রাজ্যের খবর

ভূতুড়ে ভোটারের সন্ধানে ‘ওঝা’ হয়ে মাঠে তৃণমূল

Trinamool takes to the field as 'oja' in search of ghost voters

Truth Of Bengal: ভূতুড়ে ভোটার নিয়ে সরগরম গোটা রাজ্য। দিল্লি এবং মহারাষ্ট্রে ভোটার তালিকায় ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। যা নিয়ে সরব হন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অভিযোগ, ভোটে জেতার জন্য অনলাইন পরিষেবাকে ব্যবহার করে এই ধরনের কারচুপি করেছে ভারতীয় জনতা পার্টি। সেই কারচুপি এবার বাংলাতে করতে চাইছে বিজেপি।

২৭ ফেব্রুয়ারি নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামের তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীসভায় এমন সতর্ক বার্তা দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, বাংলার লোক যাতে ভোট দিতে না পারে তাই বাইরের লোকের নাম ভোটার তালিকায় ঢোকাচ্ছে। হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, বিহার এইসব জায়গা থেকে নাম ঢোকানো হয়েছে। এই পরিকল্পনা রোখার জন্য দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের সজাগ থাকার নির্দেশ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশের পর গোটা রাজ্যজুড়ে ময়দানে নেমে পড়েছে রাজ্যের শাসক দল। ভুয়ো ভোটার ধরতে অন্য অনেক জায়গার মতো এবার বাড়ি বাড়ি অভিযান শুরু করল তৃণমূল।

শনিবার কলকাতা থেকে জেলায় জেলায় বাড়ি বাড়ি অভিযান চালাতে দেখা যায় তৃণমূল নেতা কর্মীদের। প্রত্যেকটি বিধানসভা এলাকায় এই কাজ দলের নেতা-কর্মীদের করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। নেত্রীর নির্দেশের পর তৃণমূল নেতারা ময়দানে নেমে পড়েছেন। কলকাতা থেকে জেলা সর্বত্রই হাতে ভোটার তালিকা নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন তাঁরা। শনিবার সাত সকালে নিজের নিজের ওয়ার্ডে ভোটার তালিকা হাতে বেরিয়ে পড়েন ফিরহাদ হাকিম, অসীম বসুরা।

বাড়ি বাড়ি ঘুরে খতিয়ে দেখলেন ভোটারদের নাম। চেতলার ৮২ নম্বর ওয়ার্ডে মেয়র ফিরহাদ হাকিম ভূতুড়ে ভোটারের খোঁজ চালান। ভুয়ো ভোটার ধরতে ৭০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অসীম বসু নিজের পাড়ায় সকাল থেকে বেরিয়ে পড়েন। বাড়ি ধরে ধরে ভোটার তালিকা মিলিয়ে দেখেন তাঁরা। দলনেত্রীর নির্দেশে শহরের অন্যান্য ওয়ার্ডেও কাউন্সিলররা এদিন ভুয়ো ভোটার খুঁজতে পথে নেমেছিলেন। বিধানগরে সুজিত বসু, কৃষ্ণা চক্রবর্তীর মট নেতারা কাউন্সিলরদের নিয়ে এলাকায় বাড়ি বাড়ি যান। এই অভিযান বজায় থাকবে।

একদিকে শহরে যখন এই অভিযান দেখা যায়, তখন পিছিয়ে ছিল না জেলা। বাংলার নানা জেলায় পথে নামেন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। আরামবাগ জেলা তৃণমূলের তরফে শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার কার্ড খতিয়ে দেখেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। নেতজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে তৃণমূলের কর্মী সম্মেলন থেকে দলের সুপ্রিমো যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই নির্দেশ মতো দিকে দিকে আসরে নেমে পড়েছেন দলের নেতা-কর্মীরা। শনিবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা ও কার্ড খতিয়ে দেখেন আরামবাগ সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান স্বপন নন্দী।

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরই ভোটার লিস্ট স্ক্রুটিনি নিয়ে কাজ শুরু হয় হাওড়া জেলাতেও। শনিবার বিকেলে হাওড়ায় তৃণমূলের সদর কার্যালয়ে ব্লক সভাপতি, বিধায়কদের নিয়ে এক বৈঠকে বসে হাওড়া সদরের তৃণমূল নেতৃত্ব। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন হাওড়া জেলা সদর তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি তথা বিধায়ক কল্যাণ ঘোষ, রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ রায়, বিধায়ক ডাঃ রানা চ্যাটার্জি, গৌতম চৌধুরী, সীতানাথ ঘোষ, দলের চেয়ারম্যান লগন দেও সিং সহ বিভিন্ন ব্লকের সভাপতিরা। কল্যাণ ঘোষ এদিন দাবি করেন হাওড়া জেলায় স্ক্রুটিনি করে অনেক ভুতুড়ে ভোটার নজরে এসেছে।

