রাজ্যের খবর

বাংলার রয়েছে বহু আঞ্চলিক মিষ্টি, জানুন সেইসব মিষ্টির ইতিহাস

Bengal has many regional sweets, know the history of those sweets

Bangla Jago Desk: বিপ্লব চৌধুরী: বাঙালির কাছে মিষ্টি যেন অমৃত কুম্ভ, যার কোনো বিকল্প হয় না। মিষ্টি প্রেমী বাঙালি অবলীলায় দাবি করেন কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার করা থেকে কোনো অংশে কম নয় নবীন চন্দ্র দাসের রসগোল্লার আবিষ্কার। যদিও পরিসংখ্যান বলছে ভারত ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগের রাজধানী, তথাপি বাঙালির যেকোনো উৎসব-অনুষ্ঠান মিষ্টি ছাড়া অসম্পূর্ণ। বাঙালির কাছে মিষ্টি মানে শুধুই রসগোল্লা নয়।

পছন্দের তালিকায় আছে আরও অনেক ধরণের মিষ্টি। অঞ্চল ভিত্তিতে এই সব মিষ্টি প্রসিদ্ধ, কিন্তু তাদের স্বাদের খ্যাতি সর্বত্রই। প্রথমেই শুরু করা যাক শক্তিগড়ের বিখ্যাত ল্যাংচা দিয়ে। এই মিষ্টি লালচে বাদামী রঙের লম্বাটে দেখতে, যা তৈরি করা হয় ময়দা, ছানা, খোয়া, ঘি ও চিনি দিয়ে। কথিত আছে বর্ধমানের রাজ পরিবারের অনুরোধে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর নিজস্ব ময়রাকে পাঠিয়ে ছিলেন বর্ধমানে। সেই ময়রা খঞ্জ ছিলেন অর্থাৎ খুঁড়িয়ে চলতেন। তাঁর হাতে তৈরি এই মিষ্টির নাম হয়ে ওঠে ল্যাংচা।

এছাড়াও বর্ধমানের দুই বিখ্যাত মিষ্টি হল মিহিদানা ও সীতা ভোগ। কামিনীভোগ চাল গুঁড়ো করে তার সাথে ঘি, বেসন, চিনি ও জাফরান মিশিয়ে হয় মিহিদানা আর সীতাসের প্রজাতির গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে তৈরি করা হয় সীতাভোগ। রসগোল্লার পরেই বাঙালির আরেক পছন্দের মিষ্টি হল পান্তুয়া, যা ছানা বেটে তার সাথে ময়দা, গুড়, এলাচ গুঁড়ো মিশিয়ে তেলে ভেজে ও চিনির রসে ফেলে তৈরি করা হয়। রানাঘাটের পান্তুয়া বিখ্যাত। এরপর আসি কিছুটা ল্যাংচা ও কিছুটা পান্তুয়া পরিবারেরই একরকম সদস্য বলা চলে, নাম হল নিখুঁতি (বানানভেদে নিখুতি বা নিকুতি)। ল্যাংচার থেকে আকারে কিছুটা ছোটো আর পান্তুয়ার মতো ভিতরটা নরম হয় নিখুঁতির আর উপরে গোলমরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দেওয়া হয়।

পশ্চিমবঙ্গের শান্তিপুরের জনপ্রিয় মিষ্টি হল এই নিখুঁতি।কামারপুকুর অঞ্চলের প্রসিদ্ধ ও ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের খুব প্রিয় মিষ্টি সাদা বোঁদে যা রমা কলাইয়ের বেসন (বরবটির বেসন), আতপ চাল, ঘি ও চিনির রস দিয়ে তৈরি। এরপর আসি সেই মিষ্টির কথায় যা কিনা মনকে হরণ করে, নাম হল মনোহরা । হুগলি জেলার জনাইয়ের মনোহরার ইতিহাস দু’শো বছরের। মনোহরা নিয়ে নানা মত আছে। কেউ বলেন ব্রিটিশ আমলে জনৈক ব্রিটিশ সাহেবের হুকুমে এমন এক মিষ্টি তৈরির আদেশ করা হয় যা অনেকদিন পর্যন্ত ঠিক থাকে। তখন জনাইয়ের ষষ্ঠীতলার ময়রা ছানা ও চিনি মিশিয়ে এবং উপরে চিনির পুরু স্তর দিয়ে তৈরি করে সুস্বাদু এই মিষ্টি। আবার কেউ কেউ বলেন মনোহরার আবিষ্কারক আসলে ভীমচন্দ্র নাগের পিতা পরাণচন্দ্র নাগ। তৃতীয় মতে জনাইয়ের ময়রারা ভুলবশত সন্দেশকে চিনির রসে ডুবিয়ে দেন, জন্ম হয় মনোহরার। সন্দেশের নাম যখন এল, তাহলে ওই একই জেলার চন্দননগরের তালশাঁস বা জলভরা সন্দেশকে ভোলা যায় কি করে!

ছানা, চিনি, নলেন গুড় দিয়ে সন্দেশ তৈরি করে ভিতরে গোলাপজল ভরে পুনরায় সন্দেশের পুর দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। আবার ভাজা চিনে দিয়ে তৈরি নবদ্বীপের লাল দই জগৎবিখ্যাত। পাশের শহর কৃষ্ণনগরের দুধ, ঘি ও চিনি দিয়ে তৈরি দুই মিষ্টি সরভাজা ও সরপুরিয়ার কথা কে না জানে। মেদিনীপুর জেলার কাঁথির কাজু বরফির স্বাদ অনন্য। এই জেলার অপর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য মিষ্টি হল বাবরসা, ময়দা ও ঘি দিয়ে তৈরি। ক্ষীরপাই হল এর উৎপত্তিস্থল। কিছুটা অফবিট হলেও বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় মিষ্টি হল ম্যাচা বা মেচা সন্দেশ। মুগডাল ও চিনি দিয়ে তৈরি করা হয় এই মিষ্টি।

এরপরে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগরের ভুবন বিখ্যাত মিষ্টি জয়নগরের মোয়াকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। এই মোয়া কণকচূড় ধানের খই, চিনি, ঘি, পেস্তা, কিসমিস দিয়ে তৈরি করা হয় যা স্বাদে অনুপম। পশ্চিমবঙ্গের কালনার মাখা সন্দেশ, কাটোয়ার ছানার জিলাপি, গুপ্তিপাড়ার গুপো সন্দেশ, মালদহের রসকদম্ব ও কানসাট, বহরমপুরে ছানা বড়া, আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট অঞ্চলের কমলাভোগের কদরই আলাদা। এই প্রসঙ্গে ওপার বাংলা অর্থাৎ অধুনা বাংলাদেশের কিছু মিষ্টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেমন – টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, কুমিল্লার রসমালাই, খুলনা ও মুক্তাগাছার অমৃতি, ময়মনসিংহের চালের জিলিপি, নওগাঁর প্যারা সন্দেশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানা মুখি, এছাড়াও রাজশাহীর তিলের খাজা, মেহেরপুরের সাবিত্রী মিষ্টি ও বগুড়ার দই।

Related Articles