সম্পাদকীয়

জলা ভরাটেরও যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে

Waterlogging also has a significant impact on temperature increase.

কাজল ব্যানার্জী: পৃথিবীর উত্তপ্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় তাপের মূল উৎস হল সূর্য। অতএব, সৌরতাপকে প্রতিহত করতে হলে নিয়মিত হারে জলের  বাষ্পীভবনের প্রয়োজন। কারণ ওই জলের বাষ্পীভবনের জন্য প্রয়োজনীয় লীনতাপ পরিবেশ থেকে গৃহীত হওয়ার ফলে পরিবেশের তাপমাত্রা হ্রাস পায়। আসলে বাষ্পীভবনে ওই তাপকে খরচ করতে পারলেই সেই তাপ বাষ্পের অনুগুলির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে ঊর্ধ্বাকাশে পৌঁছয় এবং সেখানে শীতল বাতাসের সংস্পর্শে পৌঁছে ঘণীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত হিসাবে জলের রূপে আবার মাটিতে নেমে আসে। অর্থাৎ জলের অনুগুলিই এক্ষেত্রে তাপের বাহক হিসাবে ওই তাপকে বহন করে উপরের শীতল স্তরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসে। এভাবেই নিয়ন্ত্রিত হয় পৃথিবীর  তাপমাত্রা।

আবার জলকে সরাসরি সৌরতাপের দ্বারা বাষ্পীভূত হতে হলে তা ভূ-পৃষ্ঠের উপরের স্তরে অবস্থান করা বাঞ্ছনীয়। কারণ ভূ-গর্ভের বা ভূ-অভ্যন্তরের জলের উপর সাধারণত এই তাপের তেমন কোনেও প্রভাব পড়ে না। এবং এই কারণেই শীতকালে নলকূলের জল গরম ও গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা থাকে। এখন বৃষ্টির জল ভূ-পৃষ্ঠে পতিত হওয়ার পর তার কিছু অংশ নদী, নালা, পুকুরে জমা হলেও অধিকাংশ অংশই মাটিতে শোষিত হতে হতে কালক্রমে ভূ-গর্ভে পৌঁছে যায়। সেই জল ভূ-ত্বকের উপরি স্তরে অবস্থান না করার ফলে সরাসরি সৌরতাপ বা ভূ-পৃষ্ঠ দ্বারা শোষিত তাপের দ্বারা বাষ্পীভূত হতে পারে না। একমাত্র উদ্ভিদের উপস্থিতিই ওই বৃষ্টিপাত ঘটিত জলকে অভিকর্ষের বিরুদ্ধে উপর দিকে টেনে রেখে উপরের মাটিকে সিক্ত রাখতে সাহায্য করতে পারে। যার ফলে বৃষ্টির জলের পাতাল গমন রোধ হতে পারে। এছাড়া ভূ-পৃষ্ঠের উপরিতলে জলকে ধরে রাখার বা ভূ-ত্বককে সিক্ত রাখার অন্যতম মাধ্যম হল পুকুর, নদী, নালা, খাল, বিল, খাড়ি, ভেড়ি ইত্যাদি। এই জলাশয়গুলিতে জমে থাকা বৃষ্টির জল ধারাবাহিকভাবে বাস্পায়নের মাধ্যমে পৃথিবী পৃষ্ঠের তাপমাত্রাকে কমায়।

পৃথিবী পৃষ্ঠের ৭১ শতাংশই কিন্তু জলভাগ এবং অবশিষ্ট মাত্র ২৯ শতাংশ স্থলভাগ। পৃথিবী পৃষ্ঠের ওই জলভাগের মধ্যে ৯৭ শতাংশই সমুদ্র। এই সীমাহীন সমুদ্রের মধ্যে কিন্তু কোনেও বড় উদ্ভিদের চিহ্ন মাত্র নেই। তবুও সেখানেই সব থেকে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। পৃথিবীর উপর সারা বছর যত বৃষ্টিপাত ঘটে তার ৭৮ শতাংশই কিন্তু সমুদ্রের উপর ঘটে থাকে। এর কারণ হল সৌরতাপে সমুদ্রের জলরাশির সরাসরি বাষ্পীভবনের ফলে অনেক বেশি বাষ্পী সমুদ্রের উপরের আকাশে মেঘরূপে সঞ্চিত হয় এবং শীতল বায়ুর সংস্পর্শে বৃষ্টিপাত রূপে সমুদ্রের উপরেই নেমে আসে। অর্থাৎ, যেখানে জলের উৎস বেশি সেখানে বাষ্পীভবনের হারও বেশে এবং বৃষ্টিপাতও বেশি। তাই পৃথিবীর পৃষ্ঠের উপর যেখানে স্থলভাগ এবং বিশেষত মানুষের বসবাস সেখানে জলাভূমি থাকা একান্ত আবশ্যক। বসবাসস্থলের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জলাভূমি না থাকলে কিন্তু সেই এলাকা তাপপ্রবাহের কবলে পড়বেই এবং সেখানে বৃষ্টিপাতও কমতে থাকবেই।

বর্তমান সময়ে নগরায়নের সূত্র ধরে বুজে যাচ্ছে একের পর এক পুকুর, নালা সহ অন্যান্য জলাভূমি। ফলে বর্ষার জল স্থানীয়ভাবে কোথাও জমে থাকার সুযোগ পাচ্ছে না। অগত্যা সেই জলরাশি নালী পথে প্রবাহিত হতে হতে একসময় নিকটস্থ নদী এবং নদীর মাধ্যমে বাহিত হয়ে অবশেষে সমুদ্রেই পতিত হচ্ছে। ফলস্বরূপ পৃথিবী পৃষ্ঠে আপতিত প্রায় সমস্ত বৃষ্টির জলেরই সমুদ্রের দিকে অভিগমন ঘটার ফলে জলরাশির অবস্থানগত মেরুকরণ ঘটে যাচ্ছে। সেইসূত্রে জলের বাষ্পীভবন এবং সেই বাষ্পীভবন অনসৃত বৃষ্টিপাতও সমুদ্রমণ্ডলে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।

সূতরাং, বসবাসযোগ্য এলাকায় বাসভূমি ও জনসংখ্যার সঙ্গে সমতা রেখে পর্যাপ্ত জলাভূমির সুষম বিন্যাস নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অন্যথায়, যত যেখানে জলাভূমি হ্রাস পাবে, সেখানে ততই কমবে বৃষ্টিপাত এবং বাড়বে তাপপ্রবাহ। তাই জীবনধারণে স্বার্থে বাসভূমির পরিবেশকে সুস্থ রাখতে জলাভূমি ভরাট রোধে সরকার ও প্রশাসনকে অনেক বেশি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং সেটা নিশ্চিত করতে জনসাধারণকেই সরকার এবং প্রশাসনের উপর চাপ তৈরি করতে হবে। আবার সেই কাজে সর্বাগ্রে প্রয়োজন জনসাধারণের সচেতনতা।

Related Articles