এই ব্যাপারে নির্দিষ্ট জায়গায় অভিযোগ জানানো হচ্ছে। ভুয়ো ‘ভুতুড়ে’ ভোটার ধরতে কিভাবে কাজ করা হবে তার রূপরেখা তৈরি হয় এদিনের বৈঠকে। স্থির হয়েছে এই ব্যাপারে জেলায় একটি কোর কমিটি করা হবে। এরই সঙ্গে প্রতিটি ব্লকেও কোর কমিটি তৈরি করে ওয়ার্ড, অঞ্চল এবং বুথস্তরে স্ক্রুটিনি করা হবে। ভোটার তালিকা হাতে নিয়ে তৃণমূল কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়েও স্ক্রুটিনি করবেন। এরপর রিপোর্ট তৈরি করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য জেলাশাসকের কাছে জমা দেওয়া হবে। এর পাশাপাশি বুথস্তরে তৃণমূল কর্মীদের নিয়ে একটি করে ‘সহায়তা ডেস্ক’ও করা হবে।

হুগলির চুঁচুড়া বিধাসভার কর্মীদের নিয়ে সেই ‘ভূত’ তাড়ানোর বৈঠক করে তৃণমূল। বৈঠকে পরিবহণ মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী, জেলা সভাপতি অরিন্দম গুঁইন, চুঁচুড়ার বিধায়ক অসিত মজুমদার সহ তৃণমূল নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন। সেখানে মন্ত্রী বলেন, দলের নির্দেশ রয়েছে প্রতিটা বিধানসভার প্রতিটা বুথের যে ভোটার তালিকা রয়েছে সেগুলি ভালো করে স্ক্রুটিনি করতে হবে।

প্রকৃত ভোটারের নাম আছে কিনা, ভুয়ো ভোটার ঢুকে আছে কিনা সেটা দেখতে হবে। আমরা চাই নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি করা। নির্বাচন কমিশন তত্ত্বাবধানে থাকে, কিন্তু অনলাইনের মাধ্যমে ভোটার তালিকা তৈরি সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেই ব্যক্তি না গিয়েই তার ভোটার কার্ড তৈরি হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনকে সামনে রেখে ভুয়ো ভোটার ঢুকিয়ে দেওয়ার একটা গভীর চক্রান্ত চলছে।

উত্তবঙ্গের কোচবিহারেও এই অভিযান জারি থাকে। শনিবার সকালে মাথাভাঙা তৃণমূলের শহর ব্লক নেতৃত্বে মাথাভাঙা পুরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডের  বুথে পর্যবেক্ষণের জন্য বাড়ি বাড়ি যান তৃণমূল নেতৃত্ব। তারা ভোটার লিস্ট খতিয়ে দেখে জানতে পারেন, ১৫ জন এমন ব্যক্তির নাম ভোটার লিস্টে থাকলেও একই এপিক নম্বরে উত্তরপ্রদেশের ভোটারের নাম রয়েছে। এই নিয়ে আতঙ্কিত ওইসব ভোটাররা।

বীরভূম জেলায় তৃণমূলের কোর কমিটির সদস্যরা ভুয়ো ভোটার ধরতে বৈঠক আয়োজন করেন। উপস্থিত ছিলেন বীরভূম জেলার তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, জেলা সভাধিপতি কাজল শেখ, লাভপুরের বিধায়ক অভিজিৎ সিনহা, বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ অসিত মাল থেকে শুরু করে বীরভূম জেলার তৃণমূলের বিধায়ক ব্লক সভাপতি, অঞ্চল সভাপতি থেকে শুরু করে তৃণমূলের অন্যান্য নেতা-কর্মীরা।

ভোটার তালিকা সংক্রান্ত অভিযোগ সহ অন্যান্য বিষয় দেখার জন্য ২৭ ফেব্রুয়ারি নেতাজি ইনডোরের সভায় একটি কমিটি তৈরি করে দিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। নেতৃত্ব থাকবেন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। কমিটিতে যে ৩৫ জন আছেন তাঁরা হলেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুজিত বসু, মলয় ঘটক, পার্থ ভৌমিক, ডেরেক ও’ব্রায়েন, উদয়ন গুহ, বিপ্লব মিত্র, অর্পিতা ঘোষ, মমতাবালা ঠাকুর, কাকলি ঘোষদস্তিদার, অরূপ বিশ্বাস, ফিরহাদ হাকিম, দেবাংশ ভট্টাচার্য, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, মালা রায়, সুদীপ বন্দোপাধ্যায়, নির্মলচন্দ্র রায়, সুমন কাঞ্জিলাল, সামিরুল ইসলাম, বাপি হালদার, পুলক রায়, জগদীশ বসুনিয়া, মোশারফ হোসেন, ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, মানস ভুঁইয়া, বীরবাহা হাঁসদা, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসু, প্রকাশচিক বরাইক, স্নেহাশিস চক্রবর্তী, সায়নী ঘোষ, তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য, বেচারাম মান্না ও সব্যসাচী দত্ত। এই কমিটি গঠন করে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আগামী সাত দিনের মধ্যে জেলাস্তরে একটা কমিটি আমরা করে দেবো। পাশাপাশি তিনদিন পর কতটা করতে পারবেন সেই রিপোর্ট তৃণমূল ভবনে সুব্রত বক্সির কাছে পাঠাতে হবে।’ তৃণমূল সুপ্রিমোর নির্দেশ মতো কলকাতা সহ জেলায় জেলায় শুরু হয়েছে ভূতুড়ে ভোটারের সন্ধান।

Related Articles