ফিচার

যাদবপুরের বুদ্ধদা

Buddha of Jadavpur

Truth Of Bengal: সৌরভ গুহ: যাদবপুরের বৌদ্ধ সাম্রাজ্যের বিতর্কিত সেনাপতি “লেফটেন্যান্ট কর্ণেল” খোকন ঘোষ দস্তিদার ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন, পার্টি কনভেনশন ফেলে।

২০০৬ সাল, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পার্টি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে যাদবপুরের পাটুলি প্রজেক্ট অঞ্চলে। তিনদিন ধরে চলা কনফারেন্সের শেষ দিন। নবনির্বাচিত কমিটি গঠনও সমাপ্ত। আর কিছুক্ষণ পরই পাতপেড়ে একটু ভালোমন্দ খাওয়ার আয়োজন শুরু হবে। হঠাৎ-ই কনফারেন্স রুম থেকে পেছনে হেঁসেলের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ানো শুরু করলেন খোকন ঘোষ দস্তিদার, হঠাৎ কী হল কে জানে। সকাল থেকে গোটা কনফারেন্স জুড়েই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দুপুরে বাড়িতে খেতে যাবেন। তাই এক্ষুণি কনভেনশন কক্ষ ছাড়লেন। তারপরই খোকনবাবুর এই দৌড়।

আরে হলো কী বলুন তো। পাটুলি প্রজেক্টের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এসে রান্নার ঠাকুরের ওপর প্রায় হামলে পড়লেন খোকন।

-মাংস রান্না কি শেষ হইসে।

-না, আর একটু কিছুক্ষণ লাগবো। ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে জানাল রান্নার ঠাকুর।

-হাতে তাড়াতাড়ি বার। তাড়াতাড়ি জনরা। বুদ্ধদা বইসা আসে। -আরও দশ মিনিট। তেড়িয়া নেতার দিকে তাকিয়ে জানালেন রান্নার ঠাকুর।

এদিকে সেনাপতির তো ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বামফ্রন্ট সরকারের পোস্টার বয় বুদ্ধদের ভট্টাচার্য গাড়িতে বসে আছেন। কনফারেন্সের জন্য রান্না করা খাসির মাংস বাড়ি নিয়ে যাবেন। রবিবারের দুপুর। খাসির মাংস দিয়ে মেয়ের সঙ্গে জমিয়ে লাঞ্চ করবেন বুদ্ধবাবু। কনফারেন্সের শেষ দিন সকালে এসেই খোঁজ নিয়েছেন ভালো মন্দ কী রান্না হচ্ছে হেঁসেলে। খাসির মাংস হচ্ছে শুনেই বলে রেখেছেন দুপুরে বাড়িতে খেতে যাওয়ার সময় টিফিন কেরিয়ার করে নিয়ে যাবেন, খানিকটা মাংস। তারপর শুরু হয়েছে কনফারেন্স।

প্রতিনিধিদের জবাবি ভাষণ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে কেটে গেছে দীর্ঘ সময়। দুপুর দেড়টা নাগাদ কনভেনশন কক্ষ ছেড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে যাবেন বুদ্ধবাবু। গাড়িতে উঠতে গিয়ে খোকনবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘যা দেবে বলেছিলে। দিয়ে দিয়েছ”। নেতার কথা শুনে তো মাথায় হাত খোকন ঘোষ দস্তিদারের, আরে তাই তো, ভয়ঙ্কর ভুল হয়ে গেছে। ড্রাইভার ওসমানের হাতে মাংসের টিফিন কেরিয়ারটা তো দেওয়াই হয়নি। আর তারপরই খোকনবাবুর ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়। পাটুলি মেইন রোড থেকে সোজা হেঁসেলে। রান্নার ঠাকুরের প্রায় ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলে সেনাপতির নির্দেশ-এইতো হইয়া গেসে। এইবার কেরিয়ার ভরেন।

পড়ি কি মরি করে মাংস টিফিন কেরিয়ারে ভরেই আবার দৌড় লাগালেন খোকনবাবু। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখনও ঠায় গাড়িতেই বসে আছেন। টিফিন কেরিয়ারে মাংস নিয়েই সেদিন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন বুদ্ধ। বাংলার রাজনীতি সম্পর্কে ন্যূনতম খোঁজ খবর রাখেন, যে কেউ বুদ্ধবাবুর এই গল্প শুনে বিশ্বাসই করতে পারবেন না।

