দোষ বোলারের না হলেও দলের তো বটেই: যুধাজিৎ মুখোপাধ্যায়
It's not the bowler's fault, but it's the team's: Yudhajit Mukherjee

Truth Of Bengal: যুধাজিৎ মুখোপাধ্যায়, বিসিসিআই কোচ ও প্রাক্তন ক্রিকেটার: ধরে নিন পাওয়ার প্লে চলছে-৩০ গজের বৃত্তের বাইরে সর্বোচ্চ ২ জন ফিল্ডার থাকার কথা। কিন্তু কোনও কারণে ৩ জন রয়েছেন। বোলার বল করে উইকেটও নিয়েছেন, কিন্তু তারপরেই এটা ধরা পড়ে গিয়েছে-তাহলে কি আম্পায়ার ডেড বল ঘোষণা করবেন? নাকি ওই তৃতীয় ফিল্ডারকে ডেকে সতর্ক করে ছেড়ে দেবেন? সত্যিই তো-এতে বোলারের দোষ কোথায়? কিন্তু ন্যায়সঙ্গতভাবেই এ ক্ষেত্রে নো বলের পাশাপাশি দেওয়া হয় ফ্রি-হিটও। এটাই নিয়ম।
কেকেআর-এর তুরূপের তাস রহস্য স্পিনার বরুণ চক্রবর্তী কিন্তু এরকমই দাবি করেছেন বৃহস্পতিবার মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে হায়দরাবাদ ম্যাচের একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। মুম্বইয়ের ব্যাটার রিকেলটন প্রতিপক্ষের বোলার আনসারির বলে আউট হয়েও জীবন দান পেলেন হায়দরাবাদ-এর উইকেট রক্ষক ক্লাসেন এর ভুলে।
কারণ মুম্বই-এর ব্যাটার বল মারার আগেই তাঁর দস্তানা উইকেটের লাইন পেরিয়ে সামনে এগিয়ে এসেছিল, যা ক্রিকেট-এর নিয়ম বিরুদ্ধ। অতএব চলতি নিয়ম এর সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই আম্পায়ার ব্যাটারকে ফিরিয়ে আনেন। নো বল এবং ফ্রি হিট দুই-ই দেন।
এবার বিতর্ক বেঁধেছে এই ঘটনা কে নিয়েই! এদিকে বোলার লাইন পেরিয়ে বল করলে বা কোমরের ওপর ফুলটস দিলে নো বল এবং ফ্রি- হিটে আপত্তি নেই। কারণ এখানে পরিষ্কারভাবেই দোষী কিন্তু বোলার নিজে। অথচ ফিল্ডাররা উইকেট রক্ষকের দোষে নো বাল বা ফ্রি হিট কেনো বোলারের বিপক্ষএ যাবে? কেনো বিনা দোষে এই গুরুদণ্ড?
এখানে বরুণের এই যুক্তির সঙ্গে একমত অনেকেই। কিন্তু তর্কের খাতিরে একমত হলেও যে অনেক আইনের পরিবর্তন আনতে হবে এমনকি ক্রিকেটের যেটা মূল ভিত্তিপ্রস্তর সেখানেই আঘাত পড়বে সেটা বরুণবাবু বা তাঁর সমর্থকরা একটু তলিয়ে ভেবে দেখেছেন কি?
ক্রিকেট আসলে একটি দলগত খেলা- সেখানে একজনের দোষ বা ত্রুটি- সাফল্য বা ব্যর্থতার ফল দুই-ই সারা দল ভোগ করে। যেমন কোনো ব্যাটার যদি ২ মিনিটের বেশি সময়ে নিয়ে মাঠে নামেন তাহলে তাকেই টাইম আউট হতে হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ফল ভোগ করে পুরো দল-ও। যেমন ২০২৩-এর একদিনের বিশ্বকাপে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউস টাইম আউট হন এবং ফলস্বরূপ তাঁর দল ম্যাচ হেরেও যায়।
এবার কি শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক বলতে পারতেন যে দোষটি সম্পূর্ণ ম্যাথিউজের ব্যক্তিগত। তার ফল দল কেনো ভোগ করবে? এটাই কিন্তু হয়। ব্যক্তিগত দোষ, ত্রুটি ভুল, ভ্রান্তি যা হয় তার ফল ভোগ করতে হয় দলকেই। এক্ষেত্রে, আনসারীকেও তাই ভুগতে হল। উইকেট তুলে নেওয়া সত্ত্বেও এবং তাঁর নিজের কোনও দোষ না থাকা সত্ত্বেও। উল্টো দিকে নারিন যখন রান আটকে রাখার জন্য এদিকে বরুণ উইকেট পান তখন কি বরুণ বলেন, এই উইকেট নারিনের প্রাপ্য? এটাই ক্রিকেটের নিয়ম। এখানেই এই মহান খেলার মাহাত্ম্য এবং আইরনি দুই-ই।
বরুণ বাবু এবং তাঁর সমর্থকদের বলি-‘ক্রিকেট খেলতে এলে কিন্তু এটা আমার দোষ না আমি কেনো মাসুল দেবো’ এই মনোভাব সম্পূর্ণ ত্যাগ করে মাঠে আসতে হবে। কারণ ক্রিকেট বা ফুটবল – এই দলগত খেলাগুলোর মজা এবং আইরনিও এখানেই। একজনের কৃতিত্ব বা সাফল্য যেমন অন্যজন কে এগিয়ে দেয় সাফল্যের দিকে তেমনি একজনের দোষে ফল ভোগ করে গোটা দল হয়তো বা লঘু পাপে বা বিনা দোষে।
এই খেলার মাহাত্ম্য ও এখানেই- এভাবেই শেখা যায় নিজেকে, নিজের ব্যক্তিসত্তা কে ছাপিয়ে গিয়ে কিভাবে সবার ওপরে জায়গা দিতে হয় টিম স্পরিটকে, দলের স্বার্থকে। আরো সতর্ক হতে হয় নিজের ছোটো খাটো ভুল ভ্রান্তি সম্বন্ধে যাতে তা কোনোভাবেই সতীর্থদের বা দলের বিড়ম্বনার কারণ না হয়। এইজন্যই একটি টিম গেম বা দলগত খেলা থেকে যা শিক্ষা পাওয়া যায় তা সারাজীবন এর পাথেয় হয়ে থেকে যায়।
দলকে স্পিরিটের আরেকটি উদাহরণ আমাদের ভারতীয়দের একান্নবর্তী পরিবার। আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখেছি কিভাবে বড়ভাইদের ঘাড়ে পিঠে চড়ে ছোটরা বড় হয়- এবং তারপর তারাও একদিন তাদের ছোট ভাইপো ভাইঝিদের বড় করে তোলে তাদের ভুল ভ্রান্তি ঢেকে- উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে।
অন্যের দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিতে নিতেই কিন্তু একটা মানুষ কখনও বা আরো বড় হতে হতে একটা দল বা একটা দেশের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠেন কিন্তু তাঁর পেছনে অদৃশ্য থেকে যান সেই কোনো অজিত তেন্ডুলকর এর মত স্বার্থ ত্যাগকারি বড়দা-বাবা-কাকা রা।
যদি অজিতরা মনে করতে সচিন যা করে করছে করুক- আমার কি- আমি আমার জীবন নিয়ে থাকি- তাহলে কি আজ আমরা একটা সচিন কে পেতাম? এটাই ভারতবর্ষ- এবং এখানেই দল বা পরিবারের চরম সাফল্য। তাই দেখা যায় এরকম বড় টুর্নামেন্ট গুলোতে তারাই জেতে যারা একটা দল থেকে পরিবার হয়ে উঠতে পারে যেমন হালের ২০২২ এর ফুটবল বিশ্বকাপ জয়ী মেসির আর্জেন্টিনা থেকে ক্রিকেট বিশ্বকাপজয়ী রোহিত দের ভারত।
তাই আরও বেশি করে নজর এ থাকবে কোন দল এই লম্বা দৌড়ের শেষে আইপিএল ট্রফি জেতে সেদিকে এবং অবশ্যই টিম স্পিরিটের দিকে। তবে বরুণ এর মন্তব্য থেকে এটা প্রচ্ছন্ন যে কেকেয়ার এখনও দল থেকে পরিবার হওয়ার দিকে খুব একটা এগোতে পারেনি! এবং সে ব্যর্থতা তার একার নয়, পুরো দলেরই।