হাওড়ার ভোটবাগানে বিরাজ করছে তিব্বতী সংস্কৃতির ইতিহাস
Howrah's Vot Bagan, the epitome of Tibetan culture

Truth Of Bengal: বাংলার ইতিহাস ঘাঁটলে বহু মিশ্র ভাষা ও সংস্কৃতির খোঁজ মেলে, বেশ কিছু সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে, কিছু রয়ে গিয়েছে ইট কাঠ, পাথরের স্থাপত্যের মধ্যে। আজও সেই ঐতিহ্য বেঁচে আছে, কোনও না কোনও চোরাগলির বাঁকে। আজকের চেনা বাংলার অজানা কথায় এমনই বিষয়কে তুলে ধরবো, যার ইতিহাস বাংলার ঐতিহ্যে মূল্যবান।
বাংলার বুকে এক সময় তিব্বতী সংস্কৃতির গড় তৈরি হয়েছিল। খাস কলকাতার অদূরে হাওড়া জেলার বুকেই ছিল সেই গড়। তিব্বতী ভুটিয়াদের কথ্য ভাষায় ভোট বলা হয়ে থাকে।
তাদের একটি উপাসনা ও সাংস্কৃতিক স্থল গড়ে উঠেছিল। হাওড়া জেলার ঘুসুড়ির কাছেই রয়েছে ভোটবাগান এলাকা, অর্থাৎ ভোটেদের বাগান। এখন এখানে প্রশ্ন ওঠে, এই অঞ্চলে তিব্বতী ভুটিয়ারা কখন এলো, কীভাবে এলো? হিমালয়ের কোলে গড়ে ওঠা দেশ ছেড়ে, ঘুসুড়িতে গঙ্গার তীরে এমন মঠ তৈরি করার পিছনে উদ্দেশ্য কী ছিল? ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভোটবাগান হল একটি মঠ, দশনামী শৈব সম্প্রদায়ের মঠ। কলকাতা থেকে গঙ্গার উপর দিয়ে নৌকা বা লঞ্চে যেতে পশ্চিমতীরে ঘুসুড়ির ঘাটে দূর থেকে অনেকগুলি মন্দির দেখা যায়। এই বাড়ি ও মন্দির নিয়েই ভোটবাগান মঠ।
প্রায় আড়াইশো বছর আগে গঙ্গারতীরবর্তী এলাকায় নির্জন স্থানে মঠ স্থাপনার আসল উদ্দেশ্য ছিল, ধর্মপালন, উপাসনার পাশাপাশি বাণিজ্যের সঙ্গে যাতে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। ব্রিটিশ শাসক ওয়ারেন হেস্টিংস ও উত্তরভারতীয় দূরদর্শী দশনামী সন্ন্যাসী পুরাণ গিরির সম্মিলিত দৃষ্টি এই জায়গায় পড়েছিল। তাই এর ঐতিহাসিক মাহাত্ম্য আরও রয়েছে।
মঠের বাড়িটি চতুষ্কোণ বিশিষ্ট, মাঝে উম্নুক্ত প্রাঙ্গণে ফুলবাগান। প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকতেই সামনে মন্দির বা দেবগৃহ দেখা যায়। বাঁ দিকে দ্বিতলে মহন্ত মহারাজ অবস্থান করেন। বাস্তুকারদের মধ্যে গৃহনির্মাণের রীতির মধ্যে ভোট বা তিব্বতী প্রভাবের চিহ্ন রয়েছে। যদিও বর্তমানে সংস্কারের অভাবে তার রেশ প্রায় নেই বললেই চলে।
ভোটবাগান মঠ সংক্রান্ত ইতিহাসের তথ্য উদ্ধার করেছিলেন গৌরবসাক। তাঁর প্রকাশিত বিবরণ থেকে জানা যায়, ওমরাও গিরি গোঁসাই নামে ভোটবাগানে এক মঠের মহন্ত ছিলেন। তিনি গৌর বসাককে দুটি দুষ্প্রাপ্য তিব্বতী পাণ্ডুলিপি দেন। এবং চারটি ফার্সি ভাষায় লেখা মঠের সনদ।
পুরাণ গিরির নামে একখানি তিব্বতী ছাড়পত্র ছিল। চারটি সনদের মধ্যে একটি সনদে ১০০ বিঘা ও ৮ কাঠা জমি দানের কথা রয়েছে। গ্রহীতা ছিলেন পুরাণ গিরি গোঁসাই। আর একটি সনদে ৫০ বিঘা জমি দানের কথা আছে। সেই ৫০ বিঘা মহারাজা নবকৃষ্ণ , রাজচন্দ্র রায় ও রাজা রামলোচনের জমিদারি অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
সনদগুলি থেকে জানা যায়, ১৭৭৮ ও ১৭৮২ সালে পুরাণগিরি গোঁসাই ও পাঞ্চন লামা উভয়েই গঙ্গাতীরে প্রায় ১৫০ বিঘা জমি পান। বর্তমান ভোট বাগান অঞ্চলে মঠ ও মন্দির উদ্যানসহ প্রতিষ্ঠার জন্য। সেই সনদে স্বাক্ষর রয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে ওয়ারেন হেস্টিংসের।
প্রশ্ন ওঠে, তিব্বতী লামা, ইংরেজ শাসক এবং দশনামী মঠের প্রধান পুরাণ গিরির সংযোগ হয়েছিল কীভাবে? ইতিহাস থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ তিব্বতী বাণিজ্য ও রাজনৈতিক সম্পর্কের স্বার্থে ধর্মের মোড়কে এই মঠের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কারণ ওয়ারেন হেস্টিংসের নজর ছিল তিব্বত ও ভুটানের দিকে। ভুটান ও কোচবিহারের মধ্যে যখন সংঘর্ষ হয় তখন হেস্টিংস সেখানে হস্তক্ষেপ করে সৈন্য পাঠিয়ে। ভোটরাজ পরাজিত হয়ে তিব্বতী লামার মধ্যস্থতায় সন্ধি করেন। দলাইলামা নাবালক ছিলেন বলে পাঞ্চন লামা তখন রাজকার্য পরিচালনা করতেন। ভোটবাগান মঠ প্রথম প্রতিষ্ঠা হয়, প্রথম মিশনের পর।
বোগলের কাছে তাশী লামা গঙ্গাতীরে একটি মঠ প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল, তিব্বতী লামারা ভারততীর্থ পর্যটনের জন্য গিয়ে যাতে আশ্রয় পেতে পারেন ধর্ম সাধনা করতে পারেন। সেখানে তিব্বত ও বাংলার নয়া সূত্র যাতে তৈরি হয়। সেই সময়ই ভোটবাগান মঠ প্রতিষ্ঠা হয়। মঠ প্রতিষ্ঠার সময়ই আর্য তারা , মহাকাল ভৈরব, বজ্র ভ্রুকুটি, পদ্মপাণি প্রভৃতি যে সব বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবদেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা পুরাণ গিরি চিন ও তিব্বত থেকে এনেছিলেন।