সফিসটিকেশনের চূড়ান্ত, খানিকটা নাক উঁচু বলেও পার্টির ভিতরে বাইরে সমালোচিত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কিনা ঝাড়া পনেরো মিনিট গাড়িতে বসে সিগারেট টেনে গেলেন সুস্বাদু মাংসের লোভে। তাও আবার বারোয়ারি হেঁসেলে রান্না। বাইরের লোকের সত্যিই বিশ্বাস করা কঠিন। তবে যাদবপুরের পার্টি আর পার্টি কমরেডদের সঙ্গে এমনই সাবলীল ঘরোয়া আর অন্তরঙ্গ সম্পর্কই ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। সে কথা কী আর বোঝেগো আনজনে। যাদবপুরই চেনে তাদের বুদ্ধদাকে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এসেছেন এলাকারই এক ছোটো অনুষ্ঠানে। স্বাভাবিক ভাবেই একের পর এক মালা, পুষ্পস্তবক, সম্বর্ধনা চলছে তো চলছেই। সম্বর্ধনা নিতে নিতে ক্লান্ত বুদ্ধবাবু একসময় এক মহিলা পার্টি কর্মীকে ডেকে বললেন “এইসব রজনীগন্ধা, জুঁইফুল দিয়ে কী হবে, তার চেয়ে তো কিছু বকফুল, কুমড়ো ফুল দিয়ে সম্বর্ধনা দিতে পারো। সম্বর্ধনাও হল, তারপর সুন্দর ভাজা করে বড়াও খাওয়া যাবে।

বকফুলের বড়া কি অপূর্ব তাই না। ইঙ্গিত থেকেই স্পষ্ট বক ফুলের বড়া নেহাৎই বেশ পছন্দ নেতার … পার্টি সংগঠনের মহিলা কমরেডদের মধ্যে খোঁজ খোঁজ পড়ে গেল। সুস্বাদু বকফুলের বড়া করতে পারদর্শী কে? খোঁজ করে পাওয়াও গেল রাঁধুনি। গাঙ্গুলীবাগান পার্টি অফিসের উল্টোদিকেই থাকতেন টুটুদি। টুটু গুহ। পার্টি অন্ত প্রাণ মানুষটি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জন্য বকফুল, কুমড়ো ফুলের বড়া রাঁধবার দায়িত্ব পেয়ে রীতিমতো পাগল। ঘরের সামান্য রান্না এত পছন্দ নেতার, ভাবতেই পারছেন না টুটুদি।

এর কিছুদিন পরেই গাঙ্গুলীবাগান অশোক ট্রাষ্টে পার্টির কোনো একটা কর্মসূচীতে এলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মিটিং শেষে দূদন্ড জিরিয়ে নেওয়ার পালা। জনাকয়েক পার্টি সদস্য রয়েছেন ঘরে। স্থানীয় নেতাদের নির্দেশ মতো টুটুদি ঢুকলেন। হাতে প্লেট ভর্তি বক ফুলের বড়া। আর চা। এত সামান্য অথচ মুখরোচক আয়োজন বাঙাল বাড়িতেই সম্ভব। আর খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে খাঁটি বাঙাল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে বকফুলের গন্ধ মাখা একটা আস্ত সন্ধ্যা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবেন তাতে আর সন্দেহ কী? বকফুল, কুমড়ো ফুল, কচু বাটা, কচুর শাক এসবই যে ভীষণ প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী মশাইয়ের। আর আবদারের জায়গা তার কাছে একটাই, যাদবপুর।

প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ মানেই যাদবপুরের তরফে প্রিয় বুদ্ধদাকে কিছু একটা আন্তরিক উপহার দেওয়ার চলতি রেওয়াজ। দামি গিফট নয়, কচুর শাক, মানকচু, সর্ষে, নারকেল দিয়ে বাটা, ভাল রসগোল্লা এই সবই আর কী? আর ছিল মাছ। বুদ্ধদের ভট্টাচার্যের পছন্দের প্রিয় মাছের পদ। কখনও আস্ত ইলিশ, কখনও রুই-কাতলা বা কখনও আবার কই মাছ।

একবার বাদরপুরের সিপি আই (এম) পাটির এক শাখা কমিটি বুদ্ধদের ভট্টচার্যকে উপহার দিয়েছিল এক হাড়ি জ্যান্ত কই। আসলে ঘটনাটা ঘটেছিল এইরকম, গাঙ্গুলীবাগান অরুণাচলের মাঠে এক অনুষ্ঠানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে কিছু উপহার তুলে দেওয়ার পালা। এটা ওটার পর স্থানীয় এক শাখা কমিটি তুলে দিল এক হাঁড়ি জ্যান্ত কই। এমনই জ্যান্ত যে হাঁড়ি হাতে রাখাই দায়। এই পড়ে কি সেই পড়ে। হাঁড়ি ঠেলে বেরিয়ে আসছে কই। হাড়ির ভেতরে কই-এর উদ্দাম ছটফটানি, আর প্রিয়তম মাছ হাতে বুদ্ধবাবুর মুখে হাসির ঝরনা। যাদবপুরের বহু প্রবীণ মানুষ এখনও বিলক্ষণ মনে রেখেছেন এসব ঘটনা।

