প্রীতিলতার বোন বাসন্তী ওয়াদ্দেদারও ছিলেন বীরাঙ্গনা, কজন জানে তাঁর ইতিহাস
Pritilata's sister Basanti Waddedar was also a heroine, but few know her history

সুব্রত দত্ত: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের কথা আমরা সবাই জানি। আমরা কি জানি তাঁর বোন বাসন্তীদেবী ওয়াদ্দেদারের কথা? ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাসন্তীদেবীর অবদানও কম ছিল না। ব্রিটিশ শৃঙ্খলমোচনে ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এই বীর বীরাঙ্গনাও। প্রীতিলতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মহিলাদের সঙ্ঘবদ্ধ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটিশদের কাছে ত্রাস। ১৯৩২ সালে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে সশস্ত্র আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। দিদির বিপ্লবী জীবন উদ্বুদ্ধ করেছিল বাসন্তীকেও। বাড়ির মধ্যে ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিবেশ। দিদির সেই স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও শক্তিশালী করতে নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মহিলাদের মধ্যে দেশ ভক্তি বাড়িয়ে তোলা ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে মহিলাদের একত্রিত করে সংগ্রামে নামার গোপন কাজটি নিরলস ভাবে করতেন প্রীতিলতার বোন। বিদেশি দ্রব্য বর্জনে যখন গোটা দেশে আগুন জ্বলছে তখন নিজেও মহিলাদের নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। ইংরেজদের বন্দুকের গুলিকে ভয় করেননি। একটাই লক্ষ্য ছিল, দেশ থেকে ইংরাজদের ভারত ছাড়া করা। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন দেশবাসীর সামনে।
অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রামের ধলঘাটে জন্মগ্রহণ করেন বাসন্তীদেবী ওয়াদ্দেদার। ১৯৩২ সালে দিদি প্রীতিলতার নেতৃত্বে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে সশস্ত্র আক্রমণ হয়। ১৫ জন বিপ্লবী অংশ নিয়েছিল। এই আক্রমণে। একজন নিহত এবং ১১ জন আহত হয়েছিলেন। প্রীতিলতা ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ার আগেই সায়ানাইড খেয়ে আত্ম-হুতি দিয়েছিলেন। এই ঘটনা বাসন্তীদেবীকে আরও শক্তিশালী করেছিল ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে। স্বাধীনতার গান গেয়ে, দরাজ কণ্ঠে বন্দেমাতরম স্লোগান তুলে ইংরেজ শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন যত শক্তিশালী হতে থাকে ততই ব্রিটিশ সরকারের কাছে ত্রাস হয়ে উঠতে থাকেন এই বীরাঙ্গনা।
বহুবছর আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল বাসন্তীদেবীকে। পরবর্তীতে কলকাতায় চলে আসা। স্বামীর সঙ্গে নদিয়ার রানাঘাটে থাকতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর দিশেহারা অবস্থা। কার্যত লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে যান এই বীর বিপ্লবী।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যান বাসন্তীদেবী ওয়াদ্দেদার। কেউ খোঁজ রাখেননি তাঁর। এমনকি ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও মেলেনি স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্বীকৃতি। অনেক পরে রানাঘাটের বিশিষ্টজনেরা তাঁর সন্ধান পান। আনুলিয়ার এক এঁদো গলিতে স্যাঁতসেতে ভাড়া বাড়িতে দিনযাপন। চরম দারিদ্রতা জীবনের সঙ্গী। ছেলের পরিবারে কোনো রকমে বেঁচে থাকা। রানাঘাট পুরসভা, নদিয়া জেলা প্রশাসন তাঁর সেই চরম দারিদ্র্যের দিনে সম্মান জানাতে উদ্যোগ নেন। পুরসভার তরফ থেকে চালু করা হয় মাসিক ভাতা। তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন নথি সংগ্রহ করে স্বীকৃতির আবেদন করা হয় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। জেলা প্রশাসনের তরফ থেকেও নেওয়া হয় উদ্যোগ। কিন্তু সেই উদ্যোগ আর কার্যকরী হয়ে ওঠেনি। চরম দারিদ্রতার মধ্যেই ২০১০ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন তিনি।
