অফবিট

আজ চেনা বাংলার অজানা কথা-য় জানুন মালদার ইতিহাস

Learn about the history of Malda in today's unknown facts about Bengal

Truth Of Bengal: বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইতিহাস খুঁজতে গেলে, অত্যাশ্চর্য বহু ইতিহাস প্রকাশ্যে আসে। সেইসমস্ত ইতিহাসের শিকড় ছড়িয়ে রয়েছে বিস্তৃত বহু এলাকা জুড়ে। সময়ের কালখণ্ডে, বাংলার গণ্ডি হয়তো ছোট হয়েছে, কিন্তু শিকড় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। আজকের পর্বে দেখব প্রাচীন গৌড়ের ইতিহাসকে।

মালদহ, কথ্য ভাষায় মালদা বর্তমানে অনেকটাই জনপ্রিয়। এই জেলার নাম উল্লেখ করলেই, চলে আসে গৌড়ের কথা। গৌড় নাম কীভাবে এসেছে, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। কেউ বলেন, একটা সময় এখানে এখানে গুড় উৎপাদন হত বলেই গৌড় নামটি এসেছে। পাশেই রয়েছে পাণ্ডুয়া, এই নামটি এসেছে নাকি পৌন্ড্রবর্ধন থেকে। পুঁড় মানে আখ, সেই থেকে পেঁড়ো, যার আসল সুসভ্য নাম পৌন্ড্র। অনেকে আবার ধারণা করেছে এই অঞ্চলে অনেক আখের চাষ হত, সেই থেকে পুন্ড্রবর্ধন নামটি এসেছে।

জৈন গ্রন্থ আচারঙ্গ সূত্র থেকে জানা যায়, গৌড় দেশ রেশম বস্ত্রের জন্য বিখ্যাত ছিল। আবার কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে গৌড়ির স্বর্ণের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ গৌড় নগর যে প্রাচীন তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। পৌরাণিক কাহিনীর সূত্র ধরলে, পদ্মপুরাণে গৌড়দেশের রাজা ছিলেন নরসিংহ। আবার স্কন্দপুরাণে সরস্বতী তীরবর্তী এলাকা এবং কনৌজ, উৎকল, মিথিলা, গৌড়কে পঞ্চ গৌড় বলা হয়েছে। অর্থাৎ গৌড় শুধু একটি নয়, পাঁচটি। কলহনের রাজতরঙ্গিনী এবং হিউ এন সাংয়ের ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে যে সূত্র মেলে, তার থেকে গবেষকরা অনুমান করেছেন, সেই সময় গৌড় রাজ্য নানা অংশে বিভক্ত ছিল। কাশ্মীরি সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধে গৌড়ীয় সেনার সাহসিকতার সঙ্গে প্রাণদান এবং সমৃদ্ধ রাজ্যের কথা বলা হয়েছিল।

ষষ্ঠ শতাব্দীতে লিখিত বরাহমিহিরের বৃহৎ সংহিতায় গৌড় অঞ্চল পৌন্ড্র অর্থাৎ উত্তরবঙ্গ, তাম্রলিপ্ত অর্থাৎ মেদিনীপুর জেলা এবং সমতট অর্থআৎ দক্ষিণপূর্ব বঙ্গ পৃথক ভাবে চিহ্নিত ছিল। যদিও অভিলেখের সূত্র থেকে জানা যায়, ৫৫৪ খ্রিস্টাব্দের হরারা শিলালিপিতে মৌখরী বংশের ঈশান বর্মনের গৌড়দেশ বিজয়ের কথায় প্রথম এ নামের প্রমাণ মেলে। আনুমানিক সময়কাল ৬৫৫ খ্রিস্টাব্দ অফসদ শিলালিপিতে সুক্ষ্মশিব নামক লিপি খোদাইকরের পরিচয়ে তাঁকে গৌড়দেশের অধিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাদল স্তম্ভলিপিতে দেবপালকে গৌড়েশ্বর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রকূটরাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণ গৌড়বাসীদের নম্রতা শিক্ষাদানের গৌরবের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। গৌড়দেশে একটা সময় পাল বংশের রাজারা রাজত্ব করেছিলেন, তার প্রভাব কতটা বিস্তৃত ছিল, তার নজির মেলে ইতিহাসে। প্রায় তিনশো বছর পাল রাজাদের শাসনকাল ছিল বাংলায়। ইতিহাস বলছে, গোপালদেব ছিলেন পালবংশের প্রথম রাজা। এই বংশের প্রত্যেকেই ছিলেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। গোপালের পুত্র ধর্মপাল সমগ্র আর্যাবর্ত জয় করে সার্বভৌম্য সম্রাটের পদ লাভ করেছিলেন। তাঁর পুত্র একসময় মগধ জয় করেছিলেন। ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায়, পাল রাজাদের আমলে বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভূত উন্নতিসাধন হয়েছিল।

