা পর্যন্ত যখন উড়িষ্যার রাজারা সাম্রাজ্য বিস্তার করে, এবং বগড়ি অঞ্চল জলেশ্বরের অধীন ছিল, তখনকারই ওড়িয়া স্থাপত্যকীর্তি হল সর্বমঙ্গলা মন্দির। সর্বমঙ্গলার মন্দির প্রায় তিরিশ হাত সুড়ঙ্গের মত পথের মধ্যে দিয়ে গিয়ে দেবীমূর্তির সামনে উপস্থিত হতে হয়। পুজারীর নির্দেশ ছাড়া সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। অনেকটা কামরূপ কামাখ্যার মন্দিরের কথা মনে পড়ে। গর্ভগৃহের প্রবেশ পথের সামনে দুপাশে দুটি পাথরের মূর্তি। একটি দেবীমূর্তি আর একটি ভৈরবের মূর্তি। এই দুটি মূর্তি গড়বেতায় কোনও একসময় পাওয়া যায়। সেটি তুলে মন্দিরে এনে রাখা হয়। গবেষকদের মত, দেবীর মূর্তি কোনও বৌদ্ধদেবীর মূর্তি। তবে এখানে সর্বমঙ্গলার মূর্তিটি বেশ ভয়ঙ্কর। কথিত আছে, এই দেবীর সামনে একসময় নরবলিও হত। গড়বেতাতেও একটা সময় দুর্গ ছিল, তা আজ মাটির তলায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সেই দুর্গের চারপাশে দেবতাদের অধিষ্ঠান ছিল। গোরা খাঁ পীর, ওলাইচণ্ডি, বাঘ রায়, বারভুঁইয়া। পশ্চিম মেদিনীপুরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এমন বহু ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি। সময়ের সঙ্গে তার বহু স্তর হারিয়ে গিয়েছে, কিছু রয়ে গিয়েছে, স্থাপত্যে, আর কিছু লোকাচারে। লৌকিক পুজার্চনায়।