রানাঘাট পুরসভার পক্ষ থেকে বাসন্তীদেবী ওয়াদ্দেদারকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। সেইসময় নদিয়ার জেলাশাসক ছিলেন ওঙ্কার সিং মিনা। তিনি লেখেন, ‘আমি জেনে খুব আনন্দিত যে রানাঘাট পৌরসভা ৯ই আগস্ট ‘০৭ তারিখে রানাঘাট পৌরসভা প্রাঙ্গণে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে একজন বীর নারী শ্রীমতী বাসন্তী ওয়াদ্দেদার (সেনগুপ্ত) কে সংবর্ধনা প্রদানের জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
আমি এই সুযোগে ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য শ্রীমতী বাসন্তী ওয়াদ্দেদার (সেনগুপ্ত)-কে আমার শুভেচ্ছা জানাচ্ছি এবং পৌরসভার চেয়ারম্যানকে তাদের এই প্রচেষ্টার জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি।’
এই বীর-বীরঙ্গনার পরিবার কেমন আছে? সেই খোঁজ নিতেই পৌঁছে গিয়েছিলাম তাঁর রানাঘাটের আনুলিয়ার সেই স্যাঁতসেতে বাড়িতে। বাড়ির সেই বেহাল অবস্থা আজও একই রকম। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে স্বাধীনতার সংগ্রামীর স্বীকৃতি না পাওয়ায় সেভাবে জোটেনি সরকারি সাহায্য। স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে যেটুকু পাওয়া তার বেশি নয়।
বাসন্তীদেবী ওয়াদ্দেদারের পুত্র প্রতাপ সেনগুপ্ত জানান, স্বাধীন ভারতে মায়ের যে স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল তা তিনি পাননি। তবে তা নিয়ে তাঁর কোন আক্ষেপ ছিল না। শেষ দিন পর্যন্ত দরাজ কণ্ঠে বলে গিয়েছেন ‘বন্দেমাতরম’। বিভিন্ন সংগঠন মাকে আমন্ত্রণ করতেন। অশক্ত শরীর নিয়েও সেখানে ছুটে যেতেন এবং দেশ গড়ার আহব্বান জানাতেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও তাঁর গলা থেকে যেন বেরিয়ে আসতো গগনভেদী সেই আওয়াজ, ‘বন্দেমাতরম’।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ডাক নাম ছিল রানি। কলকাতার বেথুন কলেজ হোস্টেলে থাকাকালীন বোন বাসন্তীকে চিঠি লিখতেন। সেই চিঠি আজও সযত্নে আঁকড়ে রেখেছেন তাঁর পুত্র। রানাঘাট পুরসভার অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করেন তিনি। ভাড়া বাড়িতে থাকেন। তাঁর পুত্র তথা বাসন্তীদেবী ওয়াদ্দেদারের নাতি প্রতাপ সেনগুপ্তের পুত্র সৌনক বিরল অসুখে ভুগছেন। এইমস হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা হলেও এই রোগের কোন চিকিৎসা নেই বলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় ব্যাঙ্গালোরে চিকিৎসা করানো হয়েছিল। তবে লাভের কিছুই হয়নি। ওষুধের যা খরচ তা বহন করা এই পরিবারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। প্রতাপবাবু বলেন, একজন স্বাধীনতার সংগ্রামী পরিবারের এই করুণ পরিণতি। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে যদি মায়ের স্বাধীনতার সংগ্রামীর স্বীকৃতি মিলতো তবে হয়তো এই অবস্থায় আজ দাঁড়াতে হতো না। এই কঠিন সময়ে কেন্দ্র-রাজ্য ও শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ তাঁদের পাশে এসে দাঁড়াবেন এই প্রত্যাশা করছেন তিনি।