ব্রিজভূষণের গলার ফাঁস শক্ত হচ্ছে, দায় ঝেড়ে ফেলছে কি শীর্ষনেতৃত্ব?
জানুয়ারিতে ধর্নার পরেই, প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে

The Truth of Bengal: ব্রিজভূষণ। ব্রিজভূষণ শরণ সিং। নামটা শুনেছেন নিশ্চয়ই। মনেও আছে নিশ্চয়ই। এমন এক ব্যক্তি যাঁর বিরুদ্ধে আইনানু ব্যবস্থা নেওয়াতো দূর অস্ত, কল্পনা করাটাও সম্ভব নয়। অন্তত দিন কয়েক আগে পর্যন্ত সেটাই মনে হত। কিন্তু রবিবার আদালতে এই ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশ, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দফতরে থাকা পুলিশ আদালতের কাছে মারাত্ম অভিযোগ আনলেন। পুলিশ জানিয়েছে, তাদের কাছে যে প্রমাণ রয়েছে, তাতে স্পষ্ট সুযোগ পেলেই মহিলা কুস্তিগীরদের যৌনহেনস্থা করতেন। এখন প্রশ্ন, চলতি বছরের শুরু থেকেই ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ধর্না চালিয়ে এসেছেন একাদিক নামী দামি কুস্তিগীর থেকে খেলোয়াড়। প্রশ্ন, দিল্লি পুলিশকে আদালতের সামনে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে এমন একটা কথা বলতে এতো সময় লাগলো কেন? তাহলে কি চব্বিশের লোকসভার জুজু দেখছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব!
ব্রিজভূষণ সিং তিনি একটি টেলিভিশন ইন্টারভিউতে স্বীকার করেছিলেন, তিনি একজন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। সেই হত্যাকাণ্ডের মামলা রুজু হলেও, আজ পর্যন্ত সাজা হয়নি। একবার চোখ খেরানো যাক ব্রিজভূষণের অতীত ইতিহাসে।
ব্রিজভূষণ, ব্রিজভূষণ শরণ সিং, একাধারে বিজেপি সাংসদ অন্যদিকে তিনি ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সভাপতি একাধিক মহিলা কুস্তি খেলোয়াড়কে যৌন হেনস্থা করেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন নাবালিকাও রয়েছে। তাঁর ভয়ে অনেকেই প্রথম দিকে সামনে আসতে না চাইলেও, কিন্তু চলতি বছরের শুরুতেই বেশ কয়েকজন সামনে আসে।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে প্রথম ধর্নায় বসেন বেশ কয়েকজন বিখ্যাত খেলোয়াড়, তাঁদের মধ্যে অন্যতম. ভিনেশ ফোগট, সাক্ষী মালিক, সঙ্গীতা ফোগট এবং বজরং পুনিয়া। জানুয়ারিতে ধর্নার পরেই, প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে। কিন্তু মার্চ মাস পার হওয়ার পরেও সরকারের তরফে কোনও হেলদোল দেখা যায়নি। ফের একবার দিল্লির যন্তর মন্তরে দ্বিতীয় দফায় ধর্নায় বসতে হয় তাঁদের। আর যে প্রশ্ন সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, কে এই ব্রিজভূষণ, যার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গড়তে বা পদক্ষেপ করতে এতো সময় নিতে হচ্ছে সরকারকে?
কে এই ব্রিজভূষণ?
উত্তরপ্রদেশের লখনউ থেকে ১১৭ কিলোমিটার দূরে রয়েছে, গোন্ডা নামে এক জেলা। স্থানীয়দের মত, এই অঞ্চল দিয়ে যখনই কোনও ট্রেন যায়, পুলিশ আগাম সতর্কবার্তা জারি করে, বগির জানালা বন্ধ রাখুন, নয়তো যে কোনও মুহূর্তে চুরি, ছিন্তাই হতে পারে। এমনই একটি জায়গা থেকে ব্রিজভূষণ টানা ৬ বার সাংসদ হয়ে আসছেন। প্রথমবার তিনি সাংসদ হন ১৯৯০ সালে। স্থানীয় সূত্রের খবর, গোন্ডা জেলায় ব্রিজভূষণে দাপট এতোটাই বেশি, যে তিনি কোন দলের হয়ে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন তাতে কিছুই এসে যায় না। লোকে ব্রিজভূষণকেই ভোট দেয়।
২০০৪ সালে বিজেপি, ব্রিজভূষণকে বলরামপুর থেকে দাঁড় করায়। গোন্ডা থেকে ঘনশ্যাম শুক্লা নামে একজনকে টিকিট দেয় বিজেপি। কাকতালীয় ভাবে নির্বাচনের দিনই, পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ঘনশ্যাম শুক্লার। ব্রিজভূষণ যখন জেলে বন্দি ছিলেন তখন তাঁর স্ত্রী সাংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। একটি সংবাদপত্রের সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, ‘কোনও পার্টিকে আমার দরকার নেই, পার্টিকে আমার প্রয়োজন’। কারণ যখন তিনি নির্বাচন অংশ নেন, তখন তিনিই জেতেন। কেবলমাত্র তিনিই। একটি সংবাদমাধ্যমে তিনি একবার স্বীকার করেছিলেন, তিনি নিজে হাতে একবার হত্যা করেছিলেন।
তারপরেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে, থানায় বহু অভিযোগ দায়ের হয়েছে, কিন্তু একটি কেসের মামলাতেও উনি দোষী সাব্যস্ত হননি। কখনও প্রমাণের অভাব, কখনওবা সাক্ষীর অভাবে ছাড়া পেয়েছেন তিনি। বাবরি মসজিদ ভাঙার মামলাতেও প্রধান অভিযুক্তের তালিকায় ছিলেন ব্রিজভূষণ। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে এই ব্যক্তি কতটা শক্তিশালী, বাহুবলী। তার কাছে দেশের বিচারব্যবস্থাও কতটা দুর্বল। ছ’বারের সাংসদ ব্রিজভূষণের সম্পত্তির তালিকায় রয়েছে, ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার, একাধিক লাক্সারি গাড়ি, বিপুল স্থাবর সম্পত্তি। এ ছাড়া তিনি ৫০টির বেশি স্কুল কলেজের মালিক।
২০১১ সাল থেকে টানা ভারতায় কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ব্রিজভূষণ। তিনি নিজের এলাকায় কুস্তি ট্যুর্নামেন্টও আয়োজন করে থাকেন। এই সব ট্যুর্নামেন্টে যদি কোনও রেফারির সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হয়, তাহলে খেলোয়াড়েরা ব্রিজভূষণের কাছেই যায়, তাঁর আশীর্বাদ নেয়, এবং ব্রিজভূষণ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। আর সেটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
তাঁর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে, খেলোয়াড়েরা যে স্পন্সর পেয়ে থাকেন তার ৫০ শতাংশ হজম করেন ব্রিজভূষণ। আর এখানে ওঠে প্রশ্ন, এক সাংসদ কতটা শক্তিশালী যেখানে তাঁর বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ উঠলেও, দ্রুত পদক্ষেপ করতে এতোটা সময় লাগে? এই মহাশক্তির বিরুদ্ধেই চলতি বছরের শুরুতে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছিলেন দেশের বিখ্যাত কুস্তিগীরের। কিন্তু এই রাজনৈতিক দঙ্গলে, কোন পক্ষের জয় হবে? সত্যের নাকি দুর্জনের? প্রশ্নটা ছিলই।
প্রায় তিরিশ বছর ধরে ক্ষমতায় আসীন থাকা বাহুবলীর কি পতন হবে? অনেকে ভেবেছেন সময় এলেই হবে, কেউবা ভেবেছিলেন কোনও দিন হবে না। কারণ, এতো কিছুর পরেও, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এমনকী উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের মুখে তাঁর বিরুদ্ধে একটি কথাও শোনা যায়নি। কিন্তু দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালতে দিল্লি পুলিশ যা জানালো, তাতেই যেন আশার আলো দেখা যাচ্ছে। দিল্লি পুলিশ ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করতে প্রস্তুত। তাহলে কি ব্রিজভূষণের পতন শুরু হয়ে গেল? অনেকেই মনে করছে হয়তো হল, কারণ, চব্বিশের লোকসভা নির্বাচন।
গত মার্চ মাস থেকে কয়েকমাস যেভাবে রাজধানী ধর্না আন্দোলনে কেঁপে উঠেছিল, সেই ছবিটা আরও একবার তৈরি হোক, এটা চাইছেন না বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। তাই হয়তো এবার ব্রিডভূষণের ডানা ছাঁটার সময় এসেছে। শীর্ষনেতৃত্ব নিজেদের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ করতে, দাবা খেলায় একটি বোড়েকে বলি দিতে প্রস্তুত হয়েছে।
কারণ যে প্রধানমন্ত্রী নারী স্বাধীনতা কথা বলেন, অতি সম্প্রতি লোকসভায় পাস হয়েছে মহিলা সংরক্ষণ বিল, সেখানে ব্রিজভূষণেরমতো এক নেতার দলের মধ্যে টিকিয়ে রাখা পরস্পর বিরোধী। চব্বিশের নির্বাচনে বিরোধীরা যে ব্রিজভূষণকে হাতিয়ার করবে, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। ফলত, নির্বাচন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস পেলার আগেই টিউমার বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে মত রাজনৈতিকমহলের।