বুদ্ধবাবুর রাজনৈতিক জীবনের জয়, পরাজয় হর্য-বিষাদের বিশ্বস্ত স্বাক্ষী গাঙ্গুলীবাগানের অরণাচলের মাঠ। বিধানসভা অঞ্চলের নির্বচনী প্রচারের শুরু, কিম্বা জেতার পর বিজয় সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে সাধারণ জমায়েত অরুণাচলের মাঠে। কোনও অনুষ্ঠান মানেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সশব্দ উপস্থিতি। আন্তরিক মেলামেশা। এই অরুণাচলের মাঠেই প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হত ‘যাদবপুর বইমেলা”। যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শুধু নামেই না, তার উপস্থিতির আন্তরিকতা রীতিমতো টের পাওয়া যেত। প্রতিবছর বইমেলার উদ্বোধক ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মঞ্চে উঠে অন্য সময় বহু কথা বললেও বইমেলায় এসে দু কথার বেশি কিছু প্রায় উচ্চারণই করতেন না। তবে দু-পাঁচ কথার বক্তব্য শেষ হওয়ার পরই গোটা মাঠ জুড়ে আব্দারের ঝড় উঠতো। একটা কবিতা, একটা কবিতা চাই। প্রতিবছর সমস্বরে একই আব্দার। আর দর্শকদের সমবেত আর্জিতে বুদ্ধবাবু শুরু করতেন কবিতা পাঠ। অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ –

“ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর

এখুনি অন্ধ বন্ধ করো না গা।”

সিঙ্গুর পর্বের ঝোড়ো সময়ে এমনই এক বছর বইমেলা উদ্বোধন করতে এসে বুদ্ধদের ভট্টাচার্য শুনিয়ে ছিলেন ‘দুঃসময়’ কবিতার এমনই কিছু লাইন। আরেকটা বিষায়ও প্রতিবছর পালা করে ঘটত বইমেলার মাঠেই, তা হল বইমেলা কমিটিয় দেওয়া বই উপহার। এ নিয়েও গল্প বিস্তর। যাদবপুর বইমেলা কমিটির এক সিধু জ্যাঠা’ ছিলেন। সিধু জ্যাঠার নাম ব্যোমকেশ চক্রবর্তী। নানা বিষয়ে, বিশেষত বই সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যোমকেশ বাবুর জানাবোঝা ছিল প্রশ্নাতীত। কোন বই আগামী দিনে সম্ভাব্য নোবেল পেতে চলেছে, তার একটা তালিকা প্রতিবছরই বইমেলা কমিটিকে দিতেন ব্যোমকেশ বাবু। সেই তালিকা আর ব্যোমকেশ চক্রবর্তীকে সঙ্গে করে কমিটির কোনো এক কর্তা অক্সফোর্ড বুক স্টোর কিং ক্রসওয়ার্ডস-এ যেতেন বই কিনতে। সেই বই উপহার দেওয়া হত মুখ্যমন্ত্রীকে। তার মধ্যে অবশ্য ন্যূনতম দুটো বই ফেরৎ দিয়ে অন্য কোনো পছন্দের বই নিয়ে আসতে হত। কারণ প্রতিবছরের তালিকার কোনও না কোনও বই বুদ্ধবাবুর আগে থেকেই পড়া।

বাংলার রাজনীতিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নামের সঙ্গে, নাক উঁচু, অহংকারী শব্দগুলো মিশে থাকে কারো কারো ধারণায়। যাদবপুর যদিও অন্যকথাই বলে। নেহাৎ টুটুদি আর এখন বেঁচে নেই। না হলে প্রতিবাদ করে বলতেন “কে বলেছে অহংকারী, সামান্য কুমড়ো ফুলের বড়া খেয়ে সে শিশুর মতো খুশি হয়, সে কী আদৌ অহংকারী হতে পারে? আমাদের বুদ্ধদা-কে তোমরা চিনলে না গো”!

সৌজন্যে: চেনা নেতা অচেনা নেতা

Related Articles