দেবপালের পর শূরপাল প্রথম এবং মহেন্দ্রপাল কিছু সময়ের জন্য রাজত্ব করেন। এরপর উল্লেখযোগ্য রাজা দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র মহীপাল আনুমানিক ৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। মহীপালের খ্যাতি শুধুমাত্র লিপি বা গ্রন্থেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন লোকগাথার মধ্যেও। মহীপালের পুত্র নয়পালের সময় অতীশ দীপঙ্কর বিক্রমশীলা বিহারের প্রথম অধ্যপক হয়েছিলেন। মালদা জেলায় পাল রাজাদের তিনটি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে।

১) ধর্মপালের খালিমপুরের তাম্রশাসন
২) গোপালদেবের জাজিলপাড়া তাম্রশাসন
৩। মহেন্দ্রপালের জগজীবনপুর তাম্রশাসন

পাল রাজারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হলেও, ভিন্ন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা কম ছিল না। তাঁদের শাসন ব্যবস্থায় বাংলা তথা গৌড়ভূমিতে শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, স্থাপত্য, ভাস্কর্যের বহু নিদর্শন মিলেছে।

পাল বংশের পর বাংলায় সেন রাজবংশের সূত্রপাত। সেন রাজারা দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট দেশের অধিবাসী ছিলেন। সামন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেন, আনুমানিক ১০৯৭-১১৬০ খ্রিস্টাব্দে গৌড়রাজ মদনপালকে পরাজিত করে শক্তিশালী রাজশক্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র বল্লাল সেনকে শ্রেষ্ঠ রাজা বলে মনে করেছেন ইতিহাসবিদেরা। তাঁর লেখা বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ হল দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর। কৌলিন্যপ্রথার সঙ্গে তাঁর নামটি বিশেষভাবে জড়িত। বল্লালসেনের পুত্র লক্ষন সেনের রাজত্বকালে উত্তরে গৌড়, পূর্বে কামরূপ, দক্ষিণে কলিঙ্গ পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। বহু গ্রন্থের রচয়িতা পণ্ডিত হলায়ুধ লক্ষনসেনের ধর্মাধ্যক্ষ ছিলেন। লক্ষ্মন সেনের নাম অনুসারে রাজধানী লক্ষ্মনাবতী নামকরণ করা হয়।

সেন রাজত্বকালে হিন্দু ব্রহ্মণ্যধর্ম কঠোর শৃঙ্খলা ও রক্ষণশীলতার বর্মে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা হয়। সেন রাজত্বের শেষ দিক বাংলাদেশে সংস্কৃত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠযুগ হিসেবে ধরা হয়। লক্ষ্মন সেনের পরবর্তী সময়ে তাঁর তিন পুত্র মাধব সেন, কেশব সেন, বিশ্বরূপ সেন ক্রমান্বয়ে গৌড়ের সিংহাসনে বসেন। গৌড়ের ইতিহাস প্রাচীন শিলালিপি, বা পর্যটকদের বই থেকে মিললেও স্থাপত্যের নিদর্শন এখন আর তেমন কিছু নেই। যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, তা সবটাই মুসলিম যুগের। মহম্মদ ঘোরি যখন দিল্লি অধিকার করে কুতুবুদ্দিনকে প্রতিনিধি করে গজনীতে ফিরে যান। তার কিছু পরেই, সময়টা আনুমানিক ১১৯৫ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি গৌড় বা লক্ষ্ণণাবতী আক্রমণ করেন। গিয়াসুদ্দিন ইউজের পর গৌড় পুরোপুরি দিল্লির সুলতানি শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। যদিও তখন থেকেই টালমাটাল ছিল এখানকার শাসন ব্যবস্থা। নানা শাসকের উত্থান পতনের পর, বলবনী বংশের শাসন চলে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে তুঘলক বংশের শামস উদ্দিন ফিরোজ শাহ গৌড়ের সুলতান হন। তারপর থেকে বহু সুলতানি শাসক এসেছে, গিয়েছে। মাঝে, কিছু সময় প্রভুত্ব করেছেন হিন্দু রাজারা।

মালদহের গৌড়ের যে স্থাপত্যগুলি রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম আদিনা মসজিদ, দাখিল দরওয়াজা, ফিরোজ মিনার, বড় সোনা মসজিদ, চিকা মসজিদ, লুকোচুরি দরওয়াজা, মাতা জহুরা মন্দির ইত্যাদি। তবে এখানে একটি প্রাচীন দিঘি রয়েছে, নাম পিয়াসবাড়ি দিঘি। আর এই জলাশয়কে নিয়ে নানা কিংবদন্তী রয়েছে। আইন-ই আকবরীতেও এই দিঘির উল্লেখ রয়েছে। কিংবদন্তী রয়েছে, এই দিঘির জল আগে লবনাক্ত ছিল। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের এর পাশে বন্দি করে রাখা হত, এবং এই দিঘির জল পান করিয়ে হত্যা করা হত। আকবরের নির্দেশে এইরকম হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হয়। যদিও এই দিঘির জল লবনাক্ত ছিল, বা আকবরের নির্দেশিকা এর কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলেনি।

গৌড় রামকেলী অঞ্চলের শ্রেষ্ট দ্রষ্টব্য বারোদুয়ারী বা বড় সোনা মসজিদ। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে এটি সুলতান হুসেন শাহর পুত্র সুলতান নাসিরুদ্দিন নসরৎ শাহ তৈরি করান। মসজিদের ভিতর তিনটি লম্বা আইল দিয়ে পৃথক পরিসর এবং সম্মুখে এগারোটি খিলান দ্বারা উন্মুক্ত পথ।

এখানে একটি প্রার্থনাকক্ষ, সম্মুক্ষে বারান্দা ও কোনগুলিতে অষ্টভূজ বুরুজ বর্তমান। সম্মুখভাগ সমান। ছাদ ও দেওয়ালের সঙ্গমস্থলে কারুকাজ ও বক্রাকৃতি কার্নিস। উপরে অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজ। নামাজের কক্ষ প্রস্তরস্তম্ভ দ্বারা বিভক্ত। এটি তিনটি লম্বা আইল এবং উত্তরে তিনটি বে দ্বারা নির্মিত। ডানদিকে যে মহিলাদের বসার স্থান ছিল তা বোঝা যায়। বেশ কয়েক দশক আগেই মূল কক্ষের ৩৩টি গম্বুজই ভেঙে গিয়েছে। ইমামের বেদিও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ক্যানিংহামের বক্তব্য থেকে জানা যায়, বিপুল অর্থ ব্যয় করে এই মসজিদ নির্মান করা হয়েছিল, তাই এর নাম সোনা মসজিদ রাখা হয়। আবিদ আলিও এই যুক্তিতে সমর্থন করেছেন। যদিও কিংবদন্তী রয়েছে, এই মসজিদে সোনার পাত লাগানো ছিল একসময়, সেই থেকেই এই নামকরণ।

গৌড়ে স্থাপত্যগুলির মধ্যে আরও একটি বিশেষ নিদর্শন দাখিল দরওয়াজা। বারদুয়ারি থেকে কিছুটা দূরে দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে এটি গৌড়ের সিংহদুয়ার বা মূল দরওয়াজা বলা হত। কিংবদন্তী রয়েছে, এই ফটকের পার্শ্ববর্তী গড় থেকে সুলতানকে বন্দুক দেগে সম্মান জানানো হত বলে এটি সালামী দরওয়াজা নামেও পরিচিত ছিল। এটি বাংলা রীতিতে নির্মিত প্রথম সিংহদুয়ার। দাখিল দরওয়াজার সঠিক নির্মাণকাল জানা যায়নি।

ক্রিটন এক শিলালিপি পাঠের সুলতান বারবর শাহের রাজত্বকালে এটি নির্মিত বলে মনে করেছেন, রেভেন্স, বার্গেস, ফার্গুসন এবং পার্সি ব্রাউন। পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে এটির নির্মাণকার্য হয় বলে ধারণা করা হয়। দাখিল দরওয়াজা দেখলে বোঝা যায় সম্পূর্ণ প্রবেশপথ তিনটি খিলানের দ্বারা একটি ভল্ট তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে অবশ্য সেই ভল্ট কিছুটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অতীতে এই ফটকের চারপাশে দ্বাদশকোনী বুরুজ ছিল। বর্তমানে দুটি রয়ে গিয়েছে।

দাখিল দরওয়াজা থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে ফিরোজ মিনার। স্থানীয়রা অনেকেই এই মিনারকে পীরআশা মন্দির এবং চেরাগদানি বলে থাকেন। কেউ কেউ মনে করেন এটি ওয়াচটাওয়ার হিসেবে ব্যবহার হত। কেউবা এটিতে অবসের্ভেটরি বলে মনে করেছেন। আপাত দৃষ্টিতে মিনারটির গঠন দিল্লির কুতুবমিনারের বঙ্গীয় সংস্করণ। যদিও স্থাপত্যের নিরিখে বিচার করলে, নন্দনতত্ত্বের খামতি রয়েছে।

ফিরোজ মিনারের পিছন দিকে উত্তরপশ্চিম কোনে একটি খাজাঞ্চিখানা বা ট্যাঁকশাল ছিল। কেউ কেউ দাবি করেন এই ট্যাঁকশালের নাম ফিরোজাবাদ। ভবনের পাশেই ছিল হারেম বা মহাল সরাই। মালদা জেলাসহ আশে পাশের অঞ্চলে একটা সময় কতটা প্রতিপত্তিশালী ছিল, তা বর্তনামে সেভাবে আন্দাজ করা সম্ভব নয়। কারণ বহু স্থাপত্য হারিয়ে গিয়েছে। বহু স্থাপনা অস্তাচলের পথে। যদিও ইতিহাস শুধু ধরা আছে, কালো হরফে।

